‘ঋষ্’ ধাতুর অনেকগুলি অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ঊধর্বগতি অর্থাৎ ওপরের দিকে ওঠা৷ কোন বাড়ীর একতলা থেকে ওপরে ওঠার জন্যে এই ‘ঋষ্’ ধাতু ব্যবহূত হয়৷ ‘ঋষ্’ ধাতুূ‘ইন্’ করে ‘ঋষি’ শব্দ পাচ্ছি যার ভাবারূূার্থ হচ্ছে যিনি ওপরের দিকে ওঠেন আর যোগারূূার্থ হচ্ছে উন্নতমানস.....উন্নতধী.....উন্নত ভাবনার পুরুষ৷ ‘ঋষি’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘ঋষ্যা’ হলেও অভিন্নলিঙ্গ (ন্তুপ্সপ্পপ্পপ্সু ন্ধন্দ্বুস্তুন্দ্বব্জ) ‘ঋষি’ শব্দটিও চলতে পারে৷ অর্থাৎ কোন পুরুষকে যেমন ‘ঋষি’ বলা যায় কোন নারীকেও তেমনি ‘ঋষি’ বলা যেতে পারে আবার ‘ঋষ্যা’ তো চলতেই পারে উন্নত চেতনার মানুষদের ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ‘ঋষি’ বলে আসা হয়েছে৷ প্রতিটি মন্ত্র যেমন একটি ছন্দে রচিত, অধিকাংশ মন্ত্র যেমন পরমপুরুষের একটি বিশেষ নামে সম্বোধিত, তেমনি প্রতিটি মন্ত্রেরই একজন করে দ্রষ্টা–ঋষি থাকতেন যিনি তাঁর সাধনায় বা ধ্যান–ধারণায় সত্যকে উপলব্ধি করে তা শিষ্যকে কাণে কাণে শুণিয়ে দিতেন (গোড়ার দিকে অক্ষর ছিল না৷ তাই লিখে শেখানো সম্ভব ছিল না৷ যেহেতু লিপি ছিল না তাই ‘লেখক–ঋষি’ বলা হত না–বলা হত দ্রষ্টা–ঋষি, অর্থাৎ যে ঋষি ধ্যানে সত্যকে দেখেছেন)৷
ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ঋষিদের মুখ্যতঃ চারটি ভাগে বিভাজিত করে রাখা হয়েছিল–(১) মহর্ষি, (২) দেবর্ষি, (৩) রাজর্ষি ও (৪) ব্রহ্মর্ষি৷ যে সকল মানুষ তাঁদের জাগতিক কর্ত্তব্য যথাবিধি সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গে ঊধর্বতর জগতের খোঁজে ধ্যান–ধারণা–সাধনা (আরণ্যক ও উপনিষদ) প্রভৃতি করতেন ও তৎসহ সেই অধ্যাত্ম মার্গে সিদ্ধিলাভ করে জগতের সেবা করতেন তাঁদের বলা হত মহর্ষি (যেমন, মহর্ষি বিশ্বামিত্র)৷ (২) যাঁরা দেবকুলে (নর্ডিক, এ্যলপাইন অথবা মেডিটারেনিয়ান উপবর্গীয় ও ককেশীয় বর্গীয় কুলে) জন্মগ্রহণ করে সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক চেতনায় অধিষ্ঠিত হতেন তাঁদের বলা হত দেবর্ষি (যেমন, দেবর্ষি নারদ) (৩) যাঁরা জাগতিক কর্তব্যের অতিরিক্ত সামাজিক কর্তব্য (যেমন, রাজা) প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হূদয়বৃত্তিকে...মনীষাকে আধ্যাত্মিক চেতনায় অভিক্লপ্ত করতেন (হূদামনীষা মনসাহভিক্লপ্তঃ) তাঁদের বলা হত রাজর্ষি (যেমন, রাজর্ষি জনক)
(৪) যাঁরা আজীবন আধ্যাত্মিক এষণাতে জীবন অতিবাহিত করে দিতেন তাঁদের বলা হত ব্রহ্মর্ষি (যেমন ব্রহ্মর্ষি কণ্ব, অথর্বা প্রভৃতি)৷ অথর্ববেদের সময় অথর্ববেদের প্রবক্তা বা আদি পুরুষ (বৈদিক ভাষায় ‘আদর্শ পুরুষ’) অথর্বাকে ব্রহ্মর্ষি বলে মর্যাদা দেওয়া হ’ত৷ আর মহর্ষির মর্যাদায় সম্মানিত হতেন বেশ কয়েকজন ঋষি৷ তাঁদের মধ্যে আট জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য৷ তাঁরা হলেন–মহর্ষি অত্রি, অঙ্গিরা, অঙ্গিরস, পুলহ, পুলস্ত, সত্যবাহ, বশিষ্ঠ ও বৈদর্ভি৷ যাঁরা ভাবেন বেদ সামগ্রিকভাবে বহির্ভারতে রচিত তাঁদের এই ভাবনা নিরঙ্কুশ হতে পারে না৷ অন্ততঃ অথর্ববেদের ক্ষেত্রে তো নয়–ই৷ বৈদর্ভি নামটিতেই প্রমাণিত হয় যে তিনি ছিলেন বিদর্ভের অর্থাৎ নাগপুর–মরাবতী অঞ্চলের মানুষ৷ মহর্ষি বৈদর্ভি মধ্য এশিয়ায় গিয়ে সেখানে বসে বসে অথর্ববেদ তৈরী করেছিলেন এমন কথা বলা কিছুটা কষ্টকল্পিত৷ তবে হ্যাঁ, সামগ্রিকভাবে অথর্ববেদ এদেশে রচিত নাও হয়ে থাকতে পারে৷ মহর্ষি অথর্বা অথর্ববেদের আদর্শ পুরুষ ছিলেন৷ তাঁকে প্রাচীন পুরুষ হিসেবেও শ্রদ্ধা করা হত৷ এখনও আমরা অধিক বয়স্ক্ মানুষের সম্বন্ধে বলে থাকি, ‘‘তিনি অথর্ব হয়ে পড়েছেন’’৷
মনে রাখা দরকার, ‘ঋষি’ আর ‘মুনি’ এক জিনিস নয়৷ ঋষির সম্বন্ধে এতক্ষণ বললুম৷ ‘মুনি’ শব্দ মুখ্যতঃ দু’টি অর্থে ব্যবহূত হয়ে থাকে৷ ‘মুনি’–র একটা মানে হচ্ছে ‘মননশীল সত্তা’৷ অর্থাৎ ntellectual€ ‘মুনি’–র দ্বিতীয় মানে হচ্ছে যিনি তাঁর মনকে পরমপুরুষে সংলীন করে রেখেছেন–
‘‘ন মুনির্দুগ্ধৰালকঃ মুনিঃ সংলীনমানসঃ৷’ (‘‘শব্দ চয়নিকা’’ দ্বিতীয় খণ্ড)