স্রষ্টার সৃষ্টির প্রথম সূতিকাগৃহ হচ্ছে রাঢ়ভূমি৷ তাই মানবসমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসে রাঢ়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, মৌলিকত্ব ও ঐতিহ্য রয়েছে৷ মানব সভ্যতার, বিকাশে রাঢ়ের মানুষদের অবদান অপরিসীম, ও অনস্বীকার্য৷ এই রাঢ়ভূমিতেই প্রথম মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে, প্রথম অরণ্যভূমির সৃষ্টি হয়েছে, প্রথম ছোট বড় বহু অরণ্যচর প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে, প্রথম মানবশিশুর জন্ম হয়েছে রাঢ়েরই সূতিকাগৃহে৷ রাঢ়ের মাটিতেই প্রথম আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার হয়েছে, প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়েছে, পশুপালনের সূচনা হয়েছে ও প্রথম কৃষিকার্যের প্রচলন হয়েছে৷ এজন্য রাঢ়ের মাটি আমাদের নিকট পূন্যভূমি, আর রাঢ়ের আদিম মানুষেরা আমাদের পূজনীয় পথ প্রদর্শক, মানব সভ্যতার ধারক, বাহক ও প্রেরণার উৎস৷
যাইহোক, অষ্ট্রিক শব্দ রাঢ় কথার অর্থ হচ্ছে রক্তমৃত্তিকার দেশ অর্থাৎ লালমাটির দেশ, রাঙা মাটির দেশ৷ তাইতো এখানে অনেক গ্রাম ও জনবসতির নাম রয়েছে---রাঙামাটি, রাঙাডি, রাঙাগাঢ়া ইত্যাদি৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়কেও রাঢ়ের লাল মাটি,রাঙামাটি বিমোহিত, বিগলিত করেছে৷ তাই তিনি বলেছেন, গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায়রে৷’’ আজকে আমরা পশ্চিম রাঢ়ে যে তরঙ্গায়িত রক্তমৃত্তিকা দেখতে পাই--- যে তরঙ্গ সামনের দিকে এগোতে এগোতে সুদূর নীলিমায় মিশে যায়, যে তরঙ্গ পশ্চাদ্দিকে পেছতে পেছতে কোন হারানো ঠিকানার ইঙ্গিত দিয়ে যায় --- সেই তরঙ্গায়িত দেশ হ’ল আমাদের রাঢ়ভূমি৷ মহান দার্শনিক ও সমাজগুরু শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এই রাঢ়ের মৃত্তিকার ‘বর্ণনায় বলেছেন---‘‘মিষ্টি রাঢ়ের মাটি---‘‘সোনার লঙ্কা, সোনার স্বর্গ চেয়েও জানি খাঁটি৷’’ তিনি একথাও দৃপ্ত কন্ঠে বলেছেন,---‘‘মানুষের উদ্ভব পৃথিবীতে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ বিন্দুতে হয়েছিল৷ কে আগে কে পরে--- এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করেও বলতে পারি, রাঢ়ভূমিতে মানুষের উদ্ভব অতি প্রাচীন৷ এর চেয়ে প্রাচীনতর মনুষ্য নিবাসের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না৷
মোটামুটি পূর্ব রাঢ় বলতে বুঝি--- (১) পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, (২) বীরভূম জেলার উত্তরাংশ (৩) পূর্ববর্দ্ধমান (৪) গোটা হুগলী (৫) গোটা হাওড়া (৬) পূর্বমেদিনীপুর (৭) বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা৷ আর পশ্চিম রাঢ় বলতে বুঝি ঃ- (১) সাঁওতাল পরগণা, (২) বীরভূমে অধিকাংশ অংশ, (৩) বর্দ্ধমানের পশ্চিমাংশ, (৪) ইন্দাস থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা, (৫) পুরুলিয়া জেলা, (৬) ধানবাদ জেলা (৭) হাজারিবাগ জেলার (বর্ত্তমান গিরিডি জেলার) কাসমার, পেটারওয়ার্ড, গোলা জেরিডি, রামগড় প্রভৃতি এলাকা (৮) রাঁচি জেলার সিল্লি, সোনাহাতু বুন্দু ও তারার থানা, (৯) সিংভূম জেলা, (১০) ঝাড়গ্রাম জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুরের সদর, উত্তর ও সদর দক্ষিন মহকুমা৷ এই যে পূর্বরাঢ় ও পশ্চিমরাঢ়ের বিস্তৃত অঞ্চল, এই অঞ্চল ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্টের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর৷ পূর্বরাঢ়ের নদীবাহিত বালি ও পলিমাটির সমতল মৃত্তিকা অতীব উর্বর৷
এই মাটি দো-ফসলা ও কোথাওতে ফসলা চাষের পক্ষে খুবই উপযোগী৷ আর পশ্চিমরাঢ়ের ঢেউ খেলানো উঁচুনীচু জমি ও মালভূমি বনজ সম্পদে পরিপূর্ণ ও এখানকার ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ যথা তামা, লোহা, অভ্র সোনা, কয়লা, ফসফেট ইত্যাদি প্রকৃতির অকৃপন কৃপায় যথেষ্ট পরিমানে বিদ্যমান৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিম রাঢ়ের মানুষগুলি খুবই গরীব৷ এখানকার মানুষের জীবনধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির চাহিদা যথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার প্রয়োজন পূর্ত্তি হয় না৷ স্থানীয় ও বহিরাগত বৈশ্যদের শোষনে এদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্যসীমার অনেক নীচুতে৷ এখানকার অরণ্যজাত সম্পদ ও খনিজ সম্পদের বহিঃস্রোতের ফলে এখানকার মানুষগুলি আজ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন, গৃহহীন অবস্থায় শুধু দিন যাপনের প্রাণধারণের গ্লানি নিয়ে কালাতিপাত করছে৷ এদের জন্যে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার কারও সুষ্টু পরিকল্পনা নেই৷ বরং রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির নিমিত্ত যে দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসীন হচ্ছে--- তারা ভাগাভাগি করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে ও তুলছে৷ এজন্য মহান সমাজ সংস্কারক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার এদের সমবেদনা জানিয়ে বলেছেন,‘‘পশ্চিম রাঢ়ের মানুষ আজ সোনার পালঙ্কে শুয়ে থেকেও অনশনে ও অর্ধাশনে দিনযাপন করছে৷’’
রাঢ় শুধু সভ্যতারই আদিবিন্দু নয়, সাংসৃকতিক অগ্রগতিরও প্রথম পদবিক্ষেপ এই রাঢ়৷ ছোট বড় নদীর বিভিন্ন অববাহিকার পারস্পরিক মিলনে মিশ্রনে কর্মৈষনা ও ভাবাদর্শের বিনিময়ে গড়ে উঠল রাঢ়ের সভ্যতা, রাঢ়ের সংসৃকতি যা কেবল রাঢ়েই নয়, যার ঔজ্জ্বল্য সেই--- অন্ধকার যুগের অনগ্রসর মানুষের জীবনে একটা সোনালী প্রভাত৷ নানান দেশের মানুষ তখন ছুটে এল রাঢ়ে মানবসভ্যতার পাঞ্চজন্য শুনতে, মানবতার মহান প্রশস্তি উদ্গীত করতে৷ সমাজ সংরচনার ব্যাপারেও রাঢ়ের অবদান অসামান্য৷ জীবনে এমন একটিও স্তর নেই--- জীবনপল্লবে এমন একটিও শিরা উপশিরা নেই যা রাঢ়ের স্পর্শে স্পন্দিত হয়নি৷
এই রাঢ়ই মানব সমাজকে প্রথম একজন দার্শনিক উপহার দিয়েছিল, সেই দার্শনিক ছিলেন সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা মহর্ষি কপিল৷ তাঁর জন্ম হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার মালদার কাছাকাছি পাট ঝালদায় এবং তাঁর অভিজ্ঞার সিদ্ধি ঘটেছিল রাঢ়েরই সমতটের শেষ রেখায় বঙ্গোপসাগরের গঙ্গাসাগরে৷ বর্দ্ধমানের পাতুন গ্রামে জন্ম হয়েছিল আর এক দার্শনিকের , যাঁর নাম ছিল মহর্ষি পাতঞ্চলি৷ এই বর্দ্ধমান জেলায় সিদ্ধি (সিঙ্গী) গ্রামে জন্মেছিলেন কবি কাশীরাম দাস, যিনি স্বচ্ছন্দ ভাষায় ও সুললিত বাংলায় মহাকাব্য মহাভারতকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন৷ রাঢ়ী কবি কৃত্তিবাস ওঝা এভাবে বাল্মিকীর রামায়ণ মহাকাব্যকে বাংলার মানুষের পথ চলার পাঁচালি করে তুলেছেন৷ তেমনি আবার রাঢ়ের লাল মাটির সন্তান বৈষ্ণব কবিরা রসমাধুরিতে মানবমনকে উজ্জীবিত করেছেন৷ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দ্বিজ চণ্ডীদাস (বীরভূমের নানুর), দীন চণ্ডীদাস্(বর্দ্ধমান), বড়ুচণ্ডীদাস (বাঁকুড়ার ছাতনা), জয়দেব, লোচন দাস, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর, গোবিন্দদাস ঠাকুর প্রমুখ৷ মঙ্গলকাব্যের রচয়িতা ঘনশ্যাম চক্রবর্ত্তী, কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, রায় গুনাকর ভারত চন্দ্র রায় প্রভৃতি সবাই ছিলেন রাঢ়ের মানুষ৷
তারপর অনেক পরবর্তীকালের কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়,তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রভৃতিরাও ছিলেন রাঢ়ের মানুষ৷ জন্মসূত্রে না হলেও বংশধারা সূত্রে কর্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন রাঢ়ী৷ এছাড়া বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রাজশেখর বসু ও সাহিত্যিক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ছিলেন রাঢ়ের সন্তান৷ গণিতের দূ্যতিমান পুরুষ শুভঙ্কর দাস ছিলেন বাঁকুড়ার রাঢ়ী কায়স্থ৷ দক্ষিণ রাঢ়ের অর্থাৎ মেদিনীপুর অঞ্চলের (দণ্ডভূক্তির) রাজা শালিবাহনের উৎসাহে রাঢ়ের সুসন্তান জয়ন্ত পাণিগ্রাহী সৌর বৎসরগণনা প্রণালী বঙ্গাব্দ প্রবর্ত্তন করেন৷ বাংলার এই শাল শব্দ (ফার্সী সাল শব্দ) এসেছে দণ্ডভুক্তির রাজা শালিবাহনের নাম থেকে৷ জ্যোতিষ্কের প্রভাব পর্যালোচনা করে জ্যোতিষ্ক শাস্ত্রকে ফলে ফুলে পত্র পল্লবে রসঘন করে তুললেন রাঢ়েরই স্নেহের দুলালী ক্ষণা৷ ক্ষণা ছিলেন বাঁকুড়ার বৈদ্যকুলের দুহিতা৷
এইভাবে সাহিত্য, শিল্পে স্থাপত্যে, ভাস্কর্য কলায়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, দর্শনে আধ্যাত্মিকতায় যুগে যুগে অসংখ্য মনীষি রাঢ়ের রাঙা মাটিকে আরো উজ্জ্বল করে রাঙিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সকলের পরিচয় এ প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়৷ তাঁদের অনেকের নামের সঙ্গে প্রায় সব প্রবন্ধ পাঠকই পরিচিত৷ যেমন বিপ্লবের অগ্ণিশিখা রাসবিহারী বসু, পৌরুষের বজ্রকৌস্তভ সুভাষচন্দ্র বসু, বিপ্লবী রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহান সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তেজস্বিকতায় ভাস্বর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ শ্রী অরবিন্দ, দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন সাধক রামপ্রসাদ সেন--- এঁরা সবাই কেউ জন্মসূত্রে, কেউবা বংশধারা সূত্রে রাঢ়ী৷ তাই দেখা যায় রত্নগর্র্ভ রাঢ়ভূমি যুগে যুগে সভ্যতা, সংসৃকতি ও আধ্যাত্মিকতা ও বীর্যবত্তার ক্ষেত্রে অজস্র দিকপালদের জন্ম দিয়েছে৷ এখনও সে সৃষ্টিধারাব্যাহত হয়ে চলেছে৷ তবে বর্ত্তমানে প্রতিকুল পরিবেশে পরিস্থিতিতে সেইসব অশেষ সম্ভাবনাময় প্রতিভা হয় অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অথবা বর্হিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে কিম্বা পাচার হয়ে যাচ্ছে৷
(পরবর্তী অংশ আগামী ১লা জানুয়ারী সংখ্যায়---মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’ গ্রন্থ অবলম্বনে৷)
- Log in to post comments