নদীয়ার বাজারের মধ্য দিয়ে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে হেঁটে চলেছে যতি৷ হঠাৎ সে দেখলো, দোকানীরা সব দোকান বন্ধ করে দিচ্ছে৷ লোকজন যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে৷ সবাই উত্তেজিত৷ সবাই ভীত সন্ত্রস্ত্র৷ পথের লোকজন আর খদ্দেররা সব আশেপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে৷ মুখে তাদের এককথা---‘পালাও পালাও’৷
যতি তখনো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি৷ তাই সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছন ফিরলো৷ দেখলো, রাজবাড়ির একটা খ্যাপা ঘোড়া বাঁধনছিঁড়ে উন্মাদের মতো বেগে ছুটে আসছে৷ তারই ভয়ে লোকজন সব দিশেহারা৷
যতি প্রথমটায় কি করবে ভেবে পেলো না৷ তাই সে থমকে দাঁড়িয়ে রইল৷ অমনি পাশের একটা বাড়ি থেকে শোণা গেল কয়েকটা ভয়ার্ত চীৎকার--- এই খোকা পালিয়ে যা, পালিয়ে যা৷ পাগলা ঘোড়া আসছে৷ লাথি মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেবে৷ পালিয়ে যা৷
কিন্তু ভয় কাকে বলে যতির তা জানা নেই৷ সে তৎক্ষণাৎ মালকোঁচা মেরে হাতার আস্তিন গুটিয়ে পথের পাশে এসে দাঁড়ালো৷
ঠকাঠক, ঠক ঠক... ঠকাঠক ঠকঠক... একেবারে এসে পড়লো যতির কাছে৷
যতি অমনি দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে ঘোড়াটার পথ রোধ করে দাঁড়ালো৷
আশেপাশের বাড়ির লোকেরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দেখতে লাগলো---পাগলা ঘোড়া আর পাগলা খোকার কীর্ত্তি৷
অকস্মাৎ বাধা পেয়ে অমন দুর্দ্ধর্ষ রণংদেহী ঘোড়াটা থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়ালো৷
আর যতি অমনি একলাফে ঘোড়াটার কপালের ঝুঁটি ধরলো আঁকড়ে৷
যতির এহেন বেয়াদপিতে ঘোড়াটা পিছ-পা করে খাড়া হয়ে উঠলো৷ আর রাগে চিঁহিচিঁহি ডাক ছাড়তে লাগলো৷
যতিও অমনি চিৎকার করে উঠলো--- বেঁধে ফেলুন এবার একে বেঁধে ফেলুন৷ আর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটার গ্রীবা ধরে সে বাদুড়ের মতো ঝুলে পড়লো৷ আর অনবরত শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিতে লাগলো৷
কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না ঘোড়াটাকে বাঁধতে৷ কারণ,ঘোড়াটার তখনো তেজ কমেনি৷ তার দৌড়াত্ম্য তখনও যতির আয়ত্বের বাইরে৷
চললো ঘোড়া-মানুষের ধস্তাধস্তি৷ ঘোড়া যত চায় ঘাড় উঁচু করতে যতি তত তাকে টেনে ধরে নীচের দিকে৷
দূরে দাঁড়িয়ে তখনো কিছু সংখ্যক প্রৌঢ় যতিকে পালিয়ে এসে প্রাণ বাঁচাবার সৎ উপদেশ দিচ্ছিলেন৷
পশুর ভয়ে মানুষ পালিয়ে যাবে তা হয় না, মরবে সে ও ভালো, তবু পালিয়ে আসবে না যতি৷
দেখতে দেখতে অত বড় বিশাল ঘোড়াটা অতটুকু ছেলে যতির কাছে সত্যি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো৷ জয় হলো যতির৷ শান্ত হয়ে ঘাড় নীচু করে ঘোড়াটা যতির বশ্যতা স্বীকার করলো৷
তখন আশপাশ থেকে সব বীরপুরুষ ছুটে এসে ঘোড়াটাকে বেঁধে ফেললো৷
বাহবা পেল যতি৷ সবাই তার সাহস শক্তি আর বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলো৷ আশপাশ বাড়ির ছাদ, জানালা অলিন্দ ও দরজার আড়াল থেকে ‘সাবাস সাবাস’ রব উঠলো যতির উদ্দেশ্যে৷
এবার শোন, এই যতির আসল পরিচয়৷ কে জানো এই যতি? হ্যাঁ এই সেই বাঘ মারা যতি-বাঘ মারা যতীন ---বাঘাযতীন৷ ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে ৮ই ডিসেম্বর তাঁর জন্ম দিন৷ জন্মস্থান বিশখালি, যশোহর জেলা৷ পিতা উমেশচন্দ্র৷ কুষ্ঠিয়ায় ছোরার আঘাতে একটি বাঘ মারেন বলে তাঁর নাম হয় বাঘাযতীন৷ ইনি বালেশ্বরে ইংরেজ পুলিশের সাথে যুদ্ধে আহত হন৷ অবশেষে বালেশ্বর হাসপাতালে মারা যান৷
- Log in to post comments