যোগের সংজ্ঞা, তাৎপর্য ও লক্ষ্য

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

প্রশ্ণ হচ্ছে–যোগ কী? এখন যোগ সম্বন্ধে এ যাবৎ অজস্র ব্যাখ্যা, অজস্র টীকা–টিপ্পনী প্রচলিত রয়েছে৷ মহান্ দার্শনিক পতঞ্জলির মতে, ‘যোগশ্চিত্ত–বৃত্তিনিরোধঃ’৷ সংস্কৃত ‘যুন্জ্’ ধাতুর উত্তর ‘ঘঙ্’ প্রত্যয় যোগ করে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে৷ ‘যুন্জ্’ ধাতুর মানে যোগ করা, To add. যেমন– ২ + ২ = ৪৷ এটা যোগ করা হ’ল৷ যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’ – পতঞ্জলি প্রদত্ত যোগের এই সংজ্ঞার সাথে যোগ বা addition–এর কোনো সম্পর্ক নেই৷

মানুষের মনে কতকগুলো বৃত্তি রয়েছে৷ সাধারণ অবস্থায় বৃত্তির সংখ্যা ৫০৷ প্রতিটি বৃত্তির আবার তারঙ্গিক অস্তিত্বও রয়েছে৷ বৈদিক বর্ণমালায় এই পঞ্চাশটি বৃত্তির, তারঙ্গিক অভিপ্রকাশের জন্যে পঞ্চাশটি বর্ণ, রয়েছে প্রথম বর্ণ ‘অ’ থেকে পঞ্চাশতম বর্ণ ‘ক্ষ’ পর্যন্ত৷ তন্ত্রে এদের যৌথভাবে বলা হয় অক্ষমালা৷ প্রতিটি অভিপ্রকাশের জন্যে  রয়েছে পঞ্চাশটি বর্ণ, রয়েছে প্রথম বর্ণ ‘অ’ থেকে পঞ্চাশতম বর্ণ ‘ক্ষ’ পর্যন্ত৷ তন্ত্রে এদের যৌথভাবে বলা হয় অক্ষমালা৷ প্রতিটি অভিপ্রকাশের জন্যে রয়েছে পৃথক পৃথক বীজমন্ত্র, পৃথক পৃথক রঙ৷  যেখানে তরঙ্গ আছে সেখানে শব্দও আছে, বর্ণও আছে৷ তাই ওই পঞ্চাশটি অক্ষরকে কেবল অক্ষমালাই নয়, বর্ণমালাও বলা হয়৷ অর্থাৎ ওগুলো পঞ্চাশটি বর্ণের সমাহার৷ এখন কতকগুলো বৃত্তির নিরোধের ক্ষেত্রে কোনো বীজমন্ত্রের প্রকাশ নেই বা কোনো প্রকার বর্ণেরও তন্মাত্রিক অভিব্যক্তি নেই৷ যোগের মানে কেবল addition-–ই বোঝায় না৷ এর একটা সূক্ষ্ম অর্থও আছে৷ সেই অর্থটাই সূচিত হয় ‘যুন্জ্’ ধাতুর উত্তর ঘঙ্ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন যোগ শব্দের দ্বারা৷ ‘যুন্জ্ + ঘঙ্, যুজ্ + ঘঙ্ নয়৷ সেক্ষেত্রে যোগ মানে addition বোঝায় না৷ বোঝায় unification.

‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’–এই সংজ্ঞায় যোগের যা অর্থ সেটা addition–ও নয় আবার unification নয়৷ ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’ মানে মানসিক বৃত্তিগুলোর নিরোধঃ (suspension of mental propensities)৷ স্বাভাবিক অবস্থায় মনের পঞ্চাশটি বৃত্তি আর অস্বাভাবিক অবস্থায় এক হাজার বৃত্তি৷ এখন এই সমুদয় বৃত্তিগুলোই যখন নিরুদ্ধ হয়ে পড়ে, তখনকার অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়?–না, তখন কোনো বীজমন্ত্রের ধ্বনিময় জগৎ বা বর্ণময় জগৎ থাকে না৷ শুধু তাই নয়, মানসিক বৃত্তির অভাবে কারুর সাথে ‘এক’ হবার ইচ্ছাটাও, এষণাটাও লুপ্ত হয়ে যায়৷ তাই যোগের এই সংজ্ঞাটা সমর্থনযোগ্য নয়৷ তাই গ্রহণযোগ্যও নয়৷ ব্যাখ্যাটা অবশ্যই ত্রুটিযুক্ত, কোনো আধ্যাত্মিক সাধক যোগের এ ধরনের ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেন না৷

আবার অন্যান্য কোনো কোনো যোগীদের মতে ‘চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’ আসল যোগ নয়, ‘সর্বচিন্তা পরিত্যাগঃ নিশ্চিন্তো যোগ উচ্যতে’–অর্থাৎ মানুষ যেখানে সমস্ত প্রকার চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত বা চিন্তামুক্ত হতে পেরেছে, সেটাই হ’ল যোগের চরম অবস্থা৷ চিন্তা নেই মানে মনের ধারাবাহিকতা যেখানে শেষ হয়ে গিয়েছে অর্থাৎ মন যেখানে গতিহীন, নিশ্চল হয়ে পড়েছে৷ মনের যেখানে স্থিরভাব, একটা স্বস্তির ভাব  (a state of composure) বিরাজ করছে, সেটাই মনের নিশ্চিন্ত অবস্থা৷ এখানেও ‘যোগ’ অর্থে addition বা unification কিছুই বোঝায় না৷ ‘সর্বচিন্তা পরিত্যাগঃ নিশ্চিন্তো’ মনের ধর্ম নয়৷

এই পরিদৃশ্যমান জগতে, এই বিশ্ব প্রপঞ্চে সবকিছুই চলছে–চলবে৷ মনও চলছে৷ মন তিনটে মূল আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে–দেশ, কাল, পাত্র৷ কাজেই গতিশীলতা এর মুখ্য ধর্ম৷ কাজেই যে সত্তা গতিশীলতার বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট তার গতি, তার ধারাবাহিকতাকে কী করে ক্ষুণ্ণ করা যায়? এমনকি, পরমপুরুষের যে ব্যক্তরূপ সেখানেও রয়েছে গতিশীলতা, প্রবহমানতা, রয়েছে ভালবাসা–অনুকম্পা৷ কাজেই ভূমামনে যেখানে স্নেহ–নুকম্পার অবিরল ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে, তখন অণুমনেই বা প্রবহমানতা থাকবে না কেন? কাজেই যোগের এই সংজ্ঞাটাও বর্জনযোগ্য, গ্রহণযোগ্য নয়৷ হতে পারে, রোগ বা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মানুষের মনে সাময়িকভাবে চিন্তা করা বন্ধ  হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেটা তো মনের স্বাভাবিক অবস্থা নয়, সেটা মনের রুগ্ণাবস্থা৷ যখন রোগগ্রস্ত হয়ে, দুর্বল হয়ে, শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকো, তখন কি আর মানস বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাও? ঘামাও না তো৷ তাই ওটাকে যোগ বলে না৷

বিশ্বচরাচরের প্রতি পরমপুরুষের এই স্নেহ–অনুকম্পার অবিরাম ঝর্ণাধারার প্রবহমানতার জন্যেই তাঁকে বলা হয় ‘রসো বৈ সঃ’, তিনি রসঘন সত্তা, তিনি রসময়, রসসাগর৷ প্রতিটি জীব, প্রতিটি জৈব ও অজৈব সত্তা তাঁরই রসধারায় ভেসে চলেছে, আনন্দ নৃত্য করে চলেছে এইটাই পরমপুরুষের রাসলীলা৷ কাজেই মানুষের মনে চিন্তা–হীনতা আসবে কী করে মন চিন্তা–মুক্ত হবে কী করে? তাই যোগের এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটাও মূলগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ৷ আধ্যাত্মিক সাধক তো এ ধরনের ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেন না৷

তাহলে যোগের আসল সংজ্ঞাটি কী? আধ্যাত্মিক সাধকদের এ বিষয়ে বক্তব্যটা কী? ভক্তের ভাষায় যোগ হ’ল [ও যোগের তান্ত্রিক ব্যাখ্যায়] ঃ ‘সংযোগো যোগ ইত্যুক্তঃ জীবাত্মা–পরমাত্মনঃ’৷ অর্থাৎ অণুচৈতন্যের সঙ্গে ভূমাচৈতন্যের, জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযুক্তিকে যোগ বলা হয়৷ এখানে addition অর্থে যুজ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন যোগ শব্দটার যদি আক্ষরিক অর্থ নিই [সংযুক্তির অর্থে] তবেই আধ্যাত্মিক যোগের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, আবার ‘যুনজ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন যোগ শব্দটার অর্থটাও তাই৷ উভয়ক্ষেত্রেই অণুসত্তা ভূমাসত্তার সাথে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এখানে যোগের শেষ স্তরে সাধক যখন তার ধ্যেয়তে মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে, তার বিকল্প কোনো অস্তিত্ব থাকছে না, তখন সে তো পরমপুরুষের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেল–যেমন চিনি আর জল মিশে সরবৎ হয়ে যায়৷

তাহলে দেখছি, ভক্তেরা বা আধ্যাত্মিক সাধকেরা যোগের যে ব্যাখ্যাটা দেন, সেটাই গ্রহণযোগ্য পাতঞ্জল যোগ বা সাংখ্যশাস্ত্রের অনুগামীরা যে ব্যাখ্যাটা দেন তা যুক্তিসঙ্গত নয়, তা ত্রুটিপূর্ণ, এজন্যে গ্রহণযোগ্য নয়৷ addition বা unification বলতে যাই বোঝাক না কেন, তাতে দু’টো সত্তার উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে–ভক্ত ও ভগবান৷ কিন্তু প্রথম ব্যাখ্যাটায় দু’টো সত্তা থাকছে না৷ তাই যোগ বা সংযোগ যে হবে, সেটা কার সঙ্গে কার যোগ, কেই বা যোগাযোগটা ঘটাবে–এ সবের কোনো পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা নেই৷