আধ্যাত্মিকতাই  জীবনের পরশমণি

লেখক
বাদল মজুমদার

 ধর্মের নামে ভণ্ডামির  বিরোধিতা করতে   গিয়ে  অনেকেই  ধর্ম নামক বিষয়টাকেও দোষারোপ করছেন৷  ওই সব ‘যুক্তিবাদী’,  সমালোচকদের বোঝা উচিত, মানব সমাজে  ভণ্ডামির  মাধ্যম শুধু  ধর্ম নয়৷  রাজনীতি ক্ষেত্রে কি ভণ্ডামি নেই? ধর্মের  নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়৷ রাজনীতির নামে কি দাঙ্গা হয় না?  বর্তমান যুগে  ধর্মের ভেকধারী দুবৃর্ত্তদের চেয়ে রাজনৈতিক মুখোশ পরা শয়তানদের  সংখ্যা অনেক বেশী৷ তাবলে  কি রাজনীতি নামক বিষয়টাই  খারাপ? বহু মনীষী রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ-সেবার  মহান নজির  স্থাপন করেছেন৷ আবার আধ্যাত্মিক  সাধনার  মাধ্যমেও বহু মনীষী নিজের জীবনকে  সমৃদ্ধ করে গেছেন  আর  মানব  সমাজকেও  সুমহান  মূল্যবোধ উপহার দিয়ে  গেছেন৷

বিজ্ঞানকে নিয়েও  একধরনের ভণ্ডামি চলছে৷ অনেকের  মুখে শুণি --- মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান৷ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের ‘যুক্তিবাদীরা’ মার্ক্সবাদের  সাথে  বিজ্ঞানের  খিচুড়ী বানিয়ে সাধারণ মানুষের  কাছে পরিবেশন  করেন৷ এই বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের  সমর্থক৷ ওই দলের অনুকূলে জনসমর্থন তৈরী করার হীন উদ্দেশ্যে তাঁরা বিজ্ঞানকে কাজে  লাগাচ্ছেন৷ তাদের তাই মুখেই শুণি--- মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান, তাই সর্বশক্তিমান৷  আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের  সম্যক  ধারণা রয়েছে, সেই সব বিজ্ঞানীরা মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান আখ্যা দেন না৷ মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞানের মোড়ক  দিয়ে বাজারে  ছাড়ছেন৷ এক্ষেত্রেও দোষটা বিজ্ঞানের নয়৷ বিজ্ঞানকে নিয়ে ভণ্ডামি দেখে বিজ্ঞানচর্চার নিন্দা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷

ধর্মের নামে সম্প্রদায়, জাত তৈরী করা হয়৷ একই জিনিস রাজনীতির নামেও তৈরী হয়৷ রাজনীতিতে   সাম্প্রদায়িকতা কম ক্ষতিকর  নয়৷ মার্ক্সবাদীদের মাঝেও এই দেশে অসংখ্য জাত তৈরী হয়েছে৷ কেউ  রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মূর্ত্তি ভাঙ্গে, কেউ  গড়ে৷ কারও চোখে রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল৷ আবার কারও দৃষ্টিতে   কবিগুরু ভাল লোক৷

আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণরূপে অনুশীলনের  বিষয়৷ অনুশীলন না করে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে এর সত্যতা যাচাই করা যায় না৷ সঙ্গীত-শাস্ত্রও জড় বিজ্ঞানের বিশ্লেষণী ক্ষমতার  ঊধের্ব৷ বিশেষ বিশেষ স্বরের সমন্বয় থেকে কিভাবে  মেলোডি তৈরী হয়, বিজ্ঞান তা জানে না ৷  রাগ ভৈরব কেন সকালে  ভাল লাগে, রাগ বসন্ত কেন  বসন্তের  আমেজ নিয়ে আসে, মেঘ মল্লার  কেন বর্র্ষর মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে--- আমাদের  জড়বিজ্ঞান এসব জানে না৷ সুরের সাধনা মানুষের  মানসিক পরিবর্তন ঘটায়, এসব সত্যের বৈজ্ঞানিক  ব্যাখ্যা সুদূর-পরাহত৷

নিরক্ষর গদাধর আধ্যাত্মিক সাধনার  মাধ্যমেই  মহাজ্ঞানী রামকৃষ্ণ  পরিণত হয়েছিলেন৷ তাঁরই  সুযোগ্য শিষ্য বিবেকানন্দ ভারতবর্ষে জাগরণী মন্ত্র উচ্চারিত করে গেছেন৷ ভারতের  নবজাগরণে তাঁদের  অবদান অনস্বীকার্য ! রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতা ব্যষ্টিগত জীবনে আধ্যাত্মিক অনুশীলনেরই ফসল৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতেও আনন্দ শব্দের  বহুল প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়৷ মুখে মুখে  যারা আধ্যাত্মিকতার  বিরোধিতা করেন, তাঁদের মধ্যেও রবীন্দ্র সঙ্গীতের  অনুরাগী অনেকেই রয়েছেন৷ এর কারণ  আধ্যাত্মিক এষণা প্রতিটি মানুষেরই  ধর্ম৷

আধ্যাত্মিক ঋষিরা বলে গেছেন যোগসাধনায় মানুষ খুব তাড়াতাড়ি উন্নত স্তরে  চলে যায়৷  সাধারণ মানুষ একথা বিশ্বাস করে আসছে৷ তাই সেই বিশ্বাসের  সুযোগ  নিয়ে ভণ্ডের দল যোগের নাম করে নিজেদের পকেট ভারী করে৷  পক্ষান্তরে, সত্যিকারের আধ্যাত্মিক  সাধকের  জীবন জীবপ্রেম  ও ত্যাগের  আদর্শে উদ্ভাসিত৷ স্বামী বিবেকানন্দ স্বামী, আবার চন্দ্রস্বামীও  স্বামী৷ যারা সমস্ত স্বামীজিকেই  বিশ্বাস করেন, তাঁরা মুর্খ৷ আর  যারা  সমস্ত স্বামীজিকেই শয়তান আখ্যা দেন, তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল৷

বিশ্বাসের  দ্বারা মানুষ প্রতারিতও  হয়৷  এই জন্যে  বিশ্বাসকে  বিতাড়িত করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷  শিক্ষিত লোকেরা বহু বৈজ্ঞানিক  সত্যকে নিজে প্রমাণ না করেই  বিশ্বাস করে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ  ভালভাবে রপ্ত না করেই অধিকাংশ  মানুষ  বিশ্বাস করে চলেছে৷ তাহলে যথার্থ মনীষীদের কথা বিশ্বাস করে আধ্যাত্মিকতাকে  মানতে  অপরাধটা কোথায়? ধর্মসাধনার  সপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই৷ অতএব আধ্যাত্মিক  সাধনার  সুফল যারা অর্জন করেছেন, তাদের  অভিজ্ঞতার সত্যকে অস্বীকার করা আত্মবঞ্চনারই সামিল৷ ধর্মের নামে যে সমস্ত ডগমা চলছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিকতা পরিপন্থী৷

আধ্যাত্মিক জীবনের পরশমণি৷ নব্য চার্বাক পন্থীদের বোঝা উচিত--- ভোগবাদ কখনও কল্যাণদায়ক হতে পারে না৷  খবরের কাগজে  নাস্তিক্যবাদীদের আস্ফালন  যতই হোক তাঁদের  দৌড় বেশীদূর নয়৷ ভারতের মাটিতে  চার্বাক পন্থীরা  বিস্মৃতির অতলে  তলিয়ে গেছেন৷ বেঁচে আছেন  বুদ্ধ, চৈতন্য, কবীর, নানক, রামকৃষ্ণ প্রমুখ৷

আধ্যাত্মিক পথের পথিকদের অহিংসা ও প্রেমই মানব সমাজকে সুন্দর করতে পারে৷