পৃথিবীতে মানুষ এসেছে দশ লক্ষ বছর হয়ে গেল৷ তার সভ্যতার বয়সও পনেরো হাজার বছর পার হয়ে গেল৷ জড়বিজ্ঞানও আজ উন্নতির চরম শিখরে৷ পর্বতকন্দর, অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণকুটির ছেড়ে মানুষ আজ আলো ঝলমল শহরের সুরম্য অট্টালিকার বাসিন্দা৷ তবুও আজও একটা সুসন্নিবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠল না৷ বলা উচিত মানুষ গড়ে তুলতে পারল না৷ এটা আজকের মানুষের বুদ্ধি ও বোধির পক্ষে খুব একটা গৌরবের নয়৷
মহর্ষি কপিল থেকে মনীষী কার্লমার্কস পৃথিবীতে অনেক দার্শনিক এসেছেন অনেক, দর্শনও দিয়েছেন, জীবন ও জগৎ নিয়ে মনীষাদীপ্ত চিন্তাভাবনার ছাপও আছে তাঁদের দর্শনে৷ তবু আদর্শ সমাজ গঠনের বলিষ্ঠ পথনির্দেশনা তাঁদের দর্শনে পাওয়া যায়নি৷
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘‘তোমরা জান, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অভিব্যক্তিসমূহ তিনটি স্তরে বিন্যস্ত---ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷’’
এ যাবৎ যত দার্শনিক এসেছেন, যত দর্শন দিয়েছেন কোথাও জগৎ ও জীবনের এই তিন স্তরের মধ্যে সমন্বয়, দৃঢ় সংযোগ দেখা যায়নি৷ কেউ বা শুধু জগৎ নিয়ে ভেবেছেন, ঋণ করে ঘি খেয়ে যেতে বলেছেন, আধ্যাত্মিক দিকটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন, মিথ্যা কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন৷ অপরদিকে কেউ শুধু আধ্যাত্মিক দিকটা নিয়েই চিন্তা করেছেন, জগৎকে মিথ্যা বলে উপেক্ষা করেছেন৷ ফলে তাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারা যেমন ত্রুটিপূর্ণ, তেমনি বাস্তবের ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে৷ তাই মানুষ বৌদ্ধিক জগতে কিছুটা এগোলেও বিজ্ঞানের উন্নতিও আকাশছোঁয়া হলেও মানুষ মানুষের প্রয়োজন মত সমাজব্যবস্থা আজ গড়ে তুলতে পারল না৷
শুধু তাই নয় তার সভ্যতার বড়াইও অসাড় আত্মম্ভরিতা ছাড়া কিছু নয়৷ মানুষের সীমাহীন লোভ মানুষকে করে তুলেছে উন্মাদ, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক৷ স্বার্থের সংঘাতে, হিংসার আগুনে পুড়ে মরছে লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ৷ সমাজের এই দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যেই পরিত্রাণ কর্তারূপে আবির্ভূত হলেন মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি, লৌকিক জগতে যিনি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নামে পরিচিত৷
বিংশ শতাব্দীর পৃথিবী বার বার রক্তস্নাত হয়েছে৷ দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধ, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কালোবাজারি সমাজকে গ্রাস করে নিয়েছে৷ তবু সভ্যতার ইতিহাসে বিংশ শতাব্দী এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অধিকারী হবে এই কারণে যে এই শতাব্দীতে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আবির্ভাব ও আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবর্ত্তন৷
একমাত্র আনন্দমার্গ দর্শনই ভৌতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক---তিন স্তরেই দৃঢ় সংযোগ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সুসন্নিবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা ও যথার্থ প্রগতির সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা দিয়েছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই ধরণের বাস্তব প্রয়োগ ভিত্তিক ও বৈপ্লবিক চিন্তাধারার প্রকাশ আগে পরিলক্ষিত হয়নি৷ সামাজিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক সর্ববিধ ক্ষেত্রে প্রচলিত চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আনন্দমার্গ দর্শন৷ এই দর্শনেরই অঙ্গ সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব যা সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ নামে পরিচিত৷
রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি যেমন আধ্যাত্মিকতাভিত্তিক সৎ ও নীতিবাদে দৃঢ় সদ্বিপ্র নেতৃত্বের কথা বলেছেন, তেমনি কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়ে বাস্তব ও প্রয়োগভিত্তিক সুসন্তুলিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পথ দেখিয়েছেন যা এ যাবৎ প্রচলিত কোনও অর্থনৈতিক তত্ত্বেই পাওয়া যায়নি৷ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, এখানে সামাজিক ক্ষেত্রেও উদার ও সার্বভৌম দৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়৷ ব্যষ্টিকে উপেক্ষা করে সমষ্টির অবাস্তব চিন্তাধারা যেমন এখানে নেই, আবার অর্থ ও ক্ষমতার জোরে অল্প কয়েকজনের শাসন ও শোষণের সুযোগও নেই৷ সুসামঞ্জস্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এখানে যেমন জীবন ধারণের সর্বনিম্ন প্রয়োজনপূর্ত্তির নিশ্চিততা থাকছে, আবার উপেক্ষিত, অবহেলিত তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মানুষকেও পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়৷
তাই আনন্দমার্গ দর্শনে কোনও ভেদ-বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না৷ আজকের বিজ্ঞান উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছলেও সভ্যতা পিছিয়ে পড়েছে৷ ফলস্বরূপ মানুষ নানারকম সামাজিক ও মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে৷ মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে ---সভ্যতার সঙ্গে বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকা উচিত৷ একই সঙ্গে দু’টোর উন্নতিরপ্রয়োজন৷ বিজ্ঞান যদি সভ্যতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, তবে সভ্যতার যেমন ভরাডুবি হয়, বিজ্ঞানও সমাজের কাছে অভিশাপ হয়ে ওঠে৷ তাই দুইয়ের উন্নতি একসঙ্গে হওয়া উচিত৷ মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্যে বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে এক সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷ আর তা করতে হলে বোধিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন অপরিহার্য৷ আনন্দমার্গ দর্শন বিজ্ঞানসম্মত আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতি, সমাজবিধি ও প্রয়োগভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ রচনার পথ দেখিয়েছে৷ তাই আধ্যাত্মিক প্রগতি ও বিজ্ঞানের উন্নতি দুইয়ের সমন্বয়ে আনন্দমার্গের পক্ষেই সম্ভব সমাজের সব কালিমা দূর করে’ সর্বগ্লানিমুক্ত, সর্বকলুষমুক্ত এক নির্মল পৃথিবী তৈরী করা৷ আজকের মানুষ আনন্দমার্গের দিকে তাকিয়ে সেই স্বর্ণোজ্জ্বল সুপ্রভাতের আশায় অপেক্ষা করছে৷
- Log in to post comments