‘‘একই ভৌগোলিক পরিবেশে, একই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আবেষ্টনীর মধ্যে যাদের জন্ম ও লালন-পালন, সেই জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে৷ পরবর্তীকালের এই গোষ্ঠীগত বৈশিষ্টগুলোর সমগ্র জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ভাবধারার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে এতে করে একটা জাতীয় স্বভাব তৈরী হয়৷ তা দিয়েই একটা গোটা জাতির মানস-প্রবণতা, বাহ্যিক আচরণ, জীবন ও সমাজের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি---এককথায় একটি বিশেষ জাতীয় দৃষ্টিকোণ গড়ে ওঠে---যা সেই জাতিকে অন্য জাতি থেকে এক পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করে৷
পৃথিবীর বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এই কারণেই তাদের জগৎ ও জীবনের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ গড়ে উঠেছে৷ এই পার্থক্য যতখানি বাহ্যিক, তার চেয়ে অনেক বেশী অভ্যন্তরীণ৷ বৈয়ষ্টিক তথা সামূহিক জীবনে সুসংহত জীবনযাত্রা ও শিক্ষার মাধ্যমে মনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে তুলতে পারা যায়৷ বৈয়ষ্টিক জীবনে মনোরাজ্যের এই যে আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা---একেই বলব ব্যষ্টিজীবনের প্রাণধর্ম৷ আবার যখন জাতীয় গণগত বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষ পথ ধরে প্রকাশিত হয়ে উঠেছে---তখন তাকেই বলব জাতির প্রাণধর্ম৷’’ (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)
এবার দেখি এই জাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন---‘‘এই বৃহৎ সত্তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র সত্তা আছে তাকে বলা হয় জাতিক সত্তা৷ মানুষকে মানুষ করে তুলবার ভার এই জাতিক সত্তার ওপর৷’’
মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার আরও বলেছেন, ‘‘কোনও ব্যষ্টি বা জাতির সঙ্গে খুব বড় রকম শত্রুতার উপায় হ’ল---সেই ব্যষ্টি বা জাতিকে প্রাণধর্ম থেকে বিচ্যুত করা৷ হয় জোর করে প্রাণধর্মের অনুশীলনের অধিকার কেড়ে নেওয়া অথবা তার সামনে তার নিজস্ব প্রাণ-ধর্মের প্রতিকূল এক জীবনাদর্শ খাড়া করা৷ তাহলে তার শক্তি সামর্থ্য বিপথে চালিত হবে ও ফলস্বরূপ সে হয়ে পড়বে ক্রমাগত হীনবল৷’’
স্বাধীনতার পর স্বদেশী সাম্রাজ্যবাদী শাসক বাঙলাকে শুধু হীনবল নয়, লুপ্তপ্রায় জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে৷ ৭৫ বছর ধরে বাঙলার ওপর দিল্লির দমন পীড়ন, শোষণ একশো নববই বছরের বিদেশী ব্রিটিশ শাসনকে ছাড়িয়ে গেছে৷ বাঙলার উন্নত ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আজ যে অশ্লীল অসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে তার মূলেও আছে দিল্লির শোষণ৷
এখানে আমার কথা, গো-মাতা সহ ইদানিংকালে উগ্র হিন্দুত্ববাদের নামে আমদানি করা এইসব অসংস্কৃতি বাঙালী জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দিচ্ছে৷ দুশো বছরে ব্রিটিশ পারেনি, মাত্র সত্তর বছরে দিল্লীর স্বদেশী বাদামী শাসক (নেহেরু থেকে নরেন্দ্র মোদী) ও দেশীয় পুঁজিপতিরা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নিপুণভাবে সেটা করে চলেছে৷ আজ বাঙলার যে অধঃপতন, যে অধোগতি সেটা পাঁচ-সাত বছরে হয়নি৷ উত্তর ও পশ্চিম ভারতে যেটা সহজে পেরেছে, বাঙলার সেটা সহজ হয়নি, তার কারণ রামমোহন, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ আরও অনেক মনীষীদের প্রভাব৷ দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে কংগ্রেসের ও বামেদের মাধ্যমে অতি সূক্ষ্মভাবে শোষকগোষ্ঠী অসংস্কৃতির স্রোত বইয়ে দিয়ে সেই কাজটি করেছে৷ মমতা সেই স্রোতে এসে পড়েছে৷ মোদী চা-ওয়ালার ব্যাটা হতে পারে, কিন্তু পালিত হয়েছে আম্বানী-আদানীদের কোলে৷ নেহেরুকে দিয়ে শুরু করা কাজ তারা শেষ করতে চায় মোদীর দ্বারা৷ নোট বন্দী থেকে ঋণ মুকুব সবেতেই আম্বানি-আদানীরা লালে লাল৷ তার ওপর বাঙলা দখল করতে পারলে সোনায় সোহাগা৷ বিজেপির হাতে বাঙলা গেলে কয়েক বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ হবে অবাঙালী প্রধান রাজ্য৷ তিলে তিলে বাঙলার প্রাণধর্মকে শেষ করে দিচ্ছে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ৷
বাঙলা বাঁচলে ভারত বাঁচবে, ভারত বাঁচলে বিশ্ব বাঁচবে৷ তাই বাঙলাকে যারা গলা টিপে মারতে চায়, বাঙলার যারা প্রাণধর্ম---প্রাণরস শুষে নিতে চায়, সেই সব পুঁজিবাদের প্রতিভূদের কিছুতেই বাঙলায় স্থান দেওয়া উচিত নয়৷ এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ ও তার প্রতিভূদের বিনাশই বাঙলাকে বাঁচাবে, দেশকে বাঁচাবে৷
- Log in to post comments