পূর্ব প্রকাশিতের পর
ফলস্বরূপ পূর্বের বাঙলা ও পশ্চিমের পঞ্জাব রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হল আর লোক বিনিময়ের সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত দেশবাসীর রক্তে দেশের মাটি হলো লালে লাল৷ এত রক্ত সম্ভবতঃ স্বাধীনতা আন্দোলনেও ঝরে নি৷ যদি সেটা হতো তাহলে হয়তো স্বাধীনতা পরবর্ত্তী পর্যায়ে ভারতবাসীর ইতিহাস অনেক বেশী গৌরবময় ও মর্র্যদার হতে পারতো৷ যাই হোক স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে দিল্লীর হিন্দীওয়ালা নেতৃত্ব যে দ্রুততার সঙ্গে পঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলেছিলেন--- পূর্বপ্রান্তের বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বেলায় তাঁদের সেই সদিচ্ছা বা উদ্যোগ কোনটাই পরিলক্ষিত হয়নি৷ কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্যে বাঙালাতে উদ্বাস্তুদের ভাগ্য উপেক্ষিতই রয়ে গেল৷ এমনকি তৎকালীন বাঙলার কংগ্রেস শাসকদের উদ্যোগেও সেই আন্তরিকতা না থাকায় উদ্বাস্তু সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়নি৷ বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে, সুন্দরবনের জঙ্গলে, নদীর তীরে, যত্রতত্র অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত অবস্থায় বাঙালী উদ্বাস্তুদের ভাগ্য নির্ধারিত হতে থাকলো৷ এমনকি স্বাধীনোত্তর ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলির পুনর্ঘটনের সময়ও বাংলা ভাষাভাষী বাঙালীদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি৷ বাধ্যতামূলকভাবে অন্যান্য রাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে৷ বাঙালীর প্রতি বঞ্চনা ও উপেক্ষার ট্র্যাডিশন বর্তমানেও অব্যাহত৷ ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের ‘‘বাংলাদেশী’’ তকমাও সহ্য করতে হচ্ছে৷ সর্বোপরি বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর নেমে এসেছে এন.আর.সি ও সিএএ এর মারণাস্ত্র৷ এন.আর.সির দৌলতে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে অনাগরিক তথা রাষ্ট্রহীন করার চক্রান্ত, ডিটেনশন ক্যাম্পের অমানুষিক চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনা, বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীদের উপর আক্রমণ লুঠ-ধর্ষণ ইত্যাদি চূড়ান্ত অবমাননার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ সারাদেশে বাঙালীদের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও সন্দেহের চোখের দেখার প্রবণতা বেড়েই চলেছে৷
এইরকম এক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সনের বিধানসভা নির্বাচন সংঘটিত হল৷ করোনা অতিমারি জনিত পরিমণ্ডলে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনারের পরিচালনায় প্রায় একমাস ধরে আট দফার নির্বাচন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে যা এককথায় অভূতপূর্ব৷ এরফলে অন্যান্য রাজ্যসহ পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতির চরম অবণতি হওয়ার কারণে বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন৷ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মূলত দুইটি দলের মধ্যে লড়াই সীমাবদ্ধ ছিল---একদিকে আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস আর অন্যদিকে দেশের সর্ববৃহৎ দল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে প্রচারে ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যগণ, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রী ও বিজেপির হেভিওয়েট সর্বভারতীয় নেতৃত্ব৷ বিজেপি দলের সর্বভারতীয় স্তর থেকে একেবারে ব্লকস্তরের নেতানেত্রীদের দুই শতাধিক আসন নিয়ে জয়ের আত্মবিশ্বাসজনিত হুঙ্কার আর বিভিন্ন এজেন্সির নির্বাচন পরবর্ত্তী রকমারি পূর্বভাসকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস দুই শতাধিক আসনে জয়ী হয়ে শাসনক্ষমতায় প্রত্যাবর্ত্তন ঘটাতে সক্ষম হয়৷ তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয়ের বিবিধ কারণের মধ্যে একটি সুনিশ্চিত কারণ হচ্ছে বাঙালী অস্মিতা বা আত্মমর্যাদাবোধের কিছুটা হলেও পূণর্জাগরণ৷ দিল্লী লক্ষ্মৌ থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করা অবাঙালী নেতানেত্রীগণের বাঙালী-বিদ্বেষী মনোভাব, কথাবার্তা, বিভাজনের উস্কানি এন.আর.সি. এন.পি.আর-সিএএ ইত্যাদির হুমকি, ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে সেই নাগরিকদেরই রাষ্ট্রহীন করার ভীতিপ্রদর্শন, স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজনীতির এ-ডাল ও-ডাল করা বাঙালী বাবুদের বয়ানে ডায়লগের ফুলঝুরি বাঙালী জনগণ ভালোভবে গ্রহণ করেনি৷ বাঙালী জাতিসত্তার উপর এই আঘাতই বুমেরাং হয়ে এসেছে ভোটের বাক্সে---যার অভিঘাতে বিজেপির এই ফল, আসনসংখ্যা তিনঙ্কে পৌঁছতে পারেনি৷ বাংলায় একটা কথা আছে---দেখে শেখা আর ঠেকে শেখা৷ বিজেপি নেতৃত্ব সম্ভবতঃ দেখেও শেখেনি বা ঠেকেও শেখেনি৷ তাই অতিসম্প্রতি বেশ কিছু বিজেপি জনপ্রতিনিধি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ বাপুরুলিয়া বাঁকুড়া-মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলা নিয়ে ‘‘জঙ্গলমহল’’ কিংবা নদীয়াকে পৃথকরাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবী জানিয়েছেন৷ এছাড়া কামতাপুর, গ্রেটার কোচবিহার, গোর্খাল্যাণ্ড এইসব ইস্যুগুলি তো রয়েইছে৷ বিজেপি দল হিসেবে ঠিক কি চায় তা স্পষ্ট না হলেও এগুলি যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকে অশান্ত করা, বাঙালী জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে নিশ্চিহ্ণ করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত সেটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷
বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের স্টীমরোলার প্রায় চরমসীমায় এসে পৌঁছেছে--- সহ্যের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে৷ অতিথি বৎসল, ভদ্র, আপাত নিরীহ বাঙালী জাতি ক্ষেপে গেলে কী ভয়ংকর হতে পারে তারপরিচয় তথাকথিত অপরাজেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা টের পেয়েছে৷ বর্তমান ভারতবর্ষের শাসককুল নিজেদের অহংসর্বস্বতাবশত সর্বশক্তিমান মনে করলেও, তাঁরা অপরাজেয় নন৷ ক্ষাত্রতেজে উদ্দীপ্ত বাঙালী জাতি মৃত্যুকে ভয় পায় না---সুভাষচন্দ্র, অরবিন্দ, সূর্য্যসেন, ক্ষুদিরামসহ অজস্র দৃষ্টান্ত জ্বলজ্বল করছে৷ সুতরাং সাধু সাবধান৷
আজ বাঙালীজাতির সামনে দুরন্ত পরীক্ষা---সেই পরীক্ষায় বাঙালী সসম্মানেই উত্তীর্ণ হবে৷ তবে তারজন্যে শুধুমাত্র প্রতিটি বাঙালীকে মনে প্রাণে বাঙালী হয়ে উঠতে হবে৷ রাজনৈতিক দলাদলি ভুলে, ধর্মমত---সম্প্রদায়গত বিভেদ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র বাঙালী পরিচয়েই এগিয়ে আসতে হবে৷ এই লড়াই জাতিসত্ত্বার লড়াই, মাতৃভূমি---মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার লড়াই, বাঙালী পরিচিতি রক্ষার লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই---সমস্ত বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই লড়াই জিততেই হবে--- নচেৎ ভারতবর্ষের বুক থেকে বাংলা ও বাঙালীর নাম চিরদিনের জন্যে মুছে যাবে৷ একজন বাঙালী হিসেবে আমাদের কারোর কাছেই সেটা কাম্য নয়৷ আর এমনটি হলে আগামীদিনের বাঙলার ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না৷ তাই সব বাঙালীকে মনেপ্রাণে বাঙালী হয়ে উঠতে হবে আর মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির মর্যাদারক্ষার শপথ গ্রহণ করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসতেই হবে--- নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়৷
- Log in to post comments