বিচার–বুদ্ধি–মনীষার্ উন্মেষের ফলে প্রাচীনকালের যে সমস্ত অনুষ্ঠান বা বিধি বর্জিত হয় তাকে ‘ক্রিয়ালোপ’ বলে৷ পরিবেশগত চাপে বা প্রাকৃতিক কারণে যে সকল রীতি–বিরাজ বন্ধ হয়ে যায় তাকেও ‘ক্রিয়ালোপ’ বলে৷ এককালে কুসংস্কারের ফলে ভারতের মানুষ সদ্যবিধবা নারীকে জীবন্ত অবস্থায় স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারত৷ আজ সে প্রথা অবলুপ্ত৷ আমি দেখেছি বর্দ্ধমান জেলার যে সকল গ্রামে তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় মানুষেরা বেশী সংখ্যায় বাস করেন, বিশেষ করে যে সমস্ত গ্রামে ব্রাহ্মণ–কায়স্থের বাস সেই সমস্ত গ্রামে এমন কিছু কিছু জায়গা আছে যাকে বর্দ্ধমানের স্থানিক ভাষায় ‘আগুন–খাকী’ বলা হয়৷ আগুন–খাকী মানে যে সব নারী জীবিত অবস্থায় আগুন খেয়েছিলেন অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় যাদের মুখাগ্ণি হয়েছিল৷ বলা বাহুল্য এই স্থানগুলিতে সতীদাহ করা হয়েছিল৷ আমাদের ছোটবেলায় দেখতুম আমাদের মা–মাসি–পিসিরা সেই সমস্ত জায়গায় গিয়ে সেখানকার মাটি সিঁথিতে ব্যবহার করতেন ও সেটাকে পুণ্য জিনিস বলে মনে করতেন৷
আজ বিচার–বুদ্ধির উন্মেষ হওয়ায় সতীদাহকে বর্বরোচিত বলে মনে করা হচ্ছে ও তাকে বন্ধ করা হয়েছে৷ যদ্দূর মনে পড়ে শেষ সতীদাহ হয়েছিল পটনা জেলার বাঢ়ের নিকটবর্তী স্থানে একটি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ পরিবারে৷ সেই সতী নারীটির দেবর–ভাশুরদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে গেছল ও তখন সেই সেই দেবর–ভাশুরেরা ফেরার হয়েছিল৷ কারণ, জানা গেছল যে তারা সম্পত্তির লোভে ওই নারীকে ওই ভাবে হত্যা করেছিল৷ প্রাচীন মিশরের রাজারা মারা গেলে রাজার সঙ্গে তাঁর সহস্র সহস্র রাণীকেও জীবন্ত সমাহিত করা হ’ত৷ সেই চিত্র আজ শেষ হয়ে গেছে৷
আমার মায়ের ছোট দিদিমা (দিদিমার ছোট বোন) তিন বছর বয়সে বিবাহিতা হয়েছিলেন, বিধবা হয়েছিলেন সাত বছর বয়সে, আর মারা গেছলেন এক শ’ ন’ বছর বয়সে৷ অর্থাৎ এক শ’ ন’ বছর বয়সের মধ্যে এক শ’ দু’ বছর তাঁকে বৈধব্যের ক্লেশ সহ্য করতে হয়েছিল৷ আমি তখন ছিলুম ছোট৷ একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলুম – ‘‘হ্যাঁগো ঝি–মা, তোমার বরের কথা মনে পড়ে?’’
তিনি বলেছিলেন – ‘‘না, আমার একদম মনে নেই৷ আমার শ্বাশুড়ী আমাকে বলেছিলেন, আমরা দু’জনে নাকি লুকোচুরি খেলতুম, আর সময় সময় মারামারি ঘুসোঘুসি করতুম৷ শ্বাশুড়ী এসে আমাদের ছাড়িয়ে দিতেন – একজনকে কোলে নিয়ে খিড়কির দিকে চলে যেতেন, আর পিস্শ্বাশুড়ি এসে আরেকজনকে কোলে নিয়ে সদর দরজার দিকে চলে যেতেন৷ এর বেশী মনে নেই৷’’
জাতিভেদের ফলে তথাকথিত উচ্চবর্ণের পাঁচ/ছ’ বৎসরের ছেলেও তথাকথিত নিম্নবর্ণের আশি বছর বয়সের বৃদ্ধের প্রণাম নেবার জন্যে পা বাড়িয়ে দিত৷ এতে তাদের একটুও বিবেক–দংশন হ’ত না৷ আজ সেই জাতিভেদের সুবিধাবাদী কাঠামোতে ঘুণ ধরেছে, হয়তো যে কোন মুহূর্তে তা’ মড়মড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে৷ এই ধরণের সামাজিক অবিচার বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে ও আজও চলছে – কোথাও ধর্র্মের নামে, কোথাও ঈশ্বরের নামে, কোথাও বা সামাজিক শুচিতার নামে, কোথাও বা দুঃশাসনের ষ্টিমরোলারের ঘর্ঘর ধ্বনির নীচে৷ মানুষের মধ্যে যেমন যেমন বিবেক–বুদ্ধি, বিচার–বিবেচনা জেগে উঠছে তেমন তেমন এরাও অপসৃত হয়ে যাচ্ছে৷ এদের বলা হয় ‘ক্রিয়ালোপ’৷
প্রাকৃতিক চাপে অথবা অন্য কারণে এই ‘ক্রিয়ালোপ’ ঘটতে পারে ও ঘটেওছে৷ আগে জমি–জমা বেচে গরীব মানুষেরা মা–বাপের শ্রাদ্ধ করত৷ আজকাল তা’ বড় একটা করছে না৷ সেক্ষেত্রে ‘ক্রিয়ালোপ’ হয়েছে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে৷ জমি–জমা বেচে ধার–দেনা করে কন্যার বিবাহ দেওয়া আজও চলছে৷ তবে মেয়েদের মধ্যে আরেকটু চেতনা জাগালে, পুরুষদের মধ্যে আরেকটু বিবেক জাগালে ও আর্থিক কাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তন এনে নারীকে স্বয়ম্ভর করতে পারলে কন্যাদায় জিনিসটা আর থাকবে না৷ জাতিভেদ–ব্যবস্থা উঠে গেলেই বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেক সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠবে, অনেক অসুস্থতার ‘ক্রিয়ালোপ’ ঘটবে৷ (‘‘ক্রিয়ালোপ’’, ‘শব্দ–চয়নিকা’, ১১ পর্ব)