বিশ্বে আজ সাহিত্য নামে যে জিনিসটি চলছে তার অধিকাংশই সাহিত্য নয়,---রচনা মাত্র৷ সাহিত্যিককে তার কলমের প্রতিটি আঁচড়েই বিরাট দায়িত্বৰোধের পরিচয় দিতে হবে৷ তাই সত্যিকারের সাহিত্যিক হতে গেলে কেবল ভাষা বা ভাব থাকলেই চলৰে না, তার চাইতে বেশী আরও কিছু চাই, প্রতিটি বস্তুর ভেতরে প্রবেশ করবার শক্তি---মন দিয়ে প্রতিটি মনকে নিজের মনে মিলিয়ে’ ফেলবার সাধনা৷ সোজা কথায় বলতে গেলে তাকে তত্ত্বদর্শী হতেই হৰে৷ জীবন সম্বন্ধে সামান্য ভাসা-ভাসা জ্ঞান নিয়ে ভাষার তুবড়ি ছুটিয়ে’ সাহিত্য তৈরী করা যায় না৷ বৈদিক ভাষায় সাহিত্যিককে কবি ৰলা হত৷ কারণ ‘কবি’ শব্দের অর্থ তত্ত্বদ্রষ্টা৷ কেবলমাত্র তত্ত্বদ্রষ্টারাই সত্যিকারের সাহিত্য গড়ে’ তুলতে পারে৷ সাহিত্যিকের কাজ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেওয়া৷ আর এই ভবিষ্যৎকে দেখবার সামর্থ্য কেবল তত্ত্বদ্রষ্টাদেরই আছে৷ যারা মনে করে বর্তমানের বা অতীতের বা ভবিষ্যতের ছবিটুকু এঁকে দিয়েই আমি দায়ে খালাস---তারা সাহিত্যিক নয়৷ কারণ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান---কালের এই তিনটে ভাগের ওপর অধিকার নির্ধারিত হয় এই তিনের সংযোজনী শক্তির আত্মস্থীকরণের ওপর৷ যে এই প্রবাহিকা শক্তিকে আত্মস্থ করতে পারে নি সে কিছুতেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বা বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্বন্ধ নির্ণয় করতে পারে না৷ তাই তার আঁকা ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোন ছবিই যথাযথভাবে ফুটে’ উঠতে পারে না৷ তাই ৰলছিলুম এদি’কে সাহিত্যিক না ৰলে’ রচনাকার ৰলাই অধিকতর সঙ্গত৷ এই শ্রেণীর রচনাকারেরাই ‘‘আর্ট, ফর আর্টস্ সেক্’ Art for art's sake) উক্তিটি ব্যবহার করে’ থাকেন৷ একটু তলিয়ে’ ভেবে’ দেখলে সবাই একথা মানতে বাধ্য হৰে যে আর্ট Art) জিনিসটাকে আর্টের খাতিরে ফেলে রেখে দিলে মানুষ সমাজের ওপর তার প্রভাব কতখানি ক্ষতিকর হতে পারে৷
জগৎ ভূমামানসের কল্পনাধারা thought-projection of cosmic mind) তাই এর কোথাও ক্ষণেকের তরেও থেমে’ থাকবার জো নেই৷ ইচ্ছা থাক বা না থাক, মানুষের সমাজ, মানুষের পরিবেশ পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে’ সামনের পানে এগিয়ে’ যাবে, যেতেই হবে৷ সাহিত্য জিনিসটা এই গতিশীল মানুষেরই মানসিক অভিব্যক্তি৷ এই গতিশীল মানুষের প্রয়োজনেই তার সৃষ্টি তাই সেও কোন স্থির-সত্তা হতে পারে না, হতেই পারে না৷ যে সমাজের আলেখ্য শিল্পীর তুলিতে ধরা পড়ে, যে ভাবধারার স্ফুরণ সাহিত্যের মাধ্যমে হয় তার ভাবসঞ্চারী তত্ত্বগুলো যখন পরিবর্তনশীল তখন শিল্পী বা সাহিত্যিককে সব সময়েই সেই তত্ত্বগুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে’ কাজ করে’ যেতে হৰে৷ সমাজের গতি অনেকগুলো তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল হলেও মূলতঃ তার গতি নির্ধারিত হয় মানসিক তথা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের, দ্বারা৷
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অভিমত ১ম খণ্ডের ‘মানুষের সাহিত্য ও শিল্প সাধনা’ রচনা থেকে সংগৃহীত)