বাঙলার নবজাগরণ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

বাঙালী জাতি আজ নিজেদের গৌরবময় ভাষা-সংসৃকতি সম্পর্কে সচেতন নয়৷ বাঙালীরা আজ বাঙলার মনীষীদের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে৷ আর এটাই বর্তমানে বাঙালী জাতির অবক্ষয়ের প্রধান কারণ৷ একটা জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, তাদের মনীষীদের শিক্ষা তাদের এগিয়ে চলার প্রেরণার উৎসস্থল৷ কিন্তু সেই মনীষীদের স্মরণ করা, তাদের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের শৈথিল্য আজ অত্যন্ত প্রকট৷

২৪শে মে ১৭৭২ রাজা রামমোহন রায়ের জন্মদিন৷ কিন্তু আমরা ক’জন সেকথা মনে রেখেছি৷ রাজা রামমোহন রায় আধুনিক রেণেশাঁর জন্মদাতা৷ শুধু বাঙলার নয়, গোটা ভারতের রেণেশাঁর তিনি অগ্রদূত৷ মধ্যযুগীয় কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস ভাবজড়তা থেকে তিনি দেশবাসীকে টেনে তুলেছেন৷

রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় কীর্তি হিসাবে যা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে, তা হ’ল সতীদাহ প্রথা রদ৷ ভাবা যায়! স্বামী মারা গেলে তাঁর স্ত্রীকে স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হ’ত৷ তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ তথা তথাকথিত অভিজাত সমাজ এই পৈশাচিক কাণ্ডকে সমর্থন করে চলেছিল৷ কিন্তু তরুণ রামমোহন এই দৃশ্য দেখে যারপরণাই বিচলিত হয়ে ওঠেন৷ তারপর সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে---নানান যুক্তিতর্কের অস্ত্র শানিয়ে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেন৷ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরও সহায়তা নেন৷ অবশেষে সতীদাহ প্রথা রদ করার ব্যবস্থা করেন৷

সে যুগে নারী শিক্ষা বলে কিছু ছিল না৷ সমাজের অর্ধেক মানুষকে অন্ধকারে ফেলে রাখা হ’ত৷ এইভাবে তাদের শোষণ করা হ’ত৷ রাজা রামমোহন স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে স্ত্রী শিক্ষার স্বপক্ষে জনমত তৈরী করেন৷

ইংরেজী শিক্ষা যা ভারতীয় যুবসমাজকে কুসংস্কারের গহ্বর থেকে উদ্ধার করে’ তাদের যুক্তিবাদী করে তুলবে, কূপমণ্ডুকতা দূর করে তাদের বিশ্বমুখী করে তুলবে তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তাই ইংরেজী শিক্ষার বিস্তারেও প্রয়াসী হয়েছিলেন তিনি৷

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় সমাজ তখন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত৷ এই কুসংস্কার থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করতে তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ তিনি কুসংস্কারমুক্ত আধ্যাত্মিকতা, যুক্তি ও মানবতাবাদ---এই তিনের সমন্বয়ে বাঙলায় তথা ভারতে রেণেশাঁ বা নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন৷ তাঁর এই নূতন আন্দোলন থেকে জন্ম নিয়েছিলেন এক ঝাঁক উন্নত মনীষী৷ বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন রাজা রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত৷ বাঙলায় ঊণবিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীল চিন্তাধারার নায়কদের অধিকাংশই ব্রাহ্ম মতাবলম্বী বা এর দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত৷

এটা সবার মনে রাখা উচিত, বাঙলার এই যে রেণেশাঁ বা নবজাগরণের কথা বললুম, তার পেছনে ছিল উল্লিখিত তিনটি জিনিস--- কুসংস্কারমুক্ত তথা জাত-পাত-সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ ভাবনামুক্ত আধ্যাত্মিকতা, তার সঙ্গে যুক্তি ও মানবতা৷ এই তিনের সমন্বয়ে যে নতুন আদর্শবোধের নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল তাই এখন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সর্বানুস্যুতত আদর্শ ‘আনন্দমার্গ’ -এর মধ্যে৷ এখানেও এই তিনের সমন্বয়--- কুসংস্কারমুক্ত সর্বজনীন আধ্যাত্মিকতা, যুক্তি ও মানবতা৷ বলা বাহুল্য, এই আধ্যাত্মিকতার সর্বজনীন রূপ নিয়ে হয়েছে নব্যমানবতাবাদ৷ কারণ উদার সর্বজনীন আধ্যাত্মিকতা, যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের ভালবাসা তথা মমতা ও দায়িত্ববোধ কেবল সর্বমানবের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে না, তা বিশ্ব চরাচরে পশুপক্ষী-তরুলতা জড়-চেতন সবার মধ্যে প্রসারিত হয়৷ সবাইকে নিয়ে এক বিশ্ব পরিবারের বোধ জাগিয়ে তোলে৷.......

এই মাসে বাঙলার আর এক মনীষীরও জন্মদিন, তিনি হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷ তাঁর জন্ম তারিখ ২৫শে মে ১৮৮৯৷ নজরুল ইসলামও সমস্ত কুসংস্কার ও জাত-পাত-সম্প্রদায় বোধের ঊধের্ব  ছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন---

‘‘হিন্দু না ওরা মুসলীম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন

কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার৷’’

তিনি বলেছিলেন---

‘‘জাতের নামে বজ্জাতি আজ

জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া....’’

এইভাবে তিনি সমস্ত সংকীর্ণতাবাদকে আঘাত করেছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন, মানুষ আজ আদর্শবাদের দ্বারা দীপ্ত হয়ে সমস্ত জড়তা মুছে ফেলুক, বীর-বিক্রমে এগিয়ে চলুক ক্ষুদ্র, জড়তা ও সংকীর্ণতাকে পায়ে দলে৷ তাই তাঁর কণ্ঠে ধবনিত হয়েছিল---

‘‘বল বীর বল উন্নত মত শির

শির নেহারি নতাস ওই শিরের হিমদ্রির’’

আজ এই মনীষীদের আদর্শবোধের দীপ্ত শিখায় আমাদের প্রাণের প্রদীপকে জ্বালাতে হবে৷ এগিয়ে চলতে হবে সংকীর্ণ স্বার্থবোধ তথা সংকীর্ণতাবোধকে পেছনে ফেলে৷