শিল্পে সমবায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

বিশ্বের কোন জীবকেই আমরা উপেক্ষা করতে পারি না৷ বিশ্বের এক অংশের শিল্পোন্নয়ন অন্য অংশের দারিদ্র্য বা বেকারীকে ভালভাবে দূর করতে পারে না৷ তাই শিল্প–ব্যবস্থা যতদূর সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুযায়ীই করা উচিত৷

শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ ঃ কোন একটি দেশ বা জেলা যদি অত্যধিক শিল্পোন্নত হয়, তাতে অপরাপর অংশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন রকম সুবিধা হয় না৷ তাই শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার৷ কিন্তু মূল শিল্প থাকবে কেন্দ্রীকৃত৷ উদাহরণস্বরূপ, সুতাকল শিল্প হবে কেন্দ্রীকৃত–যাকে কেন্দ্র করে’ বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিতে গড়ে’ উঠবে বস্ত্রবয়ন শিল্প৷

বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উভয় শিল্পই পাশাপাশি থাকবে৷ মূল–শিল্প পরিচালিত হবে স্থানীয় সরকার দ্বারা৷ কারণ এর জটিলতা ও ব্যাপকতার জন্যে সমবায় ভিত্তিতে সুষ্ঠুভাবে চালান সম্ভব নয়৷ ক্ষুদ্র–শিল্প সমবায় ভিত্তিতে পরিচালনা করা অসুবিধাজনক–কেবলমাত্র সেগুলি ব্যষ্টিগত পরিচালনায় ছেড়ে দেওয়া হবে৷ এইভাবে–

(১) ছোট ছোট ব্যবসায়–প্রতিষ্ঠান থাকবে ব্যষ্টিগত পরিচালনায়৷

(২) মূল–শিল্প থাকবে স্থানীয় প্রশাসনের পরিচালনায়৷

(৩) ক্ষুদ্র ও মূল শিল্পের মাঝের শিল্পগুলি পরিচালিত হবে সমবায় ভিত্তিতে৷

প্রাউটের অর্থনীতিতে এটা সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র৷

কেন্দ্রীয় সরকার বৃহৎ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ করবে না, কারণ এতে স্থানীয় জনসাধারণের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে৷ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন–ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে স্থানীয় রাজ্য–সরকার, বা যেখানে একক শাসন–ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে লোকসংস্থা মূল শিল্প পরিচালনা করবে৷

শিল্প–ব্যবসায়ের ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীকরণ নানান্ কারণে সমর্থন করা যায় না, তবে তার মধ্যে প্রধান দু’টো কারণ হচ্ছে এই যে, প্রথমতঃ আমলা–নির্ভরশীল (মনে রাখতে হবে মুখে যে যাই বলুক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আমলা–তন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে, যাকে বাদ দিয়ে সেবা চলতে পারে, কিন্তু শাসন চলতে পারে না) রাষ্ট্রের পক্ষে দেশের সর্বাংশে পরিব্যপ্ত ক্ষুদ্র–বৃহৎ প্রতিটি ব্যবসায় ও শিল্প–প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব, শুধু হিসেব নিকেশেই নয়, কর্মী–পরিচালনার ব্যাপারেও তা’তে বেশ একটা শৈথিল্য থেকে যায়৷ দ্বিতীয়তঃ ব্যষ্টিগত অধিকারে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান যেরূপ শিল্পগত বা ব্যবসায়গত দক্ষতা দেখাতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠান তা পারে না বা পারা সম্ভবও নয়৷ যে কোনো বস্তু প্রস্তুত করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থার যে পরিমাণ ব্যয় হয়, ব্যষ্টিগত প্রতিষ্ঠান তদপেক্ষা অনেক অল্পব্যয়ে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে সেই কার্য সমাধা করে–যা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয় না৷

সরকারী নিয়ন্ত্রণে বে–সরকারী মালিকানায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়করণের চেয়েও খারাপ জিনিস, কারণ তাতে রাষ্ট্রীকরণের ত্রুটিগুলি তো থাকবেই অধিকন্তু রাষ্ট্রে একটি ধনী অথচ বিক্ষুব্ধ বৈশ্য–সমাজও রাষ্ট্র–বিরোধিতার সকল সম্ভাবনা নিয়েই জনসাধারণের মধ্যে থাকবে৷ প্রতিষ্ঠা পুনঃপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কোনও হীন পন্থাই তারা বাদ দেবে না৷

শিল্প–ব্যবসায়ের ওপর রাষ্ট্রের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ অথবা তাদের অতি–লোভ সংযত করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ অসাধু কর্মচারীদের যোগ–সাজসে নকল খাতায় মিথ্যা হিসেব দেখিয়ে রাষ্ট্রের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করা ব্যবসায়ীদের পক্ষে মোটেই কষ্টকর কাজ হবে না৷ অধিকন্তু সম্পূর্ণ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকলে এরা যে মূল্যের বিনিময়ে জনসাধারণের সেবা করত, এতে এরা তা–ও করবে না৷ নিজেদের ব্যয়াধিক্য দেখাবার জন্যে উৎপাদিত দ্রব্যেরও মূল্য বাড়িয়ে দেবে৷১৩

বৃহৎ শিল্প পরিচালিত হবে ‘না মুনাফা না ক্ষতি’ নীতির ভিত্তিতে৷১যেহেতু মুনাফা নিয়েই প্রায়শঃ শ্রমিক–সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেহেতু কোন নীট লাভ থাকবে না৷ ‘না লাভ না ক্ষতির’ ভিত্তিতে উৎপাদিত বস্তুর উৎপাদন খরচও কম হবে৷ সংস্থার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক হিসাব রাখাও জরুরী৷ যদি কোন শিল্প ঘাটতিতে চলে তাহলে সেই শিল্পকে শিল্প–সমবায়ে রূপান্তরিত করতে হবে৷৬

ব্যষ্টিগত উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকবে সেই সব পণ্যের মধ্যে যা জীবনের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়৷ ব্যষ্টিগত মালিকানায় পরিচালিত শিল্পগুলি আকারে আয়তনে অবশ্যই সীমিত হবে৷ উদ্দেশ্য হবে একচেটিয়া উৎপাদন ও মুনাফাকে প্রতিহত করা৷ আর যখনই তারা আয়তনে বড় হয়ে উঠবে তখনই তারা সামবায়িক সংস্থার পরিচালনার আওতায় এসে যাবে৷

সামবায়িক শিল্প ঃ সামবায়িক সংস্থা পরিচালিত শিল্পগুলি হ’ল মানুষকে স্বাধীনভাবে সুসংঘটিত করার একটি সর্বোত্তম পন্থা৷ এতে সকলেই জীবিকা অর্জনের যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ৷

সমবায়ে শ্রমিকদের উৎসাহ প্রদান ঃ শ্রমিকদের মধ্যে যাঁদের উৎপাদন হবে সর্বাধিক, তাঁরা সর্বাধিক বোনাস পাবেন৷ সমবায়ে নিযুক্ত দক্ষ শ্রমিকদের ব্দন্সন্প্তপ্তন্দ্বস্তু প্ত্ত্রত্ব্প্সব্ভব্জগ্গ বেতন সাধারণ শ্রমিকদের ব্ভুব্দন্সন্প্তপ্তন্দ্ব প্ত্ত্রত্ব্প্সব্ভব্জগ্গ তুলনায় বেশী থাকবে৷ এই ব্যবস্থা এ জন্যেই রাখা হবে যাতে সব কর্মীই নিজেদের যথেষ্ট দক্ষ করে’ গড়ে’ তুলতে, ও কঠোর পরিশ্রম করতে উদ্যোগী হন৷ একজন শ্রমিক তাঁর দক্ষতা ও কাজের ভিত্তিতে যে বেতন পাবেন সেই বেতনের ভিত্তিতে তাঁর বোনাসের পরিমাণও নির্দ্ধারণ করা হবে৷

শিল্পে পিস–ওয়ার্ক ও ৰোনাস ব্যবস্থার সুযোগ চালু করে’ বা ক্ষাড়িয়ে শ্রমিকদের উৎসাহ যোগাতে হৰে৷ আর শিল্প–কারখানা ব্যাপারে শ্রমিকদের পরিচালন–সংক্রান্ত অধিকার সুস্পষ্টভাবে মেনে নিতে হৰে৷ এই দুই ব্যবস্থা কারখানার উৎপাদন ক্ষৃদ্ধি করবে, কারণ এই ব্যবস্থায় শ্রমিকরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার একটা তাগিদ অনুভব করবে৷ উৎপাদন ক্ষাড়ানোর জন্যে কেবলমাত্র গুরুগম্ভীর শব্দযুক্ত উপদেশই যথেষ্ট নয়৷ শ্রমিকরা অনুভব করুক যে, যতই কারখানা উৎপাদন ক্ষাড়িয়ে মুনাফা অর্জন করবে, ততই তাদের লভ্যাংশ বাড়বে৷

যান্ত্রিকীকরণ ঃ বিজ্ঞানের প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করতে হৰে৷ বস্তুতঃ উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার অর্থই দ্রুত যান্ত্রিকীকরণ৷ প্রাচীনপন্থীরা এই যান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুখর৷ মোদ্দা কথাটা এই যে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় যান্ত্রিকীকরণের অর্থই জনসাধারণের অধিকতর দুঃখ–অধিকতর বেকারী৷ এজন্যেই প্রাচীনপন্থীরা এর বিরোধী৷ পুঁজিবাদকে না চটিয়ে জনকল্যাণ করতে গেলে যান্ত্রিকীকরণের বিরোধিতা করতেই হৰে৷ কারণ যন্ত্রের উৎপাদিকা শক্তি দ্বিগুণ ৰেড়ে’ গেলে মনুষ্য শক্তির প্রয়োজন ঠিক অর্দ্ধেকে নেৰে’ যায়, আর তাই পুঁজিবাদীরা তখন ব্যাপকভাবে কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করে৷ উদ্বৃত্ত শ্রমজীবীরা অনাহার ও দারিদ্র্যের ফলে তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যায়৷ তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক চুরি–ডাকাতি, দুশ্চরিত্রতা ও বিভিন্ন ধরণের সমাজ–বিরোধী কার্যের সাহায্যে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করে৷ এ অবস্থাটা নিশ্চয় বাঞ্ছনীয় নয়৷ কিন্তু সামুহিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এজাতীয় প্রতিক্রিয়া ঘটবার অবসর নেই৷ সেখানে যান্ত্রিকীকরণের অর্থ কমশ্রম–বেশী স্বাচ্ছন্দ্য৷ যন্ত্রের উৎপাদিকা শক্তি দ্বিগুণ হয়ে গেলে শ্রমিকদের কাজের সময় ভ্রপ্সব্জন্সনুন্ধ ড়প্সব্ভব্জগ্গ অর্দ্ধেক হয়ে যাবে৷ অবশ্য কাজের সময় কমানো পণ্যের চাহিদা ও শ্রমশক্তির দিকে চেয়েই করতে হৰে৷

বিজ্ঞানের শুভপ্রয়োগের দ্বারা সামূহিক অর্থ–নৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের কল্যাণই হৰে৷ এমনও হতে পারে যে যান্ত্রিকীকরণের ফলে হপ্তায় পাঁচ মিনিটের ৰেশী কাউকে মেহন্নত করতে হৰে না৷ অন্নবস্ত্রের চিন্তায় সর্বদা ক্ষ্যস্ত থাকতে না হওয়ায় তার মানস তথা অধ্যাত্ম–সম্পদের অপচয়ও হৰে না৷ খেলা–ধূলা সাহিত্য–চর্চ্চা তথা অধ্যাত্ম– সাধনায় সে অনেক ৰেশী সময় ব্যয় করতে পারৰে৷