আবার বাঙলা ভাগের ঘৃণ্য চক্রান্ত

লেখক
একর্ষি

বাঙালীর ভাগ্যে সর্বনাশের ভয়াবহ অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে চলেছে৷ বাঙলার  ঘাড়ে আবার বাঙলা ভাগের খাঁড়া ঝুলছে! যেকোনো মূহূর্তে কোপ পড়তে পারে! দেশী বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা নাা অছিলায় বার বার সোনার বাঙলার বুকে ছুরি চালিয়েছে, দফায় দফায় সোনার বাঙলাকে টুকরো টুকরো করেছে৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের এই বাঙলা ভাগের উদ্দেশ্য ছিল.... বাঙলাকে ভেঙে বাঙালী ঐক্যশক্তি ধবংস করা তথা জনসংখ্যা লোকবল কমিয়ে দিয়ে বাঙালীকে সংখ্যা লঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা, বাঙলার বহু হাজার বছরের দৃঢ় স্বয়ম্ভর অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে ধবংস করে বাঙালীকে মাথার কাজ ছেড়ে পেটের-চিন্তায় ভাতের-চিন্তায় ডুবিয়ে দেয়া, বাঙালীর ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক ঐতিহ্য ধবংস করে বাঙলীর  জাতিকসত্তাকে মুছে দেয়া অর্থাৎ বাঙ্গালীত্ব- বাঙালীয়ানা-বাঙালী, পরিচয় ভুলিয়ে দেয়া মুছে দেয়া,আর এসব করে বাঙালীর প্রতিবাদী-প্রতিস্পর্দ্ধী-ক্ষাত্রশক্তি-বিপ্লবী চেতনা-চরিত্র ধবংস করা৷ এত কিছুর পিছনে মূল লক্ষ্যটা ছিল বল্গাহীন চিরস্থায়ী শোষণের পথ খুলে দেয়া ও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষাৎ বড়-বিপদ ও শোষণযন্ত্রের সামনের বড় শক্ত কাঁটাটা উপড়ে ফেলা৷ ব্রিটিশ সামনে রেখেছিল লোকদেখানো মনভোলানো তত্ত্ব--- শাসনকার্যের সুবিধা, সরকারে রাজস্ব বৃদ্ধি৷ কিন্তু ব্রিটিশ গেলেও স্বাধীনতা লাভের দিন থেকেই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ ব্রিটিশের পথেই হেঁটেছে ও হাঁটছে৷ ব্রিটিশের বাঙালী বিদ্বেষ ---বাঙালীকে শেষ করার নীতিটা একইভাবে বহাল আছে৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও খণ্ডবিখণ্ড  উত্তরবঙ্গ, খণ্ডবিখণ্ড রাঢ়বঙ্গকেও বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তটা সেই একই  ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে  তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ৷ বর্তমান ভারতবর্ষে অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তো খণ্ড-খণ্ড ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সাবেক অখণ্ড বাঙলারই একমাত্র বাঙলা নামধারী ক্ষুদ্র অংশ৷ (প্রায় পাঁচ লক্ষ বর্গ কিমির মধ্যে মাত্র ৮৭, ৮৮৭ বর্গ কিমি)৷ নোতুন করে একেও টুকরো টুকরো করে ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে মুছে দিয়ে বাঙালী জাতটাকেই ধবংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে৷

কিন্তু যে পঞ্চগৌড় অখণ্ডবাঙলা কবিগুরুর সোনার বাঙলা নিয়ে এত কথা সেই সোনার বাঙলা এখন কোথায়? সে সন্ধানটা কি নিতে হবে না?

১৮৭২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতে অখণ্ড সোনার বাঙলার ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক মানচিত্র মোটামুটি অটুট ছিল৷ কিন্তু এখন সেই বাঙলা যা হয়েছে ---১) পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গ রাজ্য,২) বাঙলাদেশ---স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, ৩) ত্রিপুরা--- অঙ্গরাজ্য, ৪) অঙ্গ রাজ্য ঝাড়খণ্ডের ১৮টি জেলার ১১টিই সাবেক বাঙলার, ৫) বিহারে  বাঙলার অংশ, ৬) ওড়িষায় বাঙলার অংশ, ৭) অসমে বাঙলার অংশ,৮) স্বতন্ত্র রাষ্ট্র মায়ানমারে বাঙলার অংশ,৯) মিজোরামে বাঙলার অংশ,১০) মণিপুরে বাঙলার অংশ,১১)স্বতন্ত্র রাষ্ট্র নেপালে বাঙলার অংশ ১২) মেঘালয়ে বাঙলার অংশ,১৩) (ভৌগোলিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক নিয়মে) কেন্দ্রশাসিত আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ বাঙলারই৷ ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গ শুরু করে ১৮৭৪ সালে, তারপর ক্রমান্বয়ে নানা  অছিলায় খণ্ডীকরণ চলে ১৮৭৮, ১৯০৫,১৯১১,১৯১২, ১৯৪৭,১৯৫৫, ১৯৫৬ সালে৷ অথচ তথাকথিত বঙ্গপ্রেমীরা রুখছি-রুখব বলে চিৎকার করে বাজার গরম করলেও বাঙালীর সার্বিক কল্যাণে তথা বাঙলার স্বয়ম্ভব-সম্তুলিত অর্থনীতির স্বার্থে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করে বাঙালীর অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিষ্ময়করভাবে নীরব৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় আর নেই৷

লক্ষ্যনীয়, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভাগ উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত---যা স্বাভাবিকভাবেই সুপরিচিত বরেন্দ্রভূমিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশেষ, বাকী অংশ আছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ও রাষ্ট্রগুলোতে৷ এককালে সব অংশগুলো নিয়েই ছিল প্রাচীন সুবিখ্যাত কামতাপুর রাজ্য, কখনো বা তার নাম হয়েছে কোচবিহার রাজ্য  যা (চৌহদ্দি) একদিকে ব্রহ্মসীমান্ত, অন্যদিকে ময়মনসিংহের ঘোড়াঘাটা আর একদিকে তরহূত পর্যন্ত  বিস্তৃত ছিল৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় অধুনা খণ্ডিত অবস্থায়ও বাঙালী বিদ্বেষী শোষকগোষ্ঠী উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্রদের জাতিসত্তা, মুখের ভাষা ইতিহাস ও সামাজিক ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে ভুল বুঝিয়ে  বিভ্রান্ত করছে, উন্নয়ণের ‘টোপ’ দিয়ে ঝুরি ঝুরি  মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে--- যা উত্তরবঙ্গের মানুষের পক্ষে জাতিসত্তাঘাতী কালিদাসী মরণফাঁস হয়ে দাঁড়াবে৷ বরেন্দ্রবঙ্গের  ভূমিপুত্ররা আত্মঘাতী মরণ ফাঁসে ছটফট করবে আর সেই ফাঁকে উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যরাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেবে কিংবা খোদ পশ্চিমবাঙলার বুকেই নোতুন রাজ্য বানিয়ে বাঙালীর আতিথেয়তায়  উদারতা-আশ্রিত বহিরাগত বিদেশী বিশ্বাসঘাতকদের উপঢৌকন দিয়ে অবাধ শোষণ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেবে---যা অতীতে বহুবার হয়েছে৷ ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়! হিন্দীসাম্রাজ্যবাদের বাদামী পুঁজিপতিদের বঙ্গভঙ্গের এ এক নোতুন খেলা!                                      (ক্রমশঃ)