‘ধস’ ধাতুর অর্থ হচ্ছে হত্যা করা, আঘাত করা, জখম করা, ঝরিয়ে দেওয়া৷ যে বস্তুটি আঘাত করে জখম করে তাকে ‘খস’ (খসূচ্) বলা হয়৷
কেউ যদি অত্যধিক পরিমাণে মদ গেলে তাহলে তার যকৃৎ জখম হয়ে যায়৷ তেমনি কিছু কিছু এমন বস্তুও আছে যারা স্নায়ুকোষকে ঝিমিয়ে দেয় ও দীর্ঘকাল ধরে এই ঝিমুনির জের চলতে চলতে শেষে স্নায়ুকোষ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে৷ স্নায়ু (নার্ভ সেল) আর কাজ করে না....বিহ্বল দৃষ্টিতে তখন ফ্যালফ্যাল করে চাইতে থাকে৷ চিন্তার প্রাখর্য তো থাকেই না, চিন্তার সামর্থ্যও শেষ হয়ে যায়৷ এই ধরণের ঘটনাটি ঘটে দীর্ঘ দিন ধরে অতিরিক্ত পরিমাণে সিদ্ধি, গাঁজা, চণ্ডু, চরস ও আফিং খেলে৷ মর্ফিন (মর্ফিয়া) ঘটিত বস্তুতে এই জঘন্য গুণ রয়েছে৷ স্নায়ুকোষ যাতে রোগগ্রস্ত না হয় সেইজন্যে গাঁজাখোর, আফিংখোররা বেশী মাত্রায় দুগ্ধ পান করে থাকে৷ তাতেও ঠ্যালা সামলানো দায় হয়৷ শেষ পর্যন্ত মানুষ জড় হয়ে যায়৷ মদ্যপানে মানুষ জড় হয় না–অতিরিক্ত উত্তেজনা জাগে৷
মদ্য একটি অতি উত্তেজক বস্তু৷ উত্তেজক হলেও কফি কোকো–চা অল্পমাত্রায় উত্তেজক৷ তাই তারা বড় রকমের ক্ষতি করতে পারে না৷ তবে স্নায়ুর সাময়িক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় ওই বস্তুগুলি পান বা গ্রহণ করলে ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়৷ আর আফিং, গাঁজা, চণ্ডু, চরস এরা ঘটায় উল্টোটা৷ উত্তেজনার বদলে আনে অবসন্নতা৷ এই অবসন্নতা শেষ পর্যন্ত মানুষকে জড়ত্বে পর্যবসিত করে৷ একটা ভুল ধারণা আছে যে আফিম খেলে বুঝি পেটের রোগ সারে৷ কথাটা ডাহা মিথ্যা৷ আফিংখোর নেশার ঘোরে ভাবে এতে বুুঝি তার পেটের রোগ সারছে৷ একবার একটা ঘটনা হয়েছিল৷ এক ট্রেনে এক সাধুবাবা যাচ্ছেন.... যাচ্ছেন হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী৷ ট্রেনের অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে বেশ ভাল ভাল কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন৷ হঠাৎ সন্ধ্যের দিকে সাধুবাবা ছটফট করে উঠলেন৷ সবাই শুধোলেন, ‘‘ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া, সাধুবাবা৷
সাধুবাবা বললেন–‘‘মাথা ঘুরছে’’৷
সবাই শুধোলে–‘‘ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া–হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া৷
সাধুবাবা জানালেন, তিনি সঙ্গে আফিমের ডিবেটি আনতে ভুলে গেছেন৷ এই সময় তিনি একটু আফিং সেবন করেন৷ সহযাত্রী ছিলেন জনৈক কলকাতার বাবু৷ তিনি বললেন ‘‘একটু অপেক্ষা করুন সাধুবাবা৷ হয়তো বা আমি একটু আফিং যোগাড় করতে পারব’ খন’’৷
বাবুটি পরের ইষ্টিশনে নেবে গেলেন৷ প্লাটফর্মের নীচের দিক থেকে একটু আফিং রঙের ভিজে মাটি তুলে এনে গুলি পাকিয়ে সাধুবাবাকে হাঁ করতে বললেন৷ বাবুটি সেই গুলি সাধুবাবার মুখে ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিলেন৷ খানিক বাদে সাধুবাবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন৷ তাঁর মাথা ঘোরাও বন্ধ হয়ে গেল৷ তিনি আবার গল্পগুজৰ জুড়ে দিলেন৷
কথা প্রসঙ্গে এও বললেন–দেখলেন তো আফিংয়ের গুণ৷ সামান্য একটু খেলুম৷ তাতেই মাথা ধরা সেরে গেল৷
সাধুবাবা খানিকক্ষণের জন্যে গাড়ীর বাথরুমে গেলে কলকাতার বাবুটি অন্যান্য সহযাত্রীদের বললেন–আমি প্ল্যাটফর্মের নীচের থেকে ভিজে মাটির গুলি পাকিয়ে সাধুবাবার মুখে ছুঁড়ে দিলুম৷ তাতেই তাঁর রোগ সেরে গেল৷ আফিংয়ে রোগ সারে সেটা কেবল একটা মানসিক কল্পনা মাত্র৷ আফিং অবসাদ আনে৷ সেই অবসাদের আসা বা অবসন্নতায় যাওয়াটা নেশাগ্রস্ততা ছাড়া কিছুই নয়৷ আমি আরও লক্ষ্য করেছি, ওই যে গুলিটা আমি সাধুবাবার মুখে ছুঁড়ে ঢুকিয়ে দিলুম সেটা মুখের ভেতরও যায়নি৷ সাধুবাবার দাড়িতেই আটকে গেছে৷
অর্থাৎ আফিংয়ের নেশার চেয়ে অবসন্ন হতে চাওয়াটাই নেশা৷ এককালে এই আফিং–গ্রস্ত হয়ে চীন ধবংস হতে বসেছিল....এককালে আফিমের নেশায় অসমও ধবংস হয়ে যেতে বসেছিল৷ তাই আফিংয়ের নেশা থেকে সাবধান৷
শুণেছি ভারতের কোন একটি তীর্থে–তীর্থটিকে পক্ষীতীর্থ বলা হয়–সেই তীর্থের পুরোহিত একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাহাড়ের ওপর দেবতার প্রসাদ এক থালা রেখে দিয়ে আসেন৷ আর শকুনি জাতীয় কয়েকটি পক্ষী সেই নির্দিষ্ট সময়ে সেই প্রসাদ ভক্ষণ করতে আসে ৷ এই অপরূপ অলৌকিক দৃশ্য দেখবার জন্যে তীর্থে অনেক যাত্রী–সমাগম হয়ে থাকে৷ আমি মনে করি, আসল ব্যাপারটি হচ্ছে ওই তথাকথিত প্রসাদের সঙ্গে কিছুটা আফিং মেশানো হয়৷ ওই আফিংমের নেশায় গ্রস্ত হয়ে পাখীরা নির্দিষ্ট সময়ে এসে ওই আফিং–মেশানো প্রসাদ খেয়ে অবসন্নতাকেই ডেকে আনতে চায়৷
একবার শোণা গেছেল যে কোন একটি হোটেলে বা রেস্তরাঁয় চা খাবার জন্যে কলেজের ছেলেদের ভীড় লেগে যেত৷ খোঁজ নিয়ে হয়তো দেখা যেত যে সেখানেও হয়তো এই পক্ষীতীর্থের মত ঘটনাই অলক্ষ্যে ঘটে চলেছে৷
আফিংয়ের বিষ সাপের ফেনার মতই হানিকারক৷ সাপের বিষ থেকে এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদের ঔষধ তৈরী হয় ঠিকই, তেমনি আফিং থেকে মর্ফিন/মর্ফিয়া ইন্জেকশনও তৈরি হয়৷ তবে ঔষধ তৈরি হয় বলেই স্বাভাবিকভাবে নেশার ঝোঁকে যাবার আশায় মর্ফিয়া ইনজেক্শান নেবে এটা তো সমর্থন করা যায় না৷ ‘অহিফেন’ শব্দের অর্থ সাপের ফেন৷ মনে রেখো, ফেন বা ফেনা বানানে ‘ন’ ও ‘ণ’ দুই–ই চলবে৷ অহিফেন থেকে ‘অহিফাম’–শব্দ এসেছে আর ‘অহিফাম’ থেকে এসেছে ইংরাজী ‘ওপিয়াম’ (ত্থহ্মন্ব্ভপ্প) শব্দটি৷ (শব্দচয়নিকা–১৪শ খণ্ড)