(পূর্ব প্রকাশিতর পর)
আধ্যাত্মিকতায় ভর করে একটা কথার চলন আছ---জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি।'বলটাকে ভাববাদী-নৈষ্কর্মবাদীদের কোর্টে ঠেলে না দিয়ে প্রবাদটার ভিতরে ঢোকা যাক। আগেই বলা হয়েছে এই নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সত্তাই একই উৎস থেকে এসেছে। অর্থাৎ সবই সমসূত্রে গ্রথিত, তাই সবার মধ্যেই অনন্তস্বভাবের বীজ বর্তমান। পরের কথাটা হল--- এইসূত্রে প্রকৃতিতে সমতত্ত্বে বিকল্প- বিপরীত্ব.অস্তিত্ব ও স্বাভাবিক। তিল আর তেল এক নয়, তবে তিলের মধ্যে তৈল বৈশিষ্ট্য আছে বলেই তিল পিষলে তেল বের হয়। বটফল পিষলে তেল পাওয়া যায়না। প্রকৃতির এই স্বভাব ধর্মের ওপরেই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্রটি দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় আধ্যাত্মবিজ্ঞানীরা তাঁরও বহু হাজার বছর আগে এই ব্যাপারটাকে বলেছিলেন এইভাবে-- '' যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।" তত্ত্বের কথা থাক, কাজের কথাটা হল এই চেতনার কতগুলো দিকদর্শন আছে যেমন অ. জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই,কেননা সত্তার অন্তরেই সম্ভাব্যতা লুকিয়ে আছে। তাইকী ফরাসী বীরনায়ক বলেছিলেন-''অসম্ভভ' শব্দটা বোকাদের অভিধানে পাওয়া যায় '! আ. প্রকৃতির স্বভাব ধর্ম অনুযায়ী কোন দুটো জিনিস হুবহু এক না হলেও বিকল্প আছে যা মানুষের অভাব মোচনে কার্যকরী ভূমিকা নেবে। ন্যূনতম-নিত্যপ্রয়োজনীয় তালিকায় পরিচিত-প্রথাগত দ্রব্য সামগ্রীর বাইরে অসংখ্য বস্ত আছে যা বিকল্প ভোগ্যদ্রব্য হিসেবে সংকট মোচন করতে পারে, কেবল আবিষ্কারের অপেক্ষায়। খনিজ তেলের বিকল্প হিসেবে সস্তার -সহজলভ্য জ্বালানির আবিষ্কার হয়ে গেলে তেলব্যাপারীদের গুমর আর থাকবেনা। এককালে জলা বাঙলার মানুষ গমের পরিচয় জানত না, আর্যরাও তাদের আদিবাস ভূমিতে গম চিনিত না। পারস্যে এসে তারা প্রথম গমজাত খাবার খেতে শেখে, গম শব্দটাও এসে গেল বৈদিক ভাষায়। অথচ এখন গোটা পৃথিবীতেই খাদ্য তালিকায় গম প্রধান খাদ্য শস্য। জলে স্থলে অন্ত্যরীক্ষ্ এমন বহু কিছু আছে যা জীবকুলের অভাব মেটানোর অপেক্ষায় আবিষ্কৃত হতে লাইনে আছে। ব্যাপারটা এমন নয় কী? পৃথিবীতে জীব আসার আগেই জীবকে বরন করে নিতে অফুরন্ত বিচিত্র সম্ভারের ডালা সাজিয়ে অপেক্ষায় ছিল ধরিত্রী কেন? বাঁচার তাগিদে জীব তার প্রয়োজন মাফিক দ্রব্যের উপযোগ গ্রহন করবে। অর্থাৎ অভাব বা জাগতিক দুঃখ মোচনে দ্রব্যের উপযোগ ¢ea পারাটাই বড় কথা। আর এর থেকে এটাও বুঝতে অসুবিধা হয়না যে অর্থনীতির সূত্র বা ভাবনাগুলো আধ্যাত্মিকতা আধারিত না হলে মানুষের সত্যকারের কল্যাণ আসেনা। ৪.আধ্যাত্মিকতার কতোগুলো অভিভাবন শক্তি আছে। ক. মানুষের ধর্ম বা স্বভাব ধর্ম হচ্ছে বৃহতের প্রতি এষণা।' অর্থাৎ মানুষ যা চায়--- তা অনন্ত ভাবে চায়। কথাগুলো মানুষের আধ্যত্মিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। জগতে, অর্থনৈতিক জীবনে তা দাঁড়িয়ে গেল কি না l চাহিদা অসীম। এই অসীম চাহিদা মেটানোর সঠিক পথ না পেয়ে মানুষ সসীম জগতের সীমিত l পিছনে পাগলের মত ছোটে। সুস্থ সমাজ মন বলে ও তো বল্গাহীন লোভ, মানুষটা অর্থপিশাচ, এতো প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া। ফলটা হয় আগুনে ঘি ঢালার মত। যত ঘি ঢালা হবে আগুন তত বেড়ে যায়, নেভে না। তাই অসীম চাহিদার পূর্ত্তি হয় না, মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষ উৎকট দারিদ্র্যের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে। খ. স্বভাব ধর্মে তো সুদূরের পিয়াসী। কেননা মানুষের কোন না কোন অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অনুমিত হয় সৃষ্টির আড়ালে কোন এক নিয়ন্ত্রক অনন্তশক্তি আছে। সাধারণভাবে তাকে ধরা বা ছোঁয়া যায় না। এর জন্যে মানুষের মনে দুঃখ আছে। আবার মাটির পৃথিবীতে বেঁচে থাকার রসদ না পাওয়ার দুঃখ তো আছেই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা হল দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি লাভ। দার্শনিক পরিভাষায় একে বলে 'নিবৃত্তি'। তবে এই 'নিবৃত্তি' দু'রকমের। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থ না-থাকলে যে দুঃখ এবং তার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার নাম কেবল 'নিবৃত্তি'। আর অসীমের পিয়াস মেটানোর অভাব দূর করতে যে অর্থের প্রয়োজন ('অর্থ' মানে যার দ্বারা অভাব মেটানো যায়) তার নাম 'পরমার্থ'। এই পরমার্থের অভাব জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাময়িক। আবৃত্ত দশমিকের মত আসে আর যায়। স্থায়ী সুখ দেয় না। একবার খেলে তো আর চিরকালের মত খিদে মিটে যায়না। মানুষ যত দিন বাঁচবে তত দিন খাবে, পরবে, মাথার ওপর ছাতা চাইবে, রোগের পথ্য চাইবে, শিখবে। বাঁচতে গেলে নিবৃত্তি তো চাই-ই। মানুষ তো আর পশু নয় যে পেট ভরে গেল আর সব মিটে গেল! ক্ষণিক সুখের সঙ্গে আনন্দও তো তার চাই-ই। পরমার্থ ছাড়া তা তো সম্ভব নয়। এখানেই মানুষের সামনে এক বিরাট গোলক ধাঁধাঁ। স্থূল অর্থকে অস্বীকার করলে অস্তিত্ব থাকেনা। আবার অস্তিত্বই যদি না থাকল তাহলে পরমার্থ কে ভোগ করবে? সাধারণ মানুষের 'শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা'। অস্তিত্বের সংকটমোচনের নিশ্চিততা চাই সবার আগে। অর্থাৎ সহজ কথাটা হচ্ছে মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচতে গেলে অর্থ তো চাই-ই, সঙ্গে পরমার্থও চাই। পরমার্থ দিতে গেলে সমাজে চাই আধ্যত্মিকতার প্রতিষ্টা। গ. আধ্যাত্মিকতায় পরিশীলিত মানুষ সাধারণত হয় যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী। আধ্যাত্মিকতার রসসিক্ত মনে জাগে দরদ, মমত্ববোধ, একাত্মবোধ (আমি-ই সেই,আমারই প্রতিবিম্ব), সহমর্মিতাবোধ, সহানুভূতিশীলতা আর মানুষ-মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রতি নিঃস্বার্থ- অপাপবিদ্ধ ভালবাসা। কোন মানুষের মনে যদি এই গুণগুলোর বিকাশ না হয় তাহলে সে মানুষ হবে শোষক, প্রতারক,লম্পট, অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর,চরিত্রহীন এমন কি খুনী ধর্ষক। আধ্যাত্মিকতা না থাকাতে দেশ বিদেশের অর্থনীতিতে কত অনুপপত্তি। অর্থাৎ জগতের সার্বিক কল্যাণে অর্থশাস্ত্রকে হতে হবে আধ্যত্মিকতা আধারিত। ঘ . আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ ভাবনাগুলো হয় ভিতর থেকে বহির্মুখী( ইণ্ট্রো এক্ষ্ট্রোভার্সাল)। অন্যদিকে জড়বাদী ভাবনাগুলো হয় বাইরে থেকে ভিতর মুখী (এক্ষ্ট্রো ইণ্ট্রোভার্সাল )। বাইরে থেকে ভিতর মুখী তত্ত্বগগুলো তে পদে পদে বিভ্রান্তির সম্ভবনা থাকে। ¢L¿º অন্তর থেকে বহির্মুখী তত্ত্বগুলো ভুল হওয়ার সুযোগ থাকেনা বলেই চলে। ব্যাপারটা কেমন ? ধরা যাক দুটো লোকের একজন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারিদিকটা দেখছে , অপর জন পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে চারিধারটা দেখার চেষ্টা করছে। কার দেখাটা শতাংশে বেশী নির্ভুল ? পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা নয় কি ? অন্যজন তো পাহাড়ের উল্টো পিঠ দেখতেই পাচ্ছে না, কী আছে তা অনুমান করছে মাত্র। ঠিক হতে পারে,আবার নাও হতে পারে। কানার হাতি দেখা আর কী ! এ যেন লজিকের ফ্যালাসির মত রামছাগলের দাড়ি, কমলের দাড়ি আছে, অতএব কমল রামছাগল। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এক্ষ্ট্রো ইনট্রোবার্সাল তত্ত্বগুলো এই রকম 'রামছালু'। যুক্তির খাতিরে মানা হল সকল মানুষ সমান, সকল মানুষের সমান অধিকার। অতএব বণ্টন ব্যবস্থায় সমবণ্টন চাই। বৈচিত্র্য যে প্রকৃতির ধর্ম তা মানা হল না। যুক্তিসংগত বণ্টন না হলে সমস্যা গণ্ডগোল তো হবেই। আসল কথাটা হল সবকিছুতেই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী (কম্প্রিহেনন্সিভ্ আউটলুক্ ) থাকা দরকার। আধ্যাত্মিক চেতনা তা গড়ে উঠতে সাহায্য করে। (ক্রমশঃ).
- Log in to post comments