আগে আমি বহুবার বলেছি যে যাঁরা আধ্যাত্মিক নীতিবাদ তথা ‘‘যম–নিয়ম’’ পালন করেন আর যাঁরা পরম চৈতন্য সত্তার প্রতি অনুরক্ত তাঁরাই হলেন সদ্বিপ্র৷ মানুষ সদ্বিপ্রকে চিনে নেবে তাঁর আদর্শ আচরণ, নিঃস্বার্থ সেবা, কর্ত্তব্যপরায়ণতা আর নৈতিক দৃঢ়তার মধ্যে দিয়ে৷ একমাত্র সদ্বিপ্ররাই নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করতে পারে আর সকলকে সর্বাত্মক প্রগতির পথে নিয়ে চলতে পারে৷ এই সদ্বিপ্ররা–যারা সঠিক জীবনাদর্শকে অনুসরণ করে আর যথাযথ সাধনা পদ্ধতির অনুশীলন করে–তারাই ভবিষ্যতে মানবসমাজের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকবে৷
আজ পৃথিবীতে সরকার পরিচালন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রই অধিকতর পছন্দ–যোগ্য৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র আদর্শ ব্যবস্থা নয় কেননা এতে অনেক ত্রুটি আছে৷ ৰুদ্ধিমান মানুষেরা সেইজন্যেই এখন এই ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি দূর করার উপায় খুঁজতে শুরু করেছেন৷ বর্ত্তমান পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাউট ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে৷ ভবিষ্যতে আরো ভাল কোনো সরকার পরিচালন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই গড়ে উঠবে৷
প্রাউটের মতে সদ্বিপ্রদের শাসনই হ’ল আদর্শ ব্যবস্থা৷ এজন্যে অনেক উন্নত মানসিকতার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে৷ তাঁদের মিলিত ভাবে, বিধিৰদ্ধ ও বিচারসম্মত পদ্ধতিতে প্রাউটের বাস্তব প্রয়োগের জন্যে চেষ্টা করে যেতে হবে৷ তবেই সদ্বিপ্রদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে৷ অন্ধ জড়শক্তির দ্বারা অথবা কর্মবিমুখ ৰৌদ্ধিক অমিতাচারের (intellectual extravaganza) দ্বারা এই আদর্শ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷
সদ্বিপ্রেরা সবরকম দুর্নীতি ও শোষণের বিরুদ্ধে বিরামবিহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে৷ তারা নীতিহীনতা ও বিভেদমূলক প্রবণতার বিরুদ্ধে সর্বদা যুঝে চলবে৷ শান্তি আর মানবপ্রগতির প্রতিষ্ঠা পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে সদ্বিপ্রের সামূহিক প্রচেষ্টার ওপর৷
গণতন্ত্র মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, কেননা এই ব্যবস্থায় একটি বিশেষ শ্রেণী সমাজে প্রভুত্ব করার সুযোগ পায়, যার ফলস্বরূপ অন্যান্য শ্রেণী তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়৷ সমাজের সর্বাত্মক কল্যাণকে সুনিশ্চিত করবার জন্যে সদ্বিপ্রের কল্যাণমূলক একনায়কত্বের (benevolent dictatorship) প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজনীয়৷ একমাত্র সদ্বিপ্ররাই সাধারণ মানুষের প্রকৃত আশা–আকাঙক্ষার মূর্ত্ত প্রতিভূ হতে পারে৷
এই যে সদ্বিপ্রদের একনায়কত্ব তার রূপটা কী ধরনের হবে প্রাউট রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে সমর্থন করে৷ কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের অর্থ এই নয় যে, একজন ব্যষ্টি বা একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে৷ শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন শাখায় যাঁরা যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন ও এ ব্যাপারে যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের মধ্যে থেকে উপযুক্ত লোক নির্বাচন করে নিয়ে সদ্বিপ্ররা বিভিন্ন বোর্ড গঠন করে দেবে৷ এই বোর্ডগুলি হবে নিম্নরূপ ঃ–
(১) সদ্বিপ্রদের সর্বোচ্চ বোর্ড
এই সর্বোচ্চ বোর্ড তৈরী হবে সদ্বিপ্রদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে৷ নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে ও সমাজের অন্যান্য বোর্ডের কাজকর্মকে উপযুক্তভাবে তত্ত্বাবধান করবার জন্যে এই বোর্ড হবে সর্বোচ্চ স্তরের সামূহিক প্রতিষ্ঠান৷
(২) সদ্বিপ্রদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বোর্ড
যেসব সদ্বিপ্ররা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে অভিজ্ঞ, তাদের নিয়ে এই বোর্ড গঠিত হবে৷ প্রাউটের মূল নীতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ বোর্ড যে কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেবে সেই অনুসারে আইন প্রণয়ন করাই হবে এই বোর্ডের কাজ৷
(৩) সদ্বিপ্রদের শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত বোর্ড
যেসব সদ্বিপ্র শাসনব্যবস্থার কাজে অভিজ্ঞ তাদের নিয়ে এই বোর্ড গঠিত হবে৷ সদ্বিপ্রদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বোর্ড যে আইন ও শাসন–নীতি প্রণয়ন করবে তাদের কার্যে রূপায়িত করবার দায়িত্ব থাকবে এই বোর্ডের ওপর৷ যারা আমলাতান্ত্রিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন তাদের উপযুক্ত ভাবে বাছাই করা ও মনোনয়ন দেওয়ার কাজকে তত্ত্বাবধান করবে এই বোর্ড৷ শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন শাখায় যেসব সাব–বোর্ড গঠিত হবে তাদের কাজকর্মেরও তত্ত্বাবধান করবে এই বোর্ড৷
(৪) সদ্বিপ্রদের বিচারব্যবস্থা সংক্রান্ত বোর্ড
যেসব সদ্বিপ্র বিচারব্যবস্থার কাজে অভিজ্ঞ তাদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে এই বোর্ড গঠিত হবে৷ বিচারকদের নিযুক্তি ও বিচারব্যবস্থার অন্যান্য কর্মচারীদের নিযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন নিয়ম ও পদ্ধতি নির্ধারণ করবে এই বোর্ড৷
(৫) শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন শাখার জন্যে সদ্বিপ্রদের সাব–বোর্ড
শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন কাজে যাঁরা দক্ষ সেই সব সদ্বিপ্রদেরই এই সাব–বোর্ড–গুলিতে নিযুক্ত করা হবে৷ সদ্বিপ্রদের শাসনকার্য সংক্রান্ত বোর্ড এই সাব–বোর্ডগুলির প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য নামের তালিকা প্রস্তুত করে আইন সংক্রান্ত বোর্ডে পাঠাবে৷ আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বোর্ড আবার প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সেই তালিকা সদ্বিপ্রদের সর্বোচ্চ বোর্ডের কাছে সুপারিশ করে পাঠাবে৷ সর্বোচ্চ বোর্ড এই তালিকার চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে৷
অবশ্য সদ্বিপ্রদের সর্বোচ্চ বোর্ড যদি তালিকা অনুমোদন না করে, তাহলে প্রয়োজনীয় সংশোধন সহ তা আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বোর্ডের কাছে ফেরত পাঠাবে৷ সেক্ষেত্রে সেই বোর্ড হয় সংশোধনীগুলিকে স্বীকৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট তালিকা আবার সর্বোচ্চ বোর্ডের কাছে পাঠিয়ে দেবে, অথবা সর্বোচ্চ বোর্ডের কাছে সংশোধনীগুলি সম্পর্কে তাদের মতামত জানিয়ে দেবে৷ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ বোর্ডই চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার অধিকারী৷ তাই সাব–বোর্ডের সদস্যদের নিযুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এই বোর্ড৷ ১৯৬৯, রাঁচী