তন্ত্রের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

ক’দিন ধরেই আমি বলেছি ও বলে চলেছি যে তন্ত্রের একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রচলিত অন্য সব কিছু থেকেই আলাদা৷ আনন্দমার্গ যদিও মুখ্যতঃ তন্ত্রাশ্রয়ী কিন্তু আনন্দমার্গের আরও অনেকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ প্রথমতঃ আমি বলেছি, আমাদের আদর্শ অনুযায়ী কোন অবস্থাতেই কোন মানুষের ভয় পাবার কোন সঙ্গত কারণ নেই৷ তা সত্ত্বেও যদি কোন মানুষ ভয় পায়, বুঝতে হবে সে আদর্শবিরোধী কাজ করছে, যা তার করা উচিত নয় তেমন কাজ সে করছে৷ সুতরাং মনে রেখো, এমন কোন পরিস্থিতিই পৃথিবীতে আসতে পারে না যে পরিস্থিতিতে তোমাদের ভীত হবার দরকার পড়বে৷ বলা হয়েছে, পরমপুরুষ ভয়ের কাছেও ভয় অর্থাৎ মানুষ ভয়কে যেমনটি মনে করে, ভয় পরমপুরুষকে তেমনটি মনে করে৷ ‘ভীষণং ভীষণানাং’৷ ভীষণ বস্তুকে দেখে লোকে যেমন ঘাবড়ায় ভীষণ বস্তুও তেমনই পরমপুরুষকে দেখে ঘাবড়ায়৷ আর তোমরা সেই পরমপুরুষেরই সন্তান-সন্ততি৷ সুতরাং তোমরা ভয় পাবে কাকে? ভয় পাবেই বা কেন? ভয় পাবে কিসে?

পাপ সম্বন্ধে আরও বলছি যে, পথে চলতে গেলে জামা-কাপড়ে যেমন ধুলো লাগে পাপ তেমনই জিনিস, ঝেড়ে ফেলে দিলেই হ’ল৷ এতো সাধারণ মানুষের করণীয়৷ আর এ ব্যাপারে আনন্দমার্গের বক্তব্য হ’ল মানুষ পরমপুরুষের সন্তান, সবসময়ই সে পরমপুরুষের স্নেহের পাত্র৷ সে যত বড় পাপই করুক না কেন, স্নেহের পাত্রত্ব থেকে সে তো বিচ্যুত হচ্ছে না৷ পরমপুরুষ তাকে বকাঝকা করতে পারেন, শাসন করতে পারেন কিন্তু ঘৃণা করতে পারেন না৷ সুতরাং পরমপুরুষই তার কাপড় ঝেড়ে দিয়ে ধূলো ছেড়ে দিয়ে কোলে তুলে নেবেন সব সময়৷ প্রয়োজন হ’ল শরণাগতি৷ মনে রাখতে হবে, আমি পরমপুরুষের সন্তান--- এতটুকুই যথেষ্ট৷

এ সম্বন্ধে আরও একটা বিষয়ের স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন আছে যা পূর্বেকার অন্যান্য সমস্ত ধ্যান-ধারণা বিরোধী, যে ব্যাপারে আনন্দমার্গ অন্য সব কিছু থেকেই আলাদা৷ এযাবৎ যত মতবাদ, যত বিচারধারা এসেছে তা সব থেকে আলাদা৷ পুরানো স্পৃশ্যাস্পৃশ্য বিচারযুক্ত যে সমাজ ছিল, যারা ছোট-খাট সকল ব্যাপারেই মানুষকে কন্ডেম করতে চাইত,ধিক্কার দিতে চাইত, আমরা তা চাই না৷ আমাদের মতে যদি কোন অন্যায়ের ফলে সত্যিকারের ক্ষতি হয় ততটুকুই পাপ বলে গণ্য৷ তার বাইরে পাপ বলে গণ্য নয়৷ আগেকার দিনে সামান্য কোন সামাজিক অপরাধ হ’লে সমাজচ্যুত করা হ’ত, আমরা তা মনে করি না৷ আমরা মনে করি , ব্যষ্টিগতভাবে মানুষ যদি কোন অন্যায় করে যার ফলে সমাজের ক্ষতি হয়, সেটা পাপ বলে গণ্য--- অন্যথায় নয়৷

পুরোনো ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী মনের পাপও পাপ৷ মনে প্রথমে পাপ আসে, পরে সেই পাপটা কার্যরূপ পরিগ্রহ করে৷ পাপকেও পাপ বলে ধরা হত সবেতেই, এমনকি তন্ত্রের পুরোনো বিচারানুযায়ীও৷ আনন্দমার্গের মতে মনের পাপ যতক্ষণ বাহ্যিক রূপ না নিচ্ছে, অর নিয়ে সমাজের ক্ষতি না করছে, ততক্ষণ সমাজের চোখে মনের পাপ দণ্ডনীয় নয়৷ তবে সাধক মনের পাপকে সংশোধন করে নেবে কারণ মনের পাপই একদিন কার্য রূপ নিতে পারে৷ আর এই মনের পাপ থেকে যে পাপটা হ’ল মনের কোন অশুভ চিন্তার ফলে, সেই পাপের আমি একটা কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছি , আর তা’ হচ্ছে একবার মুখে উচ্চারণ করে ‘বাবা নাম কেবলম্’ বললেই হবে ৷ সুতরাং ওই চিন্তাটা কেন এসেছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি’’--- এই সব ভাবনার দরকার নেই৷ অর্থাৎ খোলা মন নিয়ে জগতে কর্ত্তব্য করতে থাকবে, নিজের কর্ত্তব্যের কথা ভাববে৷ আর কখন কোথায় পান থেকে কতখানি চুণ খসল, তা চিন্তা করে তোমাদের দামী সময় নষ্ট করবার কোন প্রয়োজন নেই৷ আমরা  সমস্ত সামর্থ্যকে, সমস্ত শক্তিকে সৎভাবে কাজে লাগানোই আমাদের কাজ৷ সুতরাং এই ধরনের চুলচেরা বিচার করে, মানুষের শক্তি-সামর্থ্যকে অবদমিত করে দেওয়া, থামিয়ে দেওয়া, তাকে সংকুচিত করে দেওয়া--- এই কাজগুলোকে আমি মানবোচিত কাজ বলে মনে করি না৷ আমি এও ভাল মনে করি না যে কেউ এককালে পাপী ছিল কিন্তু বর্ত্তমানে সে সৎকর্মে নেমেছে, আর এখনও তাকে ঘৃণা করব বা আড়ালে বলাবলি করব,‘‘ এই লোকটা এইরকম ইত্যাদি ইত্যাদি ’’--- একথাও ভুলে যেতে হবে৷ আমি গোড়াতেই বলেছি, পাপ হ’ল চলার পথে কাপড়ে লেগে যাওয়া ধুলো, তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে চলবে৷ আর যেখানে সমাজের ক্ষতি হয়েছে, সামাজিক বিচারে যে অপরাধী, তাকে তদনুযায়ী দণ্ড নিতে হবে, আর সমাজ যদি তাকে দণ্ড না দেয়, প্রাকৃতিক বিধানেই সে দণ্ড পাবে কিন্তু পরমপুরুষের কাছে কোন অবস্থাতেই সে ঘৃণিত বলে গণ্য হবে না৷ আমি ভাবব না যে আমি পাপী আর তাই আমি কি পরমপুরুষের কাছে যেতে পারব? বরং এইটাই ভাবা উচিত যেহেতু আমি পাপী, তাই আমার উচিত আরও তাড়াতাড়ি পরমপুরুষের কাছে চলে যাওয়া আর বলা ‘‘আমার কাপড়ে এত ধূলো লেগেছে আর এখনও তুমি আমাকে কোলে নিয়ে আমার কাপড়-চোপড় ঝেড়ে দাওনি কেন?’’--- এই বলে সে আবদার করবে যে কেন আমাকে এতদিন ধূলোয় রেখে দিয়েছিল৷

সুতরাং তোমরা জেনে রাখবে যে ব্যষ্টিগতভাবে তথাকথিত যে পাপই মনের মধ্যে করে থাক না কেন, একবার কীর্ত্তন করবে, তাতেই সেটা শেষ৷ আর এও মনে রাখবে বৈবহারিক জীবনে যে-কোনও পাপই করে থাক না কেন, সেজন্যে পরমপুরুষের চোখে তুমি ঘৃণ্য নও--- কোন অবস্থাতেই তুমি ঘৃণ্য হবে না৷ তিনি বকাঝকা করতে পারেন, তিনি শাসন করতে পারেন, কিন্তু ঘৃণা করতে পারেন না৷

অনেকবার বলেছি, পরমপুরুষের দু’টো কাজ করতে পারেন না৷ প্রথমতঃ, পরমপুরুষের সঙ্গে যার বেশী ভাব হয়ে গেছে সে তো পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে পরমপুরুষই হয়ে গেছে৷ সে তো পরমপুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে পরমপুরুষই হয়ে গেছে৷ সুতরাং দ্বিতীয় পরমপুরুষ আর হতে পারছে না৷ দ্বিতীয়তঃ পরমপুরুষ যতই চেষ্টা করুণ না কেন, কাউকে ঘৃণা করতে পারেন না কারণ সবকিছু তাঁর মনের মধ্যে ৷ কাউকে যদি ঘৃণা করতে চান , তবে ঘুরে ফিরে নিজেকেই ঘৃণা করতে হয়৷ তাই পরমপুরুষ চাইলেও ঘৃণা করতে পারেন না৷ এই কথাটা সব সময়েই মনে রাখবে৷

(১৪ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা)   (ইংরেজী থেকে অনূদিত)