আবার বাঙলা ভাগের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

গৌড় ও তার পাঁচটি ভাগের নামকরণেরও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে৷ প্রথমে আসা যাক গৌড় নামকরণে৷ বাঙলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নাম হচ্ছে গৌড়দেশ৷ এককালে  এইদেশ গুড় উৎপাদনে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল৷ তাই এই দেশকে নাম দেওয়া হয়েছিল গৌড়৷ কতরকমের  গুড়ই না এদেশে তৈরী হ’ত!--- আখের গুড়, খেজুর গুড়,   তালের গুড়, নারকোল গুড়, গোল গুড়, (গোল গাছের রস থেকে তৈরী), শাঁকালু গুড়, মহুলা ফুলের গুড়৷ শুধু গুড় নয়,  পাটাশ্যাওলার সাহায্যে নানা ধরণের ও মানের চীনীও তৈরী হ’ত৷ বিশ্বের বাজারে বিভিন্ন গুড় থেকে তৈরী চীনী, পাটালী বা নবাতের চাহিদাও ছিল খুব৷ আবার পঞ্চগৌড়ের আর এক নামছিল ‘পুণ্ড্রু’৷ পুণ্ড্রু মানে হচ্ছে ইক্ষু, বিশিষ্টার্থে ইক্ষু উৎপাদক  দেশ, জনগোষ্ঠী, ‘পৌণ্ড্র’৷ তাই প্রাচীন বাঙলাকে পুণ্ড্রুভূমি বা পৌণ্ড্রবর্ধনও বলা হ’ত৷ থাক সে কথা , প্রথমে পঞ্চগৌড়ের একটা খসড়া চিত্র দেখা যাক৷

১. ‘রাঢ়বঙ্গ’---পঞ্চগৌড়ের প্রথম গৌড় হচ্ছে রাঢ়৷ প্রাগৈতিহাসিক  কাল থেকেইে রাঢ় বাঙলার প্রাকৃতিক চোহদ্দি হচ্ছে--- পশ্চিমে বিন্ধ্যপর্বতের শাখা রামগড়পাহাড়-শৈলময় অরণ্যম্য মালভূমি অঞ্চল ও গঙ্গা পদ্মা-ভাগীরথী-হুগলী-বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত ভূভাগ৷ ‘রাঢ়’ কথাটির মানে হল ---১) রক্তমৃত্তিকার দেশ, তার মানে  হল সবচেয়ে প্রাচীন শিলা অর্থাৎ গ্রানাইট শিলা গঠিত ভূভাগ৷ গ্রানাইট শিলা ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ল্যাটারাইট মৃত্তিকা হয় লালচে (লৌহ আকরিক থাকায় কারণে)৷

২) রাঢ় কথাটির বিশিষ্টার্থে আর একটি অর্থ হচ্ছে সৌন্দর্য ও বৈভব৷ এক কালে সাল-মহুয়া-পলাশাদির অরণ্যশোভিত গিরি-ঝর্ণা-ঝোরা-নদীউপতক্যা খচিত রাঢ় বাঙলা ছিল অতুলনীয় সৌন্দর্যের ভূস্বর্গ৷ আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক  সম্পদে প্রকৃতির অমেয় কৃপাধন্য রাঢ় ! খনিজ-বনজ-প্রাণিজ-কৃষিজ সব সম্পদেরই সহাবস্থান ছিল রাঢ়ের মাটিতে ৷ তাই সৌন্দর্য-বৈভবের রানী--- বাঙলার  এই অঞ্চলটির  নাম  দেওয়া হয়েছিল রাঢ়৷

২) বরেন্দ্রভূমি এই নামকরণে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য - (অ)  বরেন্দ্র --- বর+ ইন্দ্র৷ আবার --- ব+অ, ও ইন্দ্র--- ইন্দ্‌+ রক্‌ ৷ অর্থাৎ ‘বৃ’ ধাতু সঙ্গে ‘অ’ প্রত্যয় যোগে হয় ‘বর’৷ বর মানে শ্রেষ্ঠ বা বরন করা, বা শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করা৷ আর সংস্কৃত ‘ইন্দ্র’ শব্দটিরও শ্রেষ্ঠ৷ তাহলে বরেন্দ্র পদটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়াল শ্রেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ৷ আসলে বাঙলার উত্তরাংশ যা গঙ্গা বা পদ্মানদীর বাম তীরে অবস্থিত তা একদিন জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, ধর্মে, ত্যাগে, তিতিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব  অর্জন করেছিল৷ তাই প্রয়োগগত অর্থে বা ব্যবহারিক অর্থে অসাধারণ-অতুলনীয়-অভাবনীয় এই বৈশিষ্ট্যের জন্য এই ভূখণ্ডের নাম রাখা হয়েছিল ‘বরেন্দ্র’৷ আ) দ্বিতীয় অর্থ--- প্রাচীন অনার্য বাঙলায় ‘বরিন্দ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কৃষিযোগ্য  ভাল জমি৷ ভৌগোলিক দিক থেকে এখান কার জমি তিন ভাগে বিভক্ত---১) জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণের কিছু অংশ, কোচবিহার জেলার বেশির ভাগ অংশ ও মালদহ জেলার কালিন্দী ও মহানন্দা নদীর নিচু ভূমি ‘তাল’ নামে পরিচিত৷ এখানে বহু বিল ও জলাভূমি আছে৷ এই অঞ্চল ‘তাল’ নামে পরিচিত৷

২) দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পূর্র্বংশ ও মালদহ জেলার পূর্বাংশের ভূমি সামান্য উঁচু-নীচু ও প্রাচীন পলিতে গঠিত--- এই অংশের নাম ‘বারিন্দ’৷ (৩) যে অংশ গঙ্গা বা পদ্মার গর্ভ থেকে উত্থিত ও নবিনপলি দ্বারা গঠিত অঞ্চল সে অংশের নাম ‘দীয়ারা’ (চর)৷ এই কারণে ভূমি ও মৃত্তিকার চরিত্র বৈশিষ্ট্য স্মরণাতীত কাল থেকেই বরেন্দ্রভূমি সামগ্রিকভাবে একটি কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল৷ তাই হয়তো বাঙলার উত্তরাংশকে ‘বরেন্দ্র’ বলা হয়৷’’ এককালে বাঙলার উত্তরাংশে পদ্মার বামতীরে দক্ষিণে মালদা, রাজসাহী, পাবনা, উত্তরে হিমালয়, ঝাঁপা , শিলিগুড়ি, গোয়ালপাড়া, ---পূর্বে ব্রহ্মপুত্র আর পশ্চিমে কৌষিকী (কোশী) দ্বারা রেখায়িত অঞ্চলকে বলা হ’ত বরেন্দ্র৷

রাঢ়ের চেয়ে কিছুটা ছোট হলেও এরও ছিল দুটি ভুক্তি (ক) পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি-বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণাংশ হল পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি৷ বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে জেলা ভিত্তিক এর পরিচয় হল--- বগুড়া, পাবনা, রাজসাহী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নৌওগাঁ, জয়পুরহাট৷

(খ) কামতাপুর ভুক্তি--- বরেন্দ্রভূমি উত্তরাংশ হল কামতাপুর ভুক্তি৷ এখন ভারতীয় উপমহাদেশে এর জেলা ভিত্তিক পরিচয় হল---কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং এর সমতল অংশ, (কার্শিয়াং), কিষাণগঞ্জ, ঝাঁপা, ধুবড়ি,  কোকরাঝড়, গোয়ালপাড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কামরূপ৷

পরবর্তীকালে কামতাপুর ভেঙে  দু’টুকরো হয়--- পূর্বাংশের নাম হয় বিজনী পশ্চিমাংশের  নাম হয় কোচবিহার৷ বরেন্দ্রভূমির বেশী অংশটাই বর্তমান বাঙলাদেশে৷

৩) সমতট--- সমতট---পঞ্চগৌড়ের ‘সমতটে’র ভূমি পুরোপুরি সমতল বলে এর নাম হয়েছে সমতট৷ এর আর এক নাম বাগড়ি৷ ব্যাঘ্রতটি থেকে এসেছে বাগড়ি শব্দটি৷ এককালে সমতট বাঘের (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার) গর্জনে আলোড়িত হ’ত, তাই একে ব্যাঘ্রতটি বা বাগড়িও বলা হ’ত৷ সমতটের বেতের বন বাঘেদের প্রিয় আবাস স্থল৷

৪) বঙ্গ-ডবাক --- বঙ্গ ডবাক--- বরেন্দ্র ও সমতটের পূর্বে গৌড় দেশের  অতিমাত্রায় নদীমাতৃক অংশটির নাম ‘বঙ্গ’৷ ‘বঙ্গ’ শব্দের অর্থ মিহি বা পাতলা ধাতু৷ বঙ্গের উন্নতমানের কারিগরেরা ও স্বর্ণকারেরা খুব মিহি অলঙ্করণ প্রস্তুত করতে পারতেন বলে তাঁদের প্রশংসায় দেশটীর নাম  হয় ‘বঙ্গ’৷ আবার  ‘বঙ্গ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে তিন বা  রাং৷

ভূমিগত বিচারে বঙ্গ অপেক্ষাকৃত নবীন ও নীচু এলাকা, ফলে বর্ষা আসলে ডুবে যেত৷ তাই বঙ্গ ‘ডবাক’ নামেও পরিচিত হয়েছিল৷ বর্তমানে ‘ডাকা’ (ঢাকা) অঞ্চলই প্রাচীন বঙ্গ৷

বঙ্গ-ডবাকেরও একটাই ভুক্তি--- সমগ্র বঙ্গ বা ডবাক এলাকা নিয়ে ছিল বঙ্গভূক্তি৷  ডবাকের সবটাই বর্তমান বাংলাদেশে৷

৫) তিরহূত বা মিথিলা--- মিথিলা/বিদেহ/তিরহূত--- মিি+ল+ড+টা করে হয় মিথিলা৷  মানে দাঁড়ায়- রাজা মিথি  যে দেশ জয় করেছিলেন৷ রাজা মিথি ত্রিহোত্রীয় যজ্ঞ করে  যে ভূমিকে পবিত্র করেছিলেন তা তিরভূমি বা তিরহূত৷ সমগ্র মিথিলা নিয়েছিল তিরহূত ভুক্তি ‘‘ত্রিহোত্রীয়’’- থেকে ‘‘তিরহূত’’ শব্দটি এসেছে৷  তবে মিথিলা ছিল সবচেয়ে ছোট৷ মিথিলা সবটাই বিহারে৷

শ্রীভূমি বা উপবঙ্গ বা সাবেক বাঙলা পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বাংশ৷ বর্তমানে মিথিলার পরিবর্তে উপবঙ্গ বা শ্রীভূমিতেই পঞ্চম-গৌড় হিসেবে ধরা হয়৷ শ্রীভূমির কিছুই পশ্চিমবঙ্গে নেই৷ শ্রীভূমি রয়েছে (উত্তর-দক্ষিণে)  অসম-মেঘালয়-মনিপুর-ত্রিপুরা-মিজোরাম-বাংলাদেশ-মায়ানমারের  মধ্যে৷