সৌরজগতে দোল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

প্রাচীনকাল থেকে ভারতে নানা নামে, নানা পদ্ধতিতে সূর্যপূজা ও সূর্যের প্রতীক উপাসনা হয়ে আসছে৷ আমাদের দোলযাত্রার ধর্মীয় রীতিতেও সৌরজগতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷

ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোল হচ্ছে বিষ্ণুর দোল৷ যেসব অঞ্চলে বিষ্ণু মন্দির আছে সেখানে মন্দিরের অনতিদূরে একটি মণ্ডপ তৈরি করা হয়৷ মণ্ডপের চতুর্দিক থাকে অনাচ্ছাদিত৷ চারকোণে চারটি খুঁটি৷ শুধু মাথার ওপর থাকে একটি চাঁদোয়া৷ মণ্ডপে বেদী তৈরি করে বিষ্ণুর রূপক শালগ্রাম শিলা স্থাপিত হয়৷ সন্ধ্যার আগে মন্দির থেকে বিষ্ণুর বিগ্রহ মণ্ডপে এনে বেদীতে বসিয়ে তাঁর পূজা ও হোমসম্পন্ন হয়৷ তারপর বিগ্রহের সিংহাসন তিনবার উত্তর-দক্ষিণে দোলানো হয়৷ বিষ্ণুকে এই দোলানোর মধ্যেই নিহিত আছে দোলযাত্রার উৎস৷ বিষ্ণু শব্দের অর্থসূর্য৷ বিষ্ণু হচ্ছে চালনী শক্তি যা সূর্যে নিহিত আছে৷ সূর্যতাপ ও আলোক বিকিরণ করেন বলেই প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে আছে৷ গুণ কর্মের বিশ্লেষণে বিষ্ণু ও সূর্য, অভিন্ন৷ সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়নের দিকে তাকিয়েই ‘যাত্রা’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে৷ ‘অয়ন’ মানে গতি৷ সূর্যের দক্ষিণাগমন আর উত্তরাগমনের জন্যই বলা হয়েছে দোলযাত্রা৷ ‘যাত্রা’ মানে ও তো গমন৷ বিষ্ণুর দোলন আর বিষ্ণুরূপ সূর্যের উত্তর দক্ষিণযাত্রা--- দুই নিয়ে দোলযাত্রা৷

বিগ্রহের সিংহাসন তিনবার উত্তর-দক্ষিণে দোলানোর মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর ত্রিপদক্ষেপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷ সূর্যের উত্তর দক্ষিণে গমনাগমনে বিষ্ণুর তিনটি পদক্ষেপ-স্থান পাওয়া যায়৷ কর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তি ও বিষুবরেখা৷ দক্ষিণায়ন শুরুর পরদিন অর্থাৎ ২২ জুন সূর্যের অবস্থান বিষ্ণুর একটি পদক্ষেপ, দ্বিতীয় পদক্ষেপ ২৩ সেপ্ঢেম্বর, শরতে বিষুব রেখায় সূর্যের অবস্থান ও ২২ ডিসেম্বর দক্ষিণায়নের শেষ দিনে সূর্যের অবস্থান তৃতীয় পদক্ষেপ রূপে কল্পিত হয়৷ বিষ্ণুর এই ত্রিবিক্রম হচ্ছে সূর্যের বার্ষিক গতি৷

দোলনপর্ব সাঙ্গ হলে বিষ্ণুমূর্ত্তির অঙ্গে ফাগ স্পর্শ করে তা প্রসাদে রূপান্তরিত করা হয়৷ সেই ফাগ সকলে কপালে মাখেন৷ দোলের সময় লাল ফাগ দিয়ে শালগ্রামরূপী সবিতার অঙ্গ ভূষিত হয়৷ সূর্যেরই আরেক নাম সবিতা, সবিতা হিরণ্যময়৷ শীতকালে শিশুরবিকে লোহিত বর্ণ দেখায়৷ তাই বুঝি লালসূর্যকে লাল আবীর দিয়ে বন্দনা করা হয়৷ বিষ্ণুকে বলা হয় সহস্রশিরা৷ বিষ্ণুর সহস্র শির হচ্ছে সূর্যের অসংখ্য রশ্মি৷ পিচকারির সাহায্যে যে তরলরঙের ধারা নিক্ষিপ্ত হয় তা ও বিচ্ছুরিত সূর্য রশ্মিরই প্রতীক৷