‘কল্প’ শব্দের দু’টি অর্থ---প্রথমটি ‘কালাকালবিনিশ্চয়’, দ্বিতীয়টি ‘ভাবাধিকরণবিনিশ্চয়্’৷
‘ব্যাকরণ মানে কোন্ শব্দের কীভাবে ব্যবহার-নিষ্পত্তি তথা উচ্চারণ- নিষ্পত্তি ঘটাতে হয় তারই বিজ্ঞান৷ ব্যাকরণ জ্ঞান না থাকলে মন্ত্রোচ্চারণ যথাযথভাবে হতে পারে না৷‘নিরুক্ত’ মানে যা ৰলা হয়েছে তৎসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান৷ ঠিক অভিধান নয়, কতকটা এনসাইক্লোপিডিয়া (জ্ঞানকোষ) জাতের জিনিস৷ প্রাচীন বৈদিক যুগে অক্ষরজ্ঞান না থাকায় ভাষার কোন লেখ্য রূপ ছিল না৷ যে কোনো পুরোনো ভাষার শব্দটি দীর্ঘ কালব্যবচ্ছেদে লোকের মন থেকে সরে যেত৷ লোকে তার অর্থ ভুলে যেত৷ তাই বিভিন্ন শব্দের অর্থ ও অন্যান্য বিশদ বিবরণ লোকে যাতে না ভোলে সেইজন্যে একটি মৌখিক শাস্ত্র (অক্ষর আবিষৃকত হবার পর এটি লিখিত শাস্ত্রের
রূপ নিয়েছিল) তৈরী হয়েছিল৷ সেই শাস্ত্রটিরই নাম ‘নিরুক্ত’৷ নিরুক্তের জ্ঞান না থাকলে মস্ত্রোচ্চারণ অর্থহীন হয়ে যায় ও তা ফলদানে অসমর্থ হয়৷ তাই মন্ত্রোচ্চারণ কালে নিরুক্তের জ্ঞানও অপরিহার্য ছিল৷
প্রথমটায় দেখা গেছল যে কোন ব্যাধি থাকলে মন্ত্রোচ্চারণ যথাযথ ভাবে করা যায় না৷ তাই সেখানকার মানুষ মন্ত্রোচ্চারণের পূর্বে ব্যাধি নিরাময়ের ব্যবস্থা নিত ও ওইভাবেই তৈরী হয়েছিল ‘আয়ুর্বেদ’ (আয়ু+বেদ)৷ ‘আয়ু’ মানে ‘জীবনকাল’ (life time or longevity)/ প্রাণশক্তি (vitaly)/বয়স (age)৷ অনেক পণ্ডিতের মতে ‘আয়ুর্বেদ’ নয়, এটি হচ্ছে ‘ধনুর্বেদ’ (ধনু+বেদ)৷ সেকালে যজ্ঞকােেল অসুর বা অনার্যরা অনেক সময় যজ্ঞস্থলী আক্রমণ করত৷ আর্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভাল ছিল না বা ভাল থাকত না৷ তারা ভাবত, আর্যরা যে সময় যজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেটাই তাদের ওপর আক্রমণের প্রকৃষ্ট সময়৷ তাই তারা সাধারণতঃ সেই সময়ে আক্রমণ করত৷ সেইজন্যে আর্যরা যজ্ঞ করবার সময় ধনুর্বেদেরও (অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার) তালিম নিয়ে নিতেন ও দিয়ে দিতেন৷
অনেকের মতে ধনুর্বেদ মানে অস্ত্রশস্ত্র চর্চা নয়, ধনুর্বেদ মানে ‘রণনীতি’ (strategy) প্রশিক্ষণ ৷ ধনুর্বেদ সম্বন্ধে কেউ কেউ ৰলেন, এটি ছিল বৈবহারিক বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ৷
জ্যোতিষের কথা তো একটু আগেই বললুম৷ এই ছন্দ-কল্প-ব্যাকরণ-নিরুক্ত- অয়ুর্বেদ /ধনুর্বেদ - জ্যোতিষ - - এই ছ’য়ের মিলিত নাম ছিল ‘বেদাঙ্গ’৷ এই ষড় বেদাঙ্গে যিনি পারদর্শী হতেন তাঁকে ৰলা হত ষট্+ অঙ্গ = ষড়ঙ্গী৷
যাই হোক কর্মকাণ্ডের মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের কথা কিছুটা ৰললুম৷ ৰাকি অংশ হচ্ছে ‘জ্ঞানকাণ্ড’৷ জ্ঞানকাণ্ডের দর্শন (প্রাচীনকালে দর্শন অর্থাৎ Philosophy-কে ‘অভিধর্ম’ ৰলা হত---প্রাকৃতে ‘অভিধর্ম’)-অংশকে ‘আরণ্যক’ ৰলা হত৷ প্রাচীন মুনি-ঋষিরা উপৰনে বা অরণ্যে বসে যে শাস্ত্র রচনা করেছিলেন তাকে ৰলা হত ‘আরণ্যক’৷ যজ্ঞাগ্ণি প্রজ্বলিত রাখবার জন্যে যে কাষ্ঠ (জ্বালানি কাঠ বা লাকড়ি বা খড়ি) ব্যবহৃত হত বৈদিক ভাষায় তাকে ৰলা হত ‘অরণি’৷ ‘অরণি’ যেখানে পাওয়া যেত তাকে ৰলা হত ‘অরণ্য’৷ অরণ্য ঠক্ করে ‘আরণ্যক’ শব্দ পাচ্ছি৷ অরণ্যে রচিত এই অর্থে ‘আরণ্যক’৷ এই আরণ্যক ছিল সম্পূর্ণভাবে সৈদ্ধান্তিক জিনিস (Theoretical)৷ এই সৈদ্ধান্তিক তত্ত্বের সঙ্গে বৈবহারিক জীবনের সমন্বয় ঘটাবার প্রয়াসে যে শাস্ত্র রচিত করা হত সেই শাস্ত্র সম্বন্ধেই বলতে পারি যে সে মানুষকে পরমপুরুষের কাছাকাছি ভালভাবে পৌছে দেবার চেষ্টা করেছিল৷ তাই জ্ঞানকাণ্ডের এই অংশটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উপনিষদ’৷ (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের লঘুনিরক্ত থেকে সংগৃহীত)