দীর্ঘ ৭৩ বছর পরেও আমাদের ভাবতে হচ্ছে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পাঁচটি জিনিষের অত্যধিক প্রয়োজন, তারা পাচ্ছে না৷ আজও অনেকের ক্ষুধা নিয়ে জন্ম হচ্ছে পথে ঘাটে, আর মরতে হচ্ছে সেই পথে ঘাটে অবহেলিত পশু- পক্ষীদের মত৷ পাশাপাশি ভারতের মত বিরাট দেশে যৎসামান্য মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ভাগ্যবানরা দেশের সম্পদের সিৎহভাগের মালিক৷
দিন দিন তাদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ এমনকি করোনা লকডাউনের সময়ও সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে, যখন কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে৷
আজ সাধারণ মানুষের যে পাঁচটি জিনিষের দরকার সেটি হলো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান৷ অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার কথা হলো এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিষগুলি নিয়েই আমাদের দেশের সরকার ও জনগণ যে যেমন পাচ্ছে তেমন করেই নিছক স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছে, ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এটি নিছক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অতীব নোংরা রাজনীতি৷ দেশের সুষ্ঠু বাতাবরণটাই নষ্ট করে দিয়েছে দলীয় শাসনতন্ত্র৷ ধীরে ধীরে নিছক দলীয় স্বার্থেই নির্র্বচনকে কলুষিত করা হচ্ছে৷
যে হিংসাত্মক পরিবেশে নির্বাচনের প্রহসন হচ্ছে তাতে সমগ্র দেশবাসী হতবাক হয়ে যাচ্ছে৷ নির্র্বচনে রক্তগঙ্গা বইছে৷ এতে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই ধবংস হয়ে যাচ্ছে৷ চরম বেকার সমস্যায় দেশ ধুঁকছে৷ সরকারী ক্ষেত্রে কি কেন্দ্র কি রাজ্য কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি করা হচ্ছে৷ কিন্তু সধারণ মানুষের আর্থিক উন্নয়নে ও বেঁচে থাকার জন্য কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা নেই৷ প্রতিটি ব্লকে ব্লকে সঠিক উন্নয়নের কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি, যেটার উন্নয়নের চিন্তা-ভাবনা করাটা জরুরী ছিল৷ আগে শিক্ষিত অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের ভাতা দেওয়া হতো সেটা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাদের কর্মসংস্থানের দিকে তেমন নজরই নেই সরকারের৷ সমবায়ের মাধ্যমে ব্লকে ব্লকে ছোট ছোট কৃষিভিত্তিক ও কৃষিসহায়ক শিল্পের দিকেও কোনও নজর নেই৷
অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর যদি নাগরিকগণ না হয় তাহলে কিসের স্বাধীনতা? বছরে বছরে নানা বিষয়ে নাগরিকগণ বোট দেবে কিন্তু বেঁচে থাকার কোনও সংস্থানের ব্যবস্থা সঠিকভাবে হবে না৷ ভিখারী হয়ে অধিকাংশ মানুষ দিন যাপনের গ্লানি বহন করবে, সেটাতো স্বাধীনতা নয়! তাই সমবায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে, জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাতে জনগণ আর্থিকভাবে উপার্জন করে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়৷ উৎপাদনের জন্য দরকার ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘‘ল্যান্ড, লেবার, ক্যাপিটাল ও অর্গানাইজেশন’’৷ জমি, শ্রম, মূলধন, প্রতিষ্ঠান--- এইগুলিকে সংঘটিত করবে সমবায় পদ্ধতি৷ বিশেষ কোনও ব্যষ্টি নয়৷ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনীশ্রেণী ব্যবসাদারগণই একা এই কাজ করে আসছে৷ তাই সেই ধনীর রক্তচক্ষুই যা ইচ্ছে তাই করছে৷ আর গণতন্ত্রে সেই ধনীরাই প্রভাবশালী হয়ে শাসনযন্ত্রকেও নিয়ন্ত্রণ করছে৷ তাই শ্রমদান যারা করে তাদের মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়৷
বর্তমান যুগে এটা চলতে পারেনা৷ তাই শ্রমিককে মালিকানার অংশীদার করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ সেই কারণেই গণতন্ত্রে অবশ্যই সমবায় পদধতিতেই উৎপাদন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার৷ প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই গণতন্ত্র স্বার্থক৷ আজ শিল্প গড়তে বাইরের ধনীদের আহ্বান করা হচ্ছে৷ ফলে সেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মতো সংঘটনই তো আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে নিজেদের স্বার্থেই কাজে লাগিয়ে দেশকে অন্তঃসারশূন্য করে ছাড়বে৷ আর তাদের তাঁড়াতে দেশের অর্ধমৃত জনগণকে আর্থিক স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আর্থিক অধিকারকে অর্জন করতে অবশ্যই পথে নামতে হবে৷ তাই দেখা যায় কথায় কথায় সেই ধনী মিল ও কলকারখানার মালিকরা মিল, কারখানায় তালা ঝুলিয়ে নাগরিকদের নিঃস্ব করে ছাড়ছে৷ নাগরিকগণ পথের ভিখারী হয়ে দিন কাটাচ্ছে৷ আর সরকার তাঁদের (ধনীদের) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে অনেকক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে আছে৷
প্রতিটি ব্লক ও এলাকাকে আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য প্ল্যান পোগ্রাম নিতে হবে৷ দেশের কল্যাণে বাইরে থেকে অর্থ যত কম নেওয়া যায় ততই মঙ্গল৷ শুধু ট্যাক্স (কর) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংগ্রহ করে দেশ শাসন করবেন এই পুরাতন পদ্ধতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে৷ বিনিময়ের মাধ্যম টাকার মূল্যমানকে ধরে রাখতে হবে৷ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে ও বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ কাগজের নোট ছাপিয়ে বেতন বৃদ্ধি করে দেশের উন্নতি ঘটানো সম্ভবপর নয়৷ মোদ্দা কথা ভারত কৃষিপ্রধান দেশ৷ তাই ব্যাপক কৃষির উন্নতি ঘটিয়ে কৃষি সহায়ক ও কৃষিভিত্তিক ছোট ছোট আঞ্চলিক ভিত্তিতে শিল্প গড়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ভারতকে আর্থিক দিক থেকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে হবে৷
বিদেশী পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক পরিণতি ঘটাবে এটা যেন দেশের নেতা-নেত্রীদের স্মরণে থাকে৷ যদি শাসক বিপথগামী হয় তাহলে সর্বনাশ অবশ্যাম্ভাবী৷ অর্থকে কেন্দ্রীভূত করে কিছু ব্যষ্টিকে লক্ষ্মীলাভ করানোটা দেশের উন্নয়ন নয়৷ এটা প্রশাসনিক চরম ব্যর্থতা৷ চাই নোতুন দৃষ্টিভঙ্গী ও নোতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা৷
এ্যাডাম স্মিথের অর্থনীতি কোনও দিনই সার্বিক জনকল্যাণ করেনি ও করবে না৷ তাই নোতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন---প্রাউটের পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার পথে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকে নিছক বাঁচার জন্য৷
‘প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র যুগের ডাক, ধনতন্ত্র চুলোয় যাক৷’ কারণ ধনতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর ৷ আজকের কেন্দ্রের অর্থনীতির চিন্তা-ভাবনা দেশের কোনও কল্যাণ করতে চরম ব্যর্থ হচ্ছে ও হবে৷ ধনীরাই সব আত্মসাৎ করবে আর সাধারণ মানুষ আরও রক্তশূন্য হবে৷ দেশের প্রতিটি ব্লক ও এলাকা আর্থিক দিক থেকে যাতে আত্মনির্ভরশীল হয় সেই দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে সরকার ও জনগণকে৷ পরগাছার মতো যুগ যুগ ধরে যে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় ধনী ব্যবসাদারদের স্বার্থসিদিধ করে চলেছে সেটা স্তব্ধ হোক৷ নাগরিকগণ যেন কৃপাদাসে আর পরিণত না হয়৷ মনে রাখতে হবে প্রাউট দর্শন হলো বর্তমানযুগে সর্বরোগহর এক পূর্র্ণঙ্গ আর্থিক-সামাজিক দর্শন যেটি সম্পূর্ণ যুক্তি, নীতিবাদ ও বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷
- Log in to post comments