ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকেই ধর্ম নামক বিষয়টাকেও দোষারোপ করছেন৷ ওই সব ‘যুক্তিবাদী’, সমালোচকদের বোঝা উচিত, মানব সমাজে ভণ্ডামির মাধ্যম শুধু ধর্ম নয়৷ রাজনীতি ক্ষেত্রে কি ভণ্ডামি নেই? ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়৷ রাজনীতির নামে কি দাঙ্গা হয় না? বর্তমান যুগে ধর্মের ভেকধারী দুবৃর্ত্তদের চেয়ে রাজনৈতিক মুখোশ পরা শয়তানদের সংখ্যা অনেক বেশী৷ তাবলে কি রাজনীতি নামক বিষয়টাই খারাপ? বহু মনীষী রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ-সেবার মহান নজির স্থাপন করেছেন৷ আবার আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমেও বহু মনীষী নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করে গেছেন আর মানব সমাজকেও সুমহান মূল্যবোধ উপহার দিয়ে গেছেন৷
বিজ্ঞানকে নিয়েও একধরনের ভণ্ডামি চলছে৷ অনেকের মুখে শুণি --- মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান৷ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের ‘যুক্তিবাদীরা’ মার্ক্সবাদের সাথে বিজ্ঞানের খিচুড়ী বানিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পরিবেশন করেন৷ এই বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক৷ ওই দলের অনুকূলে জনসমর্থন তৈরী করার হীন উদ্দেশ্যে তাঁরা বিজ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছেন৷ তাদের তাই মুখেই শুণি--- মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান, তাই সর্বশক্তিমান৷ আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের সম্যক ধারণা রয়েছে, সেই সব বিজ্ঞানীরা মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান আখ্যা দেন না৷ মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞানের মোড়ক দিয়ে বাজারে ছাড়ছেন৷ এক্ষেত্রেও দোষটা বিজ্ঞানের নয়৷ বিজ্ঞানকে নিয়ে ভণ্ডামি দেখে বিজ্ঞানচর্চার নিন্দা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷
ধর্মের নামে সম্প্রদায়, জাত তৈরী করা হয়৷ একই জিনিস রাজনীতির নামেও তৈরী হয়৷ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা কম ক্ষতিকর নয়৷ মার্ক্সবাদীদের মাঝেও এই দেশে অসংখ্য জাত তৈরী হয়েছে৷ কেউ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মূর্ত্তি ভাঙ্গে, কেউ গড়ে৷ কারও চোখে রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল৷ আবার কারও দৃষ্টিতে কবিগুরু ভাল লোক৷
আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণরূপে অনুশীলনের বিষয়৷ অনুশীলন না করে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে এর সত্যতা যাচাই করা যায় না৷ সঙ্গীত-শাস্ত্রও জড় বিজ্ঞানের বিশ্লেষণী ক্ষমতার ঊধের্ব৷ বিশেষ বিশেষ স্বরের সমন্বয় থেকে কিভাবে মেলোডি তৈরী হয়, বিজ্ঞান তা জানে না ৷ রাগ ভৈরব কেন সকালে ভাল লাগে, রাগ বসন্ত কেন বসন্তের আমেজ নিয়ে আসে, মেঘ মল্লার কেন বর্র্ষর মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে--- আমাদের জড়বিজ্ঞান এসব জানে না৷ সুরের সাধনা মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটায়, এসব সত্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সুদূর-পরাহত৷
নিরক্ষর গদাধর আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমেই মহাজ্ঞানী রামকৃষ্ণ পরিণত হয়েছিলেন৷ তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য বিবেকানন্দ ভারতবর্ষে জাগরণী মন্ত্র উচ্চারিত করে গেছেন৷ ভারতের নবজাগরণে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ! রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতা ব্যষ্টিগত জীবনে আধ্যাত্মিক অনুশীলনেরই ফসল৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতেও আনন্দ শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়৷ মুখে মুখে যারা আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা করেন, তাঁদের মধ্যেও রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুরাগী অনেকেই রয়েছেন৷ এর কারণ আধ্যাত্মিক এষণা প্রতিটি মানুষেরই ধর্ম৷
আধ্যাত্মিক ঋষিরা বলে গেছেন যোগসাধনায় মানুষ খুব তাড়াতাড়ি উন্নত স্তরে চলে যায়৷ সাধারণ মানুষ একথা বিশ্বাস করে আসছে৷ তাই সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ডের দল যোগের নাম করে নিজেদের পকেট ভারী করে৷ পক্ষান্তরে, সত্যিকারের আধ্যাত্মিক সাধকের জীবন জীবপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে উদ্ভাসিত৷ স্বামী বিবেকানন্দ স্বামী, আবার চন্দ্রস্বামীও স্বামী৷ যারা সমস্ত স্বামীজিকেই বিশ্বাস করেন, তাঁরা মুর্খ৷ আর যারা সমস্ত স্বামীজিকেই শয়তান আখ্যা দেন, তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল৷
বিশ্বাসের দ্বারা মানুষ প্রতারিতও হয়৷ এই জন্যে বিশ্বাসকে বিতাড়িত করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ শিক্ষিত লোকেরা বহু বৈজ্ঞানিক সত্যকে নিজে প্রমাণ না করেই বিশ্বাস করে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ ভালভাবে রপ্ত না করেই অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে চলেছে৷ তাহলে যথার্থ মনীষীদের কথা বিশ্বাস করে আধ্যাত্মিকতাকে মানতে অপরাধটা কোথায়? ধর্মসাধনার সপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই৷ অতএব আধ্যাত্মিক সাধনার সুফল যারা অর্জন করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতার সত্যকে অস্বীকার করা আত্মবঞ্চনারই সামিল৷ ধর্মের নামে যে সমস্ত ডগমা চলছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিকতা পরিপন্থী৷
আধ্যাত্মিক জীবনের পরশমণি৷ নব্য চার্বাক পন্থীদের বোঝা উচিত--- ভোগবাদ কখনও কল্যাণদায়ক হতে পারে না৷ খবরের কাগজে নাস্তিক্যবাদীদের আস্ফালন যতই হোক তাঁদের দৌড় বেশীদূর নয়৷ ভারতের মাটিতে চার্বাক পন্থীরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন৷ বেঁচে আছেন বুদ্ধ, চৈতন্য, কবীর, নানক, রামকৃষ্ণ প্রমুখ৷
আধ্যাত্মিক পথের পথিকদের অহিংসা ও প্রেমই মানব সমাজকে সুন্দর করতে পারে৷
- Log in to post comments