১৯ শে' মে র একাদশ বাংলা ভাষা শহীদ স্মরণে ...

লেখক
তপোময় বিশ্বাস 

১৯ শে মে' দিনটির ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের ততটা ঠিক পরিচিত হয়ে ওঠা হয়নি যতটা হয়েছে '২১ শে ফেব্রুয়ারী' সঙ্গে। ঠিক করে বলতে গেলে  ১৯ শে মে' দিনটির তাৎপর্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের পরিচিত হওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি। নয়ের দশকের শেষের দিকে রাষ্ট্রসংঘ ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত করার আগে এই দিনটি নিয়েও সামগ্রিক বাঙালী জনগোষ্ঠী খুব একটা মাতামাতি করতো না। যেমন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে অবধি রবি ঠাকুর গুটি কয়েকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন,ঠিক তেমন ২১ শে ফেব্রুয়ারীও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হওয়ার আগে অবধি গুটি কয়েক বাঙালী সংগঠনের পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

১৯ শে মে ' সমগ্র  বাঙালী জনগোষ্ঠীর জন্য এক গৌরবের দিন, নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন। ১৯ শে মে ১৯৬১, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে অসমের শিলচরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী,  উগ্র বাঙালী বিদ্বেষী বিমলা প্রসাদ চালিহার নেতৃত্বে পুলিশের গুলিতে নির্দোষ একাদশ বাঙালী তরুণ-তরুণী প্রাণ বিসর্জন দেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম বাঙালী মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য। এছাড়াও বাকী আত্মবলিদানকারীরা যথাক্রমে,কানাইলাল নিয়োগী, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, হীতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ,শচীন্দ্র পাল, চন্ডীচরণ সূত্রধর,কুমুদরঞ্জন দাস,সতেন্দ্র দেব,বীরেন্দ্র সূত্রধর। তাঁদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি।

          অসমের বরাক উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীরা হওয়ার সত্ত্বেও  ভাষা বিলের(১৯৬০) মাধ্যমে বাঙালীদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে সংকুচিত করে,কেঁড়ে নিয়ে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ের দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার 'শিলচর' স্টেশনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন চলার সময়ে ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে, তৎকালীন অসমের বাঙালী বিদ্বেষী মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিনা প্ররোচনায় বিক্ষোভকারীদের উপর নির্বিচারে, নির্মমভাবে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে বাল্যকাল পেরিয়ে সদ্য কৌশরে পা দেওয়া কমলা ভট্টাচার্যের নিথর দেহ মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।  প্রথম মহিলা বাংলা ভাষা শহীদ হিসেবে বাঙালীদের হৃদয়ে চিরঅমর থাকবেন তিনি। এছাড়াও আরো দশ জন নিহত এবং প্রচুর সংখ্যক বিক্ষোভকারী আহত হন। সেই ঘটনার দিন অসমেরই 'গুয়াহাটি' তে ছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। বাংলা ভাষার সন্মান রক্ষার্থে  প্রাণ বিসর্জনকারী একাদশ আত্মবলিদানকারীদের পরিবারের প্রতি সামান্য সমবেদনা জানানো তো দূরে থাক, বরঞ্চ তাদের প্রতি কটূক্তি করছিলেন। সেই একাদশ বাংলা ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে  পরবর্তীতে অসম সরকার বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।

     আজকেও অসমে বাংলা ও বাঙালী বিদ্বেষী চক্রান্ত অব্যাহত। প্রতিনিয়ত বাঙালীদের বিদেশী,বাংলাদেশী,ঘুসপেটিয়া ইত্যাদি বলে অপমান করা চলছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে দুভাবেই। ২০১৮ র পর থেকে এন আর সি, বিনাদোষে ডিটেনশনক্যাম্প নামক জেলখানায় থাকার ভয়ে শতাধিক বাঙালী আত্মহত্যা কিংবা ভয়ে আতঙ্কে মারা গেছে। অসমের বাংলা মাধ্যম স্কুল গুলোকে বন্ধ করা বা অসমীয়া মাধ্যমে রূপান্তরিত করার কাজ হামেশাই হয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে রঙ্গিয়ায় ৭৩ বছরের পুরনো ঐতিহ্যশালী বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে অসমীয়া মাধ্যমে রূপান্তরিত করার নোটিশ জারি হয়েছে। গুয়াহাটির পল্টন বাজারের শতাব্দী প্রাচীন বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় টিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবে সত্য অসমে বাঙালীরা অনুপ্রবেশকারী নয়, ১৮৭৪ সালে বৃহত্তর বঙ্গপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত অবিভক্ত গোয়ালপাড়া ও কাছাড় জেলাকে কেটে অসম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার। অসমে বাঙালীরা ভূমিপুত্র, বহিরাগত নয়। এই ঐতিহাসিক সত্য মানুষের থেকে লুকিয়ে  রাজনৈতিক দল গুলি ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে, রাজত্ব কায়েম রাখতে বাঙালী অসমিয়াদের মধ্যে দলাদলিতে বিভক্ত করে বিচ্ছিন্নত করে রাখার কুমতলব করে চলেছে।এর বিরুদ্ধে সজাগ থাকা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের বাঙালী তরুণ তরুণীদের একান্ত কাম্য। আমরা অসমীয়াদের উপর যেমন আধিপত্য বিস্তার করতে যাব না, ঠিক তেমনি তাদেরকেও আমাদের বাঙালীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে দেব না। বরাকের বাঙালীদের কাছে ১৯ শে মে', নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ঘরে ঘরে প্রস্তুত হওয়ার দিন। "চরিদিকে নাগিনীরা ফেলছে বিশাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী আজ ব্যর্থ পরিহাস" লড়াই চাই, লড়াই। শুধু অসম নয় পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড,ত্রিপুরা ইত্যাদি বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার হিংস্র দাঁত নখ বের করে ফেলেছে। তীব্র ভাবে মানস -অর্থনৈতিক শোষণ চলছে, পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করতে গেলে নাকি হিন্দী জানতে হবে, হিন্দি না জানা থাকলে কাজ মিলবে না ! ঝাড়খণ্ডের ৭৫% মানুষ বাংলা ভাষী হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার সমস্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় গুলিকে বন্ধ করে দিয়ে  তাদের হিন্দীভাষীদের দাসের পরিণত করার চেষ্টা চলছে। ত্রিপুরাতেও একই অবস্থা। বরাক তথা ভারতের সমস্ত বাঙালী অধ্যুষিত এলাকার বাঙালীদের শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। এই ১৯ শে মে' একাদশ বাংলা ভাষা শহীদ দিবসে সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীর কাছে আহ্বান রাখছি-  সরকারি বেসরকারি সমস্ত কাজে বাংলা ভাষায় স্বাক্ষর করুন। বাঙলার অফিস, আদালত, রেলস্টেশন, নামের ফলক, রসিদ বই সর্বত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক করার দাবী দিকে দিকে ধ্বনিত হোক। বাঙালী সমাজের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠা পাক বাংলা ভাষা। ১৯ শে মে' র একাদশ বাংলা ভাষা শহীদ আমরা তোমাদের ভুলছি না ভুলব না।