অর্থনীতির অর্থ---ধনের বা সম্পদের ব্যবহারিক নিয়ম সেই নিয়ম এমন হওয়া উচিত যাতে বিশ্বের সকল মানুষ তথা সকল জীবের অস্তিত্ব সুরক্ষিত হয় মহান দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায় অর্থনীতি হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রয়োগভৌমিক বিজ্ঞান, আর একে বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বজীবের তথা সর্ব অস্তিত্বের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে বিকশিত হতে হবে
কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রাউট দর্শন তৈরীর পূর্বে কোন অর্থনৈতিক তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বজীবের তথা জগতের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করা হয়নি তাই গো-যান থেকে মহাকাশ যান জড়বিজ্ঞানের নিত্যনূতন আবিষ্কার মানুষকে পর্বত কন্দর, অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণকুটির থেকে চোখ-ধাঁধানো আলোঝলমল শহরের সুরম্য অট্টালিকায় এনে তুলেছে তবু আজ পর্যন্ত আদর্শ মানব সমাজ তৈরী হল না হল না--- তার অন্যতম কারণ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির করালগ্রাসে বিশ্বের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষের হাতে
আর্থিক সংস্থাগুলি নানা পরিসংখ্যান দিয়ে ধনবৈষম্যের করুন চিত্রটি তুলে ধরেছে সেই পরিসংখ্যানের বিস্তারিত তথ্য না দিয়ে একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে ধনবৈষম্য বোঝাতে এই ভারতে আজও কোটি কোটি মানুষ নিরাশ্রয়, খোলা আকাশের নীচে বাস করে সেখানে একজন মহিলা থাকেন ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রাসাদে আর দেশের সরকার প্রাকৃতিক প্রলয়ে বিপর্যস্ত কয়েক লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে এক হাজার কোটি টাকা দিতে অক্ষম পঁুজিবাদ আশ্রিত এই সামাজিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় আত্মনির্ভরতার কথা বাস্তবজ্ঞান বর্জিত অসার বুলি, অলীক কল্পনা
প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন---আজ অর্থনীতি বস্তাপচাতত্ত্ব কথার কচকচানি ছাড়া আর কিছুই নয় একে অধিকতর বাস্তবমুখী করতে হবে সেই বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার রূপরেখা অর্থনীতির নবদিগন্ত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব--- প্রাউট প্রাউট দর্শন তৈরী প্রসঙ্গে পরমশ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন--- অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই, চিকিৎসা চাই, নিবাস চাই আর এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যেই একদিন অবস্থার চাপে পড়ে প্রাউট দর্শন করতে বাধ্য হয়েছি এগুলো প্রাথমিক প্রয়োজন এই প্রয়োজন পূর্তি না হলে কখনো সামগ্রিকভাবে মানুষ জাতির উন্নতি সম্ভব নয়
সামগ্রিকভাবে সার্বিক উন্নতি অনেক দূরের কথা, আজকের অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিকনেতা ও ধনকুবেরের দল কেউই জীবন ধারণের নূ্যনতম চাহিদা, প্রাথমিক প্রয়োজন টুকুর কথাও চিন্তা করেননি, চিন্তা করলেন প্রাউট প্রবক্তা,শুধু চিন্তাই করলেন না, বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও দিলেন
বর্তমান সমাজের সর্বস্তরে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তার অন্যতম কারণ কেন্দ্রীত অর্থনীতির বিষময় ফল--- সম্পদের অসম বন্টন ও ধনী-দরিদ্রের সীমাহীন পার্থক্য এই কেন্দ্রীত অর্থনীতির চূড়ায় বসে আত্মনির্ভরতার কথা বলা যতটা সহজ আর সম্পদের ব্যবহারিক নিয়ম প্রয়োগ করে তার সুফল প্রতিটি মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া ততটাই কঠিন
প্রতিটি মানুষকে আত্মনির্ভর করতে হলে, প্রতিটি মানুষের হাতে জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজনটুকু পৌঁছে দিতে হলে বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন কিন্তু দালাল মুনাফাখোর পঁুজিবাদীরা সহজে সেটা মেনে নেবে না, যিনি বড় গলা করে আত্মনির্ভরতার কথা বলছেন তিনিও কিন্তু পঁুজিবাদের প্রতিনিধি তাই আত্মনির্ভরতা রাজনীতির কথা না হয়ে সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে করতে হলে পঁুজিবাদের মিনারে বসে বস্তাপচা তত্ত্ব কথার কচকচানি ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে হবে ও অর্থনীতিকে বাস্তবমুখী করতে হবে
সর্বস্তরের মানুষ, সর্বজীবের সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবেই প্রাউটই দর্শনের প্রবক্তা উন্নত ও বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ দেখিয়েছেন---যা এ যাবৎ প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অর্থনীতির ধারনার মূলেই তিনি নূতন দুটি ধারা যোগ করেছেন যা এতদিন অর্থনীতিবিদদের কাছে অপরিচিত ছিল বর্তমান অর্থনীতিবিদরা মূলত বাণিজ্যিক অর্থনীতি ও কিছুটা সাধারণ অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন আসলে পঁুজিবাদের স্বার্থরক্ষা করতে বস্তাপচা তত্ত্ব কথার কচকচানিই যথেষ্ট সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথা আজ পর্যন্ত চিন্তা করাই হয়নি
প্রাউট দর্শনে প্রথম প্রতিটি মানুষের জীবনধারনের নূ্যনতম চাহিদার কথা বলা হয় ও তা পূরণের জন্যে সুনির্দিষ্ট বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা তৈরী করা হয় এরজন্যে প্রাউট প্রবক্তা অর্থনীতিতে দুটি নূতন ধারা যোগ করলেন--- একটি গণর্থনীতি ও দ্বিতীয়টি মানস অর্থনীতি
মানস অর্থনীতির অধিক গুরুত্ব সেখানে যেখানে জীবনধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের সুব্যবস্থা হয়ে গেছে ও অতি উন্নত অর্থনীতির দেশে ভারতবর্ষের মত দেশে যেখানে মানুষকে নূ্যনতম প্রয়োজনটুকু পূরনের জন্যে হাহুতাশ করতে হয় সেখানে গণর্থনীতির অগ্রাধিকার সবার আগে
গণর্থনীতি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন ও অত্যাবশ্যক জিনিসগুলি যাতে সহজলভ্য হয় সেই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেবে তাছাড়া উৎপাদন, বন্টন, পণন ও বিপণন ব্যবস্থা, মূল্যনির্র্ধরন, বিক্রয় ব্যবস্থা প্রভৃতি দিকগুলি অর্থনীতির এই শাখা দেখবে এককথায় অর্থনীতিকে বাস্তবমুখী করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তার সুফল পৌঁছে দেবার দিকটি এই শাখাই দেখবে তাই অর্থনীতির এই শাখাটির গুরুত্ব সব থেকে বেশী
দেশের মানুষকে আত্মনির্ভর করতে হলে পঁুজিবাদের মিনার থেকে নেমে কেন্দ্রীত অর্থনীতির খোল-নলচে পাল্টে বিকেন্দ্রিত পথে সু-সন্তুলিত সামাজিক অর্থনৈতিক সংরচনা গড়ে তুলতে হবে তারই বাস্তবমুখী পথ হল প্রাউটের সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি-যা গণ অর্থনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়
প্রাউটের অনন্য বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সারা পৃথিবীতে কতকগুলি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে ভারতবর্ষে এইরকম ৪৪টি অঞ্চল থাকবে প্রতিটি অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরী করেছে প্রাউট এই পরিকল্পনাই হল সামাঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি এখানে প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা থাকবে, নূ্যনতম ও অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের ক্ষমতা থাকবে তবেই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হবে
প্রাউটের সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি গড়ে তোলা হবে সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুসারে কতকগুলি শর্তে শর্তগুলি হল--- সম-অর্থনৈতিক সমস্যা, সম-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা,জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য, সাধারণ সাংবেদনিক উত্তরাধিকার ও একই ধরনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রূপায়িত হবে সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় সম্পদের ওপর নির্ভর করে বাহিরে থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর কখনই নির্ভর করবে না পাশাপাশি পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্ব থাকবে স্থানীয় মানুষের হাতে এ সম্পর্কে প্রাউট বলেছে---কোন সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলের সদস্য তাঁরাই হবেন যাঁরা স্থানীয় ভাষায় কথা বলেন ও সেই অঞ্চলে বসবাস করেন যাঁরা সংশ্লিষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁরাই হলেন এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ সস্তায় বহিরাগত শ্রমিক এনে, স্থানীয় ভাষাকে অবদমিত করে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিয়ে আত্মনির্ভরতার কথা চূড়ান্ত ভণ্ডামী ছাড়া কিছু নয় তাই প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় মানুষ ও স্থানীয় সম্পদের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে তবেই প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে
কৃষি ও শিল্পের সমম্বয়ে প্রাউটের এই অনন্য বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে উঠবে ব্লকস্তর থেকে কৃষিকে যেমন উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তেমনি কৃষির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই শিল্পের বিকাশ করতে হবে প্রাউটের এই সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতিতে কৃষি শিল্প ও বাণিজ্যের একটা সুসন্তুলিত অবস্থা বজায় থাকবে তাই প্রত্যক্ষভাবে কৃষিনির্ভর মানুষের হার ৪০ শতাংশের বেশী হবে না সুষ্টু অর্থনৈতিক পরিবেশে কৃষিনির্ভর মানুষের হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকবে তেমনি কৃষি নির্ভর শিল্পে থাকবে ২০ শতাংশ মানুষ ২০ শতাংশ মানুষ থাকবে কৃষি সহায়ক শিল্পে ১০ শতাংশ মানুষ সাধারণ ব্যবসায়ে ও ১০ শতাংশ মানুষ চাকুরীজীবি, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি হিসাবে থাকবে অকৃষি শিল্প (স্টীল প্ল্যান্ট, বাসন শিল্প, ধাতব শিল্প,তৈল শোধনাগার, লবণ শিল্প ও অনুদ্ভিজ ঔষধ ইত্যাদি) নিযুক্ত মানুষের শতকরা হার কৃষি, কৃষিনির্ভর শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্পে শতকরা হার কিছুটা করে কমিয়ে তবে অকৃষি শিল্পে মোট জন সমষ্টির ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে থাকবে হবে এইভাবে একটি সুসন্তুলিত সামাজিক অর্থনৈতিক সংরচনার মাধ্যমে গড়ে উঠবে এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল শতকরা ১০০ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হবে অর্থনীতির এই বাস্তবমুখী পরিকল্পনা রূপায়ণের মাধ্যমে গড়ে উঠবে আত্মনির্ভর ভারত অন্য কোনো পথে সম্ভব নয়
- Log in to post comments