অসমিয়া ও বাঙালী বিরোধের শিকড় সন্ধানে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পৃথিবীর বুকে গণতান্ত্রিক জগতে  বৃহত্তম আর বহুভাষিক ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বহুল-প্রচারিত  এক রাজ্য অসম৷ নদী-উপতক্যা ও অববাহিকা সমেত সমতলভূমি আবার পার্বত্য-উষরভূমিসহ উঁচু-নীচু, দুর্গম অরণ্যঘেরা, জঙ্গল-আচ্ছাদিত ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমি নিয়ে রাজ্যটির  ভূ-প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই নবঘটিত এ রাজ্যের  নামকরণ হয়েছিল অসম-রাজ্য৷ অবশ অনেকের  মতে  বার্র্ম থেকে আগত অহোম-দের নাম থেকে  নাকি এ রাজ্যের  এরূপ নাম  হয়ে থাকতে  পারে বলে বলা হয়  কিন্তু তা’ সঠিক নয় বলেই বিদগ্দ জনদের অভিমত৷

 যা হোক, ইংরেজরা এসে এ অঞ্চল দখলে নেবার পরে তারা এর নাম দেন ইংরেজী হরফে ফলে বাংলায় এর উচ্চারণ হয়ে দাঁড়ায় ‘অ্যাসাম’ আর এর  অধিবাসীদেরও বলা হয়ে থাকে অ্যাসামীজ বলে৷ তবে এর বিকৃত উচ্চারণে আসাম  থেকে ‘আসামী’ বলা হলে কিন্তু বাংলাভাষায় দারুণ বিপত্তি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়৷ সুতরাং অসমকে ‘অসম’ বলাই শ্রেয়৷ তবে অসমিয়ারা যেহেতু ‘স’ -কেই ‘হ’ বলে উচ্চারণ করে থাকেন সেক্ষেত্রে আবার ‘অহমিয়া’ না হয়ে ‘অসমিয়া’ বলাই  ভাল৷

কিন্তু অসম রাজ্য আজ সত্যি আমাদের ত্রিপুরাই মতো বাঙালী জনগোষ্ঠীর  বধ্যভূমি আর এডিসির  পরিবেষ্টনী-ঘেরা কারাগারেরই মতো বাঙালীদের বধ্যভূমি ও ডিটেনশনরূপী বে-নাগরিক বানাবার জেলখানায় রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে, ভাবতেই খারাপ লাগে৷ তবে অসমরাজ্য নিয়ে বাঙালীর বীরোদ্ধত গর্ব করার মতো যথেষ্ট কারণও রয়েছে বৈকি৷

 আমরা  জানি সবাই যে ১৯৫২ সালে পূর্ব বাঙলার ডাকা শহরে ২১ শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবী নিয়ে বাঙালীর য়ে রক্ত-তর্পন ঘটে গিয়েছিল তাতেই সেই মাটিতে বীজ উপ্ত হয়েছিল পরবর্তীকালের বাঙলার মুক্তি সংগ্রামের  আর তারই ফলশ্রুতি আজকের পৃথিবীতে স্বাধীনতা সার্বভৌম রাষ্ট্র লাল সবুজ পতাকায় গর্বিত বাঙলাদেশ৷ তদ্রূপ, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবীতেই পৃথিবীতে বাঙালী জাতি সত্তার  দ্বিতীয়  বিশ্বখ্যাত জ্বলন্ত নজির স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬১ সালের ১৯শে  মে দিবসটিতে--- অসমের শিলচরে তারাপুর রেলষ্টেশনে এগারোটি তাজা বাঙালী তরুণ-তরুণীর রক্ততর্পণে  যার দউলতে ওই ষ্টেশনের নাম আজ ‘একাদশ বাংলাভাষা শহীদ’ রেলওয়ে ষ্টেশন৷ বলা খুবই সঙ্গত যে, পৃথিবীতে মাতৃভাষার  স্বকীয় মর্যাদা রক্ষার দাবী নিয়ে এত বড় আত্মোৎসর্গের দু দু’টো  ঘটনাই বাঙালীজাতিকে নূতন করে  বিজয় টিকা পরিয়ে বাঙালী জাতিসত্তাকে বিশ্ববন্দিত করে তুলেছে৷

কিন্তু আজ সেই অসম ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলনে মত্ত৷ পৃথিবীর সভ্যমানব সমাজে  মানবসভ্যতারই আদি পীঠস্থান ভারতবর্ষের সেই অঙ্গরাজ্য অসম যেখানে  বাঙালীদের  লাখো লাখো মানুষকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, কারো কারোর নাগরিকত্বকেও বেমালুম জবরদস্তিমূলক অস্বীকার করে, গণতন্ত্রকে পদদলিত করে, সংবিধানকেও তুচ্ছ-হেয় প্রতিপন্ন করে স্রেফ এথনিক অহংবোধের উন্মত্ততা দেখাতে ও আইডেনটিটির ঔদ্ধত্য প্রকাশের  সেন্টিমেন্টালিটিকে গর্র্বেদ্ধত প্রাধান্য দেখাতে গিয়ে  ‘ডি-বোটার’ ‘অনুপ্রবেশকারী’,‘বিদেশী’ ইত্যাদি তক্‌মা লাগিয়ে  ডিটেনশনক্যাম্পে (পড়ুন বাঙালী নিধনের খোঁয়াড়) নিক্ষেপ করা হয়েছে৷ বর্তমান পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরনের কোন  রাষ্ট্রে কিংবা রাজ্যে  কোন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই এমনতর জঘন্য নজীর নেই৷ আর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিভূরাও তাদের সাম্রাজ্য-বিস্তারের মোহান্ধতায় সেই সংকীর্ণতাবাদী মানবতাদ্রোহীদেরই হুঁকোয় তামাক টানতে  গিয়ে ভারতমাতার ‘‘অহিসা পরমধর্র্ম ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’,‘সবার উপরে  মানুষ’, কিংবা  মানুষ মানুষ ভাই ভাই,--- এসব  মর্মবাণীগুলোকে ক্ষ্যাপা প্রাণীদের মতই পায়ে জড়িয়ে নিজেদের জার্সিতে শুধু কলংকের তালি বাড়াতে পেরেছেন৷

অসম সরকার ও অসমিয়া-জনগোষ্ঠীর নিন্দনীয় বাঙালী-দ্রোহীতার  আরও জ্বলন্ত দৃষ্টান্তসহ বিদ্বেষপূর্ণ কাহিনীর বর্ণনা না হয় পরে আলোচিত হবে৷  এরও পূর্বে আসুন, আমরা অসমিয়াদের এই  বাঙালী বিদ্বেষের  অন্তরালে  যে মূল কারণ বিদ্যমান রয়েছে, তারই শিকড়-সন্ধানে হাত বাড়াই৷ কিন্তু তারও  আগে কার্যকারণেই আমাদের দেখতে হবে অসম -রাজ্যটির উদ্ভাবনের ও গোড়ার কথা৷

আমরা জানি যে, পৃথিবীতেগ্রহে  গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডই হল প্রাচীনতম স্থূলভূমি৷ আজ থেকে  প্রায় ত্রিশকোটি  বছর পূর্বে এর সৃষ্টি৷ তখন আর্যাবত্ত তথা উত্তর ভারত, পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট , রাজস্থান, সমতট বঙ্গ-ডবাক কিছুই ছিল না৷  সেকালে হিমালয়ও ছিল না, তবে বিন্ধ্যপর্বত ছিল তারই শাখা-প্রশাখা---সহ্যাদ্রি, সাতপুরা, রামগড় ইত্যাদি তুষারাবৃত পাহাড়গুলো আর সেই পাহাড় থেকে বরফগলা জল বাহিত--- দামোদর, কংসাবতী, অজয়, দ্বারকেশ্বর, সুবর্ণরেখা, ময়ূরাক্ষী নদীসমূহ৷ উক্ত নদী সমূহের বাহিত পলি-বালি আর ক্ষয়িত পর্বতাংশ ইত্যাদি মিলে সমুদ্র গর্ভ ভরাট হয়ে গণ্ডোয়ানার পূর্বাংশে জেগে উঠল সমতলভূমি৷

প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে উক্ত সমতলভূমিই পৃথিবীর আদিতম মানবের আঁতুড়ঘর পরবর্তী সময়ে তখনকার অষ্ট্রিক ভাষায় তার নাম হয়েছিল--- রাঢ়, বাংলায় যার মানে হয়--- রক্তমৃত্তিকার দেশ৷ রাঢ়ের নদীবাহিত পলল থেকে আরও পরে গড়ে ওঠে পূর্বরাঢ়৷                      ( ক্রমশঃ)