বাঙালী জাতির প্রতি অসমের মন্ত্রীর অশালীন মন্তব্যের  প্রেক্ষীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা

লেখক
আচার্য সাত্যাশিবানন্দ অবধূত

অসমের রাজস্বমন্ত্রী ভবেশ কলিতার বাঙালী জাতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক অশালীন মন্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, ঘৃণার বিষয় অসমের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, অসমের রঙ্গিয়া এলাকায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বন্টন করতে গিয়ে অসমের মন্ত্রী ভবেশ কলিতা বলেছেন, বাঙালীরা খচ্চর জাতি।

মানবতার কুলাঙ্গার এই মন্ত্রীর উক্তি বাঙালীদের তো বটেই যে কোনো সভ্য ও ভদ্রমানুষের বিস্ময় উৎপাদন করে সারা অসম তথা সারা দেশ জুড়ে এর প্রতিবাদ ধবনিত হল কিন্তু তবু না ওই মন্ত্রী এর জন্যে ক্ষমা চাইলেন, না অসম সরকার থেকেও কোনো রকম প্রতিবাদ করা হল রাজ্যপাল তথাগত রায় বাঙালী, কিন্তু তিনিও কোনো প্রতিবাদ করলেন না অসমে বিজেপি পরিচালিত সরকার, কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতাসীন কেন্দ্র প্রতিবাদ জানাল না, বা ভবেশ কলিতাকে ভর্ৎসনাও করল না আমরা এর তীব্র  প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

এর সঙ্গে  কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললে নয় এটা সবার জানা যে, বহুকাল পূর্ব থেকেই অসমীয়ারা বাঙালী বিদ্বেষী অসমের প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ এক জনসভায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন অসম রাজ্য শুধু অসমীয়াদের জন্যে স্বাধীনতার পর থেকে দফায় দফায়  অসমে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন হয়েছে ১৯৮৩ সালে অসমে ১৩ হাজার বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে বাঙালী বিদ্বেষী অসম গণ পরিষদের সঙ্গে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর এক বিদেশী বিতাড়ণ চুক্তি  বনগাঁই ও চিরাঙ্গ যাতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চকে ভিত্তিবর্ষ ধরে বিদেশী বিতাড়ণের বেনামীতে ওই বিশেষ বর্ষ ভিত্তির অজুহাত দেখিয়ে বাঙালী বিতাড়ণ প্রক্রিয়া সরকারীভাবে শুরু করা হয়।

অথচ অসমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানতে পারা যায়, আগে অসম বাঙলারই অংশবিশেষ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যখন অসম প্রদেশ তৈরী করল, তখন দেখা গেল নবসৃষ্ট অসমের বার্ষিক আয় অত্যন্ত কম তাই এই নবসৃষ্ট রাজ্যের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার জন্যে বাঙ্লার পুরোপুরি বাঙালী অধ্যুষিত সিলেট, কাছাড় ও উত্তরপূর্ব রঙপুর জেলা ৩টিকে নবসৃষ্ট অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয় রংপুর রইল বাংলায় আর উত্তরপূর্ব রংপুর গেল অসমে এটি একটি  বিসদৃশ ব্যাপার তাই ইংরেজরা  উত্তরপূর্ব-রংপুর জেলার নাম পরিবর্তন করে নূতন নাম দেন গোয়ালপাড়া জেলা সদর থাকে ধুবড়িতে গোয়ালপাড়া জেলাটিকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

(১) ধুবড়ি (২) কোকরাঝাড় ও

(৩) গোয়ালপাড়া বর্তমানে আরও  দুটি জেলা গঠিত হয়েছে  বনগাঁই ও চিরাঙ্গ

এছাড়াও অনেক রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে বর্তমানে যে অসম রাজ্য গড়ে উঠেছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়,এই অসমের নওগাঁ,হোঁজাই লংকা,লামডিং, বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, কাছাড়, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ---এসব প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালী অধ্যুষিত ও মূল বাঙলারই অংশ ছিল বর্তমানে এই এলাকাগুলি অসমের অন্তর্ভুক্ত হলেও বাঙালীরাই এখানকার ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যা।

অথচ এখানকার উগ্র জাতিবাদী অসমিয়াদের ষড়যন্ত্রে বাঙালীদের প্রতি ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষভাব পোষণ করা হচ্ছে বারে বারে  বিভিন্নভাবে বাঙালীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই এলাকায় লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে অনুপ্রবেশকারী ও বিদেশী তক্মা লাগিয়ে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এখনও ১৯ লক্ষ বাঙালীতে এইভাবে এনআরসি থেকে বাদ দিয়ে তাদের রাষ্ট্রহীন করে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে এ সমস্তই অসমের উগ্র জাতীবাদী অসমিয়াদের তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী মানসিকতার প্রতিফলন সম্প্রতি অসমের রাজস্বমন্ত্রী ভবেশ কলিতার তীব্র বাঙালী বিদ্বেষী অশালীন মন্তব্যও এরই প্রতিফলন।

আমাদের বক্তব্য, স্বাধীনতার পর থেকেই যখন আমরা দেখছি, অসমের বিস্তীর্ণ বাঙালী অধ্যুষিত এলাকার ভূমিপুত্র ও ভূমিকন্যা বাঙালীদেরওপর ক্রমাগত বঞ্চনাসহ অকথ্য নির্যাতন অব্যাহত, এই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালীদের স্বাধীকার রক্ষা নিশ্চিত করতে ওই এলাকাগুলি অসম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পশ্চিম বাঙলার সঙ্গে যুক্ত করাই সমীচীন ভারতের সংবিধানের ধারা মেনেই যে আইনে অন্যান্য ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্ঘটিত হয়েছে, ওই একই আইন অনুসারেই  অসমের পূর্র্বেল্লিখিত বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে পশ্চিম বাঙলার সঙ্গে সংযুক্ত করে বাঙালীদের ন্যায্য স্বাধিকার নিশ্চিত করা উচিত।

এর সঙ্গে এটাও উল্লেখ্য উত্তর পূর্বাঞ্চলের অপর রাজ্য মেঘালয়েও বাঙালী নির্যাতন চলছে এর আগে সম্পাদকীয় কলমে এরও  প্রতিবাদ আমরা করেছি অসমের মত মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত গারো পাহাড়ের সমতল  অংশ আর খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশও ১০০ শতাংশ বাঙালী অধ্যুষিত ও  সাবেক বাঙ্লার অংশ যা পরবর্তীকালে মেঘালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে এখানেও বাঙালীরা সমভাবে নির্যাতীত তাই মেঘালয়ের এই বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলিকেও মেঘালয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে অসমের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকার সঙ্গে এগুলিকেও বর্তমান পশ্চিমবাঙলার সঙ্গে যুক্ত করে বৃহৎ বাঙলা গড়ে তোলা উচিত।

এইভাবে পূর্ব ভারতের সমস্ত বাঙালী অধ্যুষিত এলালাগুলিকে এক সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত বাঙালীস্তান অর্থাৎ বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি উত্তর পূর্বাঞ্চলে বাঙালী নির্যাতন বন্ধ করতে ও বাঙালীদের স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এটা খুবই প্রয়োজনীয় মনে করি।

 

কি শিখিব কে শিখাবে

Mantrasiddhananda

দেশের বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারন প্রকৃত শিক্ষার অভাব বিশেষ করে মানুষকে পদে পদে যে সব সামাজিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়   তাকে সামাজিক সংকট না বলে শিক্ষার সংকট বলাই উচিত এরজন্যে প্রধানত দায়ী রাষ্ট্রের শাসকবর্গ ও পলিটিক্যাল নেতারা তথাকথিত সুশীল সমাজ এর দায় অস্বীকার করতে পারে না।

দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে শিক্ষার গবেষণাগারে সরলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের গিনিপিগ বানিয়ে রাজনীতির খেলোয়াড়রা কি খেলা খেলে চলেছে! ৭২ বছরে একটা সুষ্টু ও আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলো না! যে যখন ক্ষমতায় থাকছে ছাত্র-ছাত্রীদের পলিটিকাল পুতুল বানাবার দলীয় কৌশলকে শিক্ষাব্যবস্থা বলে চালিয়ে যাচ্ছে তাই রাষ্ট্রের শাসকদল পরিবর্তন হলেই, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার যে শিক্ষানীতি  ঘোষনা করেছে তাকে আরএসএস দলীয় ছাঁচ বলা চলে।

সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থা (যা এখন ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে) সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন--- শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তবে ছাঁচ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, মানুষের মন যাবে মরে, মানুষ হয়ে যাবে কলের পুতুল সেই কলের পুতুল বানাবার  ছাঁচ বানিয়ে চলেছে শিক্ষাবিধি  নিয়ে দেশের তাবড় রাজনীতিবিদরা বহুভাষা কৃষ্টি সংসৃকতি, আচার আচরণ, চাল-চলন, আহার-বিহার  আদব-কায়দায়  নানা জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষ এখানে একদেশ, একশিক্ষা ভারতবর্ষকে সোভিয়েত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তাই আদর্শ মানুষ নয়, শাসকদলের লক্ষ্য দলীয় কর্মী বানানো সরলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তুলতে সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব মেলাবার কোন প্রয়াস আজ পর্যন্ত হয়নি কোন শাসক দলই করেনি তাই সমাজে এত অসংযমতা, এত উতশৃংখলতা, এত অশালীনতা রাজনৈতিক নেতারা এগুলোকেই মূলধন করে ছাত্র-ছাত্রীদের পলিটিক্যাল পুতুল বানিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে সমাজ কলুষিত হচ্ছে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে দেশ গোল্লায় যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি--- শিক্ষার মূল কথা বিশ্বের সব কিছুর সঙ্গে পূর্ণ যোগ  এই বোধের পথে প্রবৃত্তির অসংযমতা অন্তরায়, রিপুরা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই কথার মধ্য দিয়ে বিশ্ব কবি তুলে ধরেছেন ভারতবর্ষের  শিক্ষার সেই শাশ্বত বাণী--- সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে ভারতবর্ষের সেই শিক্ষায় একজন ছাত্র রিপু ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আত্মসংযমী হবে ও উদার হৃদয়ের বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠবে তাতে কিন্তু  সংকীর্ণমনা, স্বার্থ-লোভ আর দুর্নীতিপরায়ন নেতাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে না তাই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এই দলবাজি ৭২ বছর ধরে হয়ে চলেছে।

সমাজের কোন পক্ষ থেকেই কোন প্রতিবাদ আজ পর্যন্ত হয়নি তথা কথিত শিক্ষিত সমাজ বা সুশীল সমাজ কোন বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতির কথা চিন্তাই করেন নি একমাত্র ব্যতিক্রম আনন্দমার্গ প্রতিবাদে ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তায় নাবেনি আদর্শ শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তৈরী করে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজে নেবেছে আনন্দমার্গ আনন্দমার্গের  কয়েকশো প্রাথমিক সুকল সেই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত করছে যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা ও আধ্যাত্মিক বলে বলিয়ান হয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে আনন্দমার্গের নব্য মানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থা সেই পথ নির্দেশনা দিয়েছে এই নব্য মানবতাবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক সর্বজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন--- প্রকৃত শিক্ষা সেটাই যা একজন ছাত্রকে সাধনা সেবা ও ত্যাগের দ্বারা মহান করে তোলে আদর্শ শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষক যেমন তাঁর সামাজিক কর্তব্যসম্পর্ক সচেতন থাকবে তেমনি ছাত্রের মধ্যে জ্ঞান-পিপাসা জাগাবার গুণও থাকা চাই জ্ঞান অর্জন ও সামাজিক জীবনে সার্বিক সংযম শিক্ষার দায়িত্ব শিক্ষককেই নিতে হবে তবে নৈতিক দায়িত্বের সিংহভাগ অভিভাবকদেরই নিতে হবে তাই আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা ও আদর্শ শিক্ষক নির্বাচন দুটোকেই সমান গুরুত্ব  দিতে হবে,তবেই আদর্শ মানুষ আদর্শ সমাজঘটন সম্ভব আনন্দমার্গে নব্যমানবতাবাদী শিক্ষ্যাব্যবস্থার লক্ষ্য সেটাই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ও নীতিবাদী মানুষরা আর দেরি না করে এগিয়ে আসুন এই শিক্ষাব্যবস্থাকে রূপায়ণ করতে, যাতে আজকে ছোট্ট ছাত্র, শিশুতরু আগামী দিনের মহীরুহ হয়ে ওঠে পাতার স্নিগ্দতায়, ফুলের সৌরভে, ফলের পরিপুষ্টতায়  সমাজকে পরিপুষ্ট করে তোলে।