আমার গ্রামে পটোল ঘোষ নামে একজন ঔদরিক ছিলেন৷ নেমন্তন্ন বাড়িতে তাঁর নুচি (নুচি/লুচি দুই–ই শুদ্ধ) খাওয়ার সর্বনিম্ন মান ছিল ১০১৷
পঞ্চাশোর্দ্ধে তিনি দারুণ অম্ল রোগে ভুগতে লাগলেন৷ সঙ্গে সব সময় থাকত সোডি–বাইকার্বের টিন৷ কিন্তু তাঁর অর্জিত চ্যাম্পিয়ানশিপ বজায় রাখার জন্যে নেমন্তন্ন বাড়িতে ১০১–এর একটিও কম নুচি খেতেন না৷ বলতুম ১০১ আবার কেন, ১০০–তেই তো সোজা হিসেব থাকবে৷ উনি বলতেন–১০০টা খেলুম, আর একটি ভবিষ্যতের নিশ্চিততার জন্যে (নিশ্চয়তা’ ভুল) অর্থাৎ ওই একটির মাধ্যমে জানিয়ে দিলুম যে ভবিষ্যতে আরও এক হাজার খেতে পারি৷ এই ভবিষ্যতের জন্যে জানানোকে ‘জানান দেওয়া’ বলে৷
সেকালে নিয়ম ছিল ‘শ্রাদ্ধে চ ভুরিভোজনম্’ অর্থাৎ শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিতদের ভুরিভোজন করাতে হবে৷ ভাবারূঢ়ার্থে ‘ভুরি’ বলা হয় ‘প্রচুর’–কে আর যোগারূঢ়ার্থে তুমি যে পাতে খাচ্ছ তাতে যতগুলি নুচি, যতগুলি রসগোল্লা, যত সের ক্ষীর–রাবড়ি পড়ল তোমার পাশে রাখা আর একটি পাতেও হুবহু সেইসব জিনিস রাখা হবে৷ ভোজনান্তে বিদায় নেবার সময় সেই পাতাটি পুঁটলি বেঁধে বাসায় নিয়ে গেলে তাকে বলা হত ‘ছাঁদা’৷ আকণ্ঠ ভোজনের পর (অর্থাৎ এত ভোজন করা হয়েছে যে উদর–বক্ষ অতিক্রম করে কণ্ঠে এসে পৌঁছেছে) সেই পরিমাণ ভোজ্য যখন ছাঁদা হিসেবে নিয়ে যাবে তখন ধরা হবে তোমার ভুরিভোজন সমাপ্ত হয়েছে৷
সেকালের নেমন্তন্ন বাড়িতে নিয়ম ছিল, কেউ যদি মুখ নেড়ে বলত হুঁ–হুঁ–হুঁ–হুঁ–হুঁ.....কী করছেন........কী করছেন.......আর দেবেন না.......বরং সামনের ভদ্রলোকটিকে দশটি রসগোল্লা দিন, ক্ষুঝতে হবে যিনি ওই কথা বললেন তিনি নিজের জন্যেই দশটা রসগোল্লা চাইছেন ও ছাঁদার জন্যে দশটা রসগোল্লা চাইছেন৷ এই অবস্থায় তাঁকে না বললেও দেবে৷ কেউ যদি বলেন–হাঁ–হাঁ–হাঁ–হাঁ কী করছেন......কী করছেন.....সর্বনাশ করছেন.....বিশটা রসগোল্লা কি আমি খেতে পারি একে ডায়াবেটিস, তার ওপর ডিসপেপ্সিয়া, তার ওপর ক্রণিক ডিসেন্ট্রি, বিশটা রসগোল্লা খাবার সামর্থ্য আমার আছে কি আচ্ছা নেহাৎই যখন না দিয়ে ছাড়বেন না, আপাততঃ পঁচিশটা রসগোল্লা রেখে যান৷
সুতরাং ওইরকম হাঁ–হাঁ–হাঁ–হাঁ করলেও অবশ্যই তাকে দেবে৷ কেউ যদি নিজের পাতা বাঁচিয়ে দু’হাত নাড়তে নাড়তে বলে, করছেন কী করছেন কী আর দেবেন না৷ পনেরটা রসগোল্লা আমি কি খেতে পারি তবে যদি একান্তই না ছাড়বেন তবে এবারকার মত ত্রিশটা ঢেলে দিন৷ পরে আরও পারি তো ভবিষ্যতে দেখা যাবে৷ এইরকম পাত বাঁচিয়ে হাত নেড়ে যদি কেউ মানা করেন তাকেও অবশ্যই দেবে৷ কেউ যদি অসম্মতিসূচক মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন–আর দেবেন না৷ এককালে খেতুম, আজকাল আর পারি না৷ সেকালে বিশটা ক্ষীরমোহন এক গ্রাসেই গিলেছি, আজ কী আর পারি আজকাল পঁচিশটা খেয়েই কাহিল হয়ে যাই ৷ আপনি দশটা দিতে চান......অত পারব না৷ তবে পরীক্ষামূলক ভাবে পঁচিশটা দিয়ে দেখতে পারেন৷ এই অবস্থাতে তাকে পঁচিশটা অবশ্যই দেবে৷ কেবল যদি কেউ বাঘের মত লাফিয়ে উঠে তোমার দু’হাতে চেপে ধরে বলে–আর দেবেন না, আর আমি পারব না, কেবল তাকেই দেবে না৷ সুতরাং পরিবেশনকারীরা এই শ্লোকটি মনে রাখবেন–
‘‘হুঁ হুঁ দেয়ং হাঁ হাঁ দেয়ম৷
দেয়ঞ্চ করকম্পনে
শিরসি চালনে দেয়ং
ন দেয়ং ব্যাঘ্রঝম্পনে৷৷’’
যাই হোক, ঔদরিকতার একটি চিত্র দেখতে পেলে তো৷ ‘ঔদরিক’–এর বাংলা ‘পেটুক’ (বাংলা ‘উক’ প্রত্যয়) ও উত্তর ভারতে ‘পেটু’৷