১লা বৈশাখটাকে হয়তো বা চিনি! তারপর সারা বছর বাংলা মাসের কবে কোন তারিখ বোধ করি বলতে পারব না৷ না, এতে আমার কোন দীনতা নেই! কিংবা আমার দোষও নয়! আসলে ব্যবহারিক জীবনে বাঙলা সাল তারিখের ব্যবহার বর্তমানে নেই বললেই চলে৷ কেবল বাড়ীতে মেয়েরা ব্রত-আচার, পুজো-পাঠ করে তিথি বার দেখে৷ বাঙলায় বড় বড় যে পূজা-উৎসব পালিত হয়, তা সব করে থাকেন পুরোহিতরা পাঁজি পুঁথি দেখে৷ আমরা শুধু কপালে তর্জনী ঠেকিয়ে প্রণাম করি৷ আর একটি দিন শুধু মনে রাখি তা হ’ল ১লা বৈশাখ৷
ফেস বুক, হোয়াটস্ এ্যাপে ক্লিক ক্লিক করে পোষ্ট দিই৷ লাইক করি৷ শুভ নববর্ষ লিখি৷ পান্তা ইলিশের ছবি পাঠাই৷ কলাপাতায়, মাটির সানকিতে ভাত খাই৷ ছেলেমেয়ে নিয়ে মেলায় যাই৷ ব্যস, এইটুকুই৷
---কিন্তু তারপর?
---তার আর পর থাকে না৷
আবার একটি বছরের প্রতীক্ষা!
‘‘ডেরিগেলা বাহিচা হোচিমেলা রাবিরা৷
কৌতাণ্ডে এলাভেস্টা!’’
‘‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে
দেখে যেন মনে চিনি উহারে৷’’
সেই রকম বাঙ্গালীর জীবনে ১লা বৈশাখ আসে চেনা চেনা সুরে৷
কিন্তু কি ছিল চেনা সেই ছন্দ? কেন কেটে গেল তার সুর, তাল, লয়৷ আজ ১লা বৈশাখের দিনে একবার দেখে নেওয়া যাক৷
তিন-তিনটি নদী-সভ্যতার দান পৃথিবীর বৃহত্তর -দ্বীপ াঙলা৷ এর পশ্চিম দিকে আসে প্রাচীন গণ্ডেয়ানাল্যাণ্ডের উত্তর-পূর্ব প্রত্যন্ত রাঢ়ের অজয়, দামোদর, বাঁশ, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদনদীর ধারাপ্রবাহ৷
পূর্ব দিকে আছে হ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া, মেঘনা, কর্ণফুলি প্রভৃতি-নদীর ধারাপ্রবাহ৷
আর মাঝখানে আছে বহমানা গঙ্গা-পদ্মার বিস্তীর্ণ বক্ষ৷ সব মিলিয়ে বিশাল এক বিমিশ্র সভ্যতা, বাঙলার সভ্যতা৷ পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা৷ সুতরাং এর জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাষা-সংসৃকতি, জ্যোতির্বিজ্ঞানও যে খুব উন্নত হবে সে কথা লাই বাহুল্য৷ আর এই ধারাপ্রবাহে বাঙলার বর্ষগণনা পদ্ধতি বেশ প্রাচীন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মত৷
পৃথিবীতে বর্ষগণনা হয় দু’টি পদ্ধতিতে৷ (১) চান্দ্র মাসের হিসেবে, (২) সৌর মাসের হিসেবে৷ চান্দ্র মাসের হিসেবে বছর হয় ৩৫৪ দিনে৷ সৌর মাসের হিসেবের বছর হয় ৩৬৫ দিনে৷ চান্দ্র মাসে দিন কম থাকায় সময়কে সঠিক ভাবে বাঁধা যায় না৷ এতে ধর্ম-কর্মের প্রথা-পদ্ধতি পালনের অসুবিধা না হলেও চাষ-বাস ও রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব অসুবিধায় পড়তে হয়৷ এই অসুবিধা দূর করতে আজ থেকে ১৪২৪ বছর আগে প্রাচীন রাঢ়ের রাজা শালিবাহন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত পাণিগ্রাহীর সহায়তায় সৌর মাসের হিসেবে বর্ষ গণনার পদ্ধতি চালু করেন৷ সেটাই বাঙলার বর্ষ গণনার সূত্রপাত৷ সেই শুরুতে অবশ্য াঙলা বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ৷ যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় মার্গশীর্ষ৷ কেননা ওই সময়ে মৃগশিরা নক্ষত্রে পূর্ণিমার অন্ত হয়৷ বাঙলার বারমাস্যায় আছে ঃ
‘‘অঘ্রাণেতে বছর শুরু নবান্ন হয় মিঠে৷
পৌষেতে আউলি বাউলি ঘরে ঘরে পিঠে৷’’
এতেও কিছু অসুবিধা থেকে গেল৷ কেননা অপরাপর ভারতবর্ষে তখন বৈশাখ মাসেই বছর শুরু৷ অবশ্য তাদের বৈশাখ চান্দ্র-বৈশাখ৷ বিশাখা নক্ষত্রে চন্দ্রের অন্ত৷ সেটারও কিছু অসুবিধা আছে৷ এই সকল অসঙ্গতি, অসুবিধা দূর করতে রাজা শালিবাহন চান্দ্র বৈশাখকে সৌর বৈশাখে আনলেন৷ যুক্তি, ওই সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে৷ সেই সময়ের নিরিখে সৌরবর্ষ গণনা শুরু হ’ল৷ আর এটা চালু করলেন বাঙলার রাজা শালিবাহন৷ তাঁর রাজধানী ছিল রাঢ়ের সিংহপুরে৷ আজ যা হুগলী জেলার সিঙ্গুর নামে পরিচিত৷
কেউ কেউ বলেন---আকবর বাদশাহ প্রথম ফসলি সাল হিসেবে বাঙলা সালের প্রচলন করেন৷ না, সেটা ঠিক নয়৷ আকবর যে ‘ফসলি সাল’ চালু করেছিলেন তা অনেক পরের৷ তিনিও ফসলি খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করতে হিজরী লুনার সালকে সোলার করে দিয়ে ‘ফসলি সাল’ চালু করেন৷ তাঁর সালের---বছরের প্রথম মাস ছিল আশ্বিন৷ সেটা বাঙলায় আউষ ধানের মরসুম৷ পরে অবশ্য আকবরও বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস করে দেন৷ বাংলা সাল গণনা যে আকবরের অনেক আগে তা সময়ই বলে দিচ্ছে৷ কোথায়?
বাঙলা সাল রাজা শালিবাহনের সময় থেকে অর্থাৎ আজ থেকে ১৪২৪ বছর আগে থেকে৷ কেননা বৃহত্তর -দ্বীপ বাঙলার ভাষা, সভ্যতা যে যে বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পঞ্জীকরণ৷ তার ভাষার উচ্চারণ শৈলীতে ‘শ’-এর প্রাধান্য৷ সেদিক থেকেও ফারসী ‘সাল’ নয় বাঙলার জন্যে রাজা শালিবাহনের নামে ‘শাল’ শব্দটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত৷
যাই হোক, বাঙলার জন্যে অন্য কোন সালই আর অবশিষ্ট থাকছে না৷ বৈবহারিক প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে বাঙলা শালও তার ইতিহাস, ঐতিহ্য হারাতে বসেছে৷ একে উদ্ধার করতে হবে৷
শুধু অর্থনৈতিক লেনদেনের হালখাতায় নয়, বাঙালীর সার্বিক জীবনের চালচিত্রের হাল update) ফিরিয়ে৷ আজকের ১লা বৈশাখ হোক সেই নববর্ষের, সেই নব আনন্দের৷
(তথ্যসূত্র ঃ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার---বাঙলা ও বাঙালী৷)
- Log in to post comments