প্রাউটের মতে গোটা দেশের সর্বাত্মক সামাজিক–অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে, সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরে শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে, চাই বিজ্ঞানভিত্তিক সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা৷ এ জন্যে প্রথমে গোটা দেশকে প্রয়োজনে একাধিক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে (socio-economic unit) বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলকে স্বয়ং–সম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে৷ প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে ওই এলাকার বিশেষ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে পৃথক পৃথক পরিকল্পনা রচনা করা বাঞ্ছনীয়৷ এই যে দেশকে প্রয়োজনমত একাধিক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করার কথা বলা হ’ল, তা করতে হবে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করে–
১. একই ধরণের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সমস্যা৷ তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার সম্ভাবনা (potentiality)
২. সম ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সামাজিক প্রথা প্রভৃতির ওপর গড়ে ওঠা একই সেন্টিমেন্ট্যাল লিগ্যাসি
৩. একই জাতিগত বৈশিষ্ট্য
৪. একই ধরণের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি৷
এই নীতি অনুসারে ভারতবর্ষের সমগ্র এলাকার তথা সকল জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে একে ৪৪টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে (প্রাউট দর্শনে একে সংক্ষেপে ‘সমাজ’ও বলা হয়) বিভক্ত করে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা উচিত৷ যেমন সমগ্র বাংলা তথা বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা উচিত একটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ প্রাউটের পরিকল্পনা নীতি অনুসারে ভারতের অন্যান্য সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা সমাজগুলি হবে ঃ–
উৎকল, কোশল, ভুটিয়া, বোড়ো, অসমিয়া, অঙ্গিকা, মিথিলা, মগ্হী, ভোজপুরী, নাগপুরিয়া, লেপ্চা, অবধি, ব্রজ, হরিয়ানবি, গাড়োয়ালী, কুমায়ূন, পঞ্জাবী, সিরমৌরী, পাহাড়ী, কিন্নৌরী, ডোগ্রী, কশ্মীরী, লাদাকী, মাড়োয়ারী, হদৌতি, মেওয়ারী, কচ্ছী, কাথিয়াড়, গুর্জর, বিদর্ভ, সহ্যাদ্রি, মালোয়া, বুন্দেলখণ্ড, বাঘেলী, ছত্রিশগড়ী, তেলেঙ্গানা, রয়ালসীমা, তামিল, মালায়লম্, কান্নাড়া ও টুলু সমাজ৷
প্রাউট যে ভারতে ৪৪টি সমাজ রচনার কথা বলছে, তার মানে এই নয় যে ৪৪টি পৃথক রাজ্য গড়তে হবে৷ এখানে পৃথক পৃথক রাজ্য তৈরীর কথা বলা হচ্ছে না, মূলতঃ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে৷ একই রাজ্যের মধ্যে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকতে কোন বাধা নেই৷ তবে সেক্ষেত্রে প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে৷ তাদের ন্যায্য দাবি তথা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না৷ ওই অঞ্চলের জন্যে পৃথক বাজেটও মেনে নিতে হবে৷
প্রাউটের নীতি অনুসারে–
(১) প্রতিটি সমাজ তার নিজস্ব এলাকাকে স্বয়ম্ভর (self-sufficient) করে গড়ে তোলার জন্যে পৃথকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করবে৷ অন্ততঃ ওই অঞ্চলের সকল মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন ভিত্তিক পণ্যসমূহ ওই এলাকার মধ্যে উৎপাদন করার পূর্ণ প্রয়াস করবে৷ এ ব্যাপারে যাতে তাকে অন্য এলাকা থেকে আমদানির ওপর নির্ভর করতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে৷ ওই অঞ্চলের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্যের বিনিময়ে অন্য অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করা চলবে৷ রপ্তানীর চেয়ে আমদানি বেশী হলে ওই এলাকার উন্নয়ন ব্যাহত হবে৷
(২) প্রতিটি সমাজ তার এলাকার ১০০ শতাংশ ‘স্থানীয়’ মানুষের কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে৷ এই দিকে লক্ষ্য রেখে প্রতিটি ব্লকে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা রচনা করবে৷ ওই পরিকল্পনায় স্থানীয় কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প ব্যাপকভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে৷ স্থানীয় কাঁচামাল ও অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ না করলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক শিল্পবিকাশ তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়৷
এখানে ‘স্থানীয়’ মানুষ বলতে অবশ্যই কোন বিশেষ ভাষাভাষী, বা কোন বিশেষ ধর্মমতাবলম্বী, বা কোন বিশেষ জাতি বা উপজাতিকে চিহ্ণিত করা চলবে না৷ তাহলে প্রাউটের নীতিতে ‘স্থানীয়’ কাদের বলা হচ্ছে? তার সুস্পষ্ট উত্তর হ’ল, কোন এক ‘সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ‘সমাজে’ বসবাসরত যে সমস্ত মানুষ তাদের নিজেদের ব্যষ্টিগত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে ওই ‘সমাজে’র স্বার্থের সঙ্গে এক করে দিতে পেরেছে, তাঁরা যে কোন ভাষাভাষী হোক না কেন বা যে কোন ধর্মমতাবলম্বী বা তথাকথিত যে কোন জাতি বা উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষ হোক না কেন, তারা সবাই ‘স্থানীয়’ মানুষ রূপে চিহ্ণিত হবে৷ বলা বাহুল্য, সে ওই এলাকা থেকে অর্থ ও কাঁচামালের বহিঃস্রোত ঘটিয়ে ওই এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করবে না৷
প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রথম স্তরে মূল লক্ষ্যই হবে, সমস্ত স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তথা নূ্যনতম চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা৷ এব্যাপারে প্রতিটি সমাজকে ‘স্বয়ম্ভর’ (self-sufficient) করে গড়ে তুলতে হবে৷ ক্রমান্বয়ে সমস্ত সমাজের মাথা পিছু আয়ের হার তথা জীবনধারণের মানও বৃদ্ধি পেতে থাকবে৷
প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ হবে, পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজ উপরিউক্ত ভাবে স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠার পর ওই সমাজগুলির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও প্রশাসনিক সুবিধার ভিত্তিতে দুই বা ততোধিক সমাজকে যুক্ত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা৷ এইভাবে ক্রমশই সমাজগুলির আয়তন বৃদ্ধি করে চলতে হবে৷
সকল সমাজের সমবায়ে একটি ‘সর্ব সমাজ সমিতি’ থাকবে৷ সমস্ত ‘সমাজ’গুলিই তার সদস্য হবে৷ এ সর্বসমাজ সমিতি বিভিন্ন সমাজগুলির মধ্যে সম্প্রীতি, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের সেতু হিসেবে কাজ করবে৷ সমস্ত সমাজ আন্দোলনের মূল নীতি, পদ্ধতি তথা গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করবে এই সর্ব সমাজ সমিতি৷
প্রাউটের বিভিন্ন ‘সমাজ’ গুলির মধ্যে যে বিরোধ থাকবে না বা প্রাউটের ‘সমাজ’–আন্দোলন যে আদৌ সংকীর্ণতাবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী চরিত্রের হবে না, তার কারণ ঃ–
১. প্রাউটের ভিত্তি নব্য মানবতাবাদ তথা আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ৷ প্রাউট দর্শনে বলা হচ্ছে, সকল মানুষ এক বিশ্বস্রষ্টা–পরমপিতার সন্তান৷ তাই বিশ্বের সমূহ সম্পদ সকল মানুষেরই পৈত্রিক সম্পদ৷ সেই হিসেবে বিশ্বের সকল সম্পদে সকলের যৌথ অধিকার রয়েছে৷
সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সম্পদকে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে এই বিশ্বের প্রতিটি মানুষ তথা প্রতিটি জীবের কল্যাণ সাধনই প্রাউটের উদ্দেশ্য৷ প্রাউট প্রকৃতপক্ষে বিশ্বৈকতাবাদেরই প্রতিষ্ঠা চায়৷ প্রতিটি প্রাউটিষ্ট কর্মী এই নীতিতে উদ্বুদ্ধ হবে৷ তাই এখানে সংকীর্ণতাবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদের কোন প্রশ্ণই ওঠে না৷
২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার স্বার্থে যে সমাজের বিভাজন করা হচ্ছে, তাতে কোন সমাজের এলাকায় বসবাসকারী যে কোন ভাষাভাষী মানুষ যদি তার নিজের বিশেষ করে অর্থনৈতিক স্বার্থকে ওই সমাজের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, তাহলে তাকে স্থানীয় বলে গণ্য করা হবে৷
৩. প্রাউটিষ্ট সর্বসমাজ সমিতি সকল সমাজের উন্নয়নের তথা আন্দোলনের নীতি, পদ্ধতি ও গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে৷ তাই সকল সমাজের থাকছে এক লক্ষ্য, এক আদর্শ ও প্রকৃতপক্ষে এক মঞ্চ৷ এজন্যে এখানে সংকীর্ণতাবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদের কোন প্রশ্ণই উঠতে পারে না৷ প্রাউটের এই সমাজ–আন্দোলনের ভিত্তি হ’ল, ‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা (‘universal in spirit and regional in approach’—)৷
এও মনে রাখতে হবে শোষক ও শোষিতের মধ্যে প্রকৃত প্রীতি ও ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হয় না৷ তাই শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন বিশ্ববন্ধুত্বের পথের অন্তরায়কে দূর করে স্থায়ী বিশ্বৈকতাবাদের ভিত্তিকেই মজবুত করে৷
- Log in to post comments