বাঁচিয়ে রেখো

লেখক
আশিস দত্তরায়

কেউ কেউ ব’লে, কতকিছু তো করলে, এবার একটু নিজের কথা ভাবো৷ নিজের ইচ্ছাপূরণ, ছোট ছোট সাধ-আহ্লাদ৷ ভাবি সেভাবে কি আর ভাবতে পারবো? তাই আর ভাবি না৷

খানিকটা বোঝাপড়া, বিনিময়, প্রত্যয় আর ভালোলাগা  মেলাতে পারলেই সবার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়৷

কিশোর কালের শেষ সময়ের স্মৃতি-তেমন বাহারি চোখে পড়ার মত বেশভূষা নয়৷ সাধারণ পোশাক, কাঁচাপাকা চুল,চোখে সাধারণ ফ্রেমের কালো চশমা, শীতে খয়েরী বা কালো সোয়েটার---এই হ’ল কাকু, পাড়ার সবার  বিকাশদার সাদামাটা বিলাস৷ অবসর প্রাপ্ত৷ একা মানুষ, আমাদের চার-পাঁচটা বাড়ীর পরে একটা বাড়ীতে থাকতেন৷

ভোরবেলা উঠে গাছে জল দিয়েই ব্যাগ হাতে বাজারে যেতেন৷ সেটা আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়েই৷ মাঝে মাঝেই দেখা হ’ত৷ আর সাথে  সাথেই আকর্ণ হাসি, ‘‘হ্যালো মি, ইয়ং ম্যান, কেমন আছো? আমিও হেসে জবাব দিতাম,’’ ভালো কাকু আপনি?’’ হাসতে হাসতে বলতেন---‘‘পুরোপুরি জলজ্যান্ত’’৷

আমার দিনে মানুষ আর রাতে আকাশ দেখার নেশা কাকুর জানা ছিল৷ তাই আমায় রহস্য ক’রে কখনো কখনো গ্যালিলিও ব’লে ডাকতেন৷

সেদিন সকালে কাগজের পাতা জুড়ে  নিরাশার খবর৷ অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় দম্পত্রি সন্তান সহ আত্মহত্যা৷ রাজনীতির কারবারিরা কি কি জুয়াচুরি করেছে৷ বাণিজ্য তথা কারবারীদের  কারচুপী, জেল... কাগজ বন্ধ করে চুপ  করে বসেছিলাম৷ কাকুর ডাকে চমক ভাঙল৷ পাশে এসে কাঁধে  হাত রেখে বললেন, ‘‘রাতের আকাশে অন্ধকারে তো তুমি দেখো না গ্যালিলিও, নক্ষত্র খুঁজে বেড়াও৷ তাই তো! কিন্তু  এটাও তো মানতে হবে, রাতের আকাশে তুমি যতখানি দেখো, তার চেয়ে অনেক বেশী না দেখা জগৎ আছে৷ সেসব যদি দেখতে পেতে, জানতে পেতে, তবে গিয়ে কিছুটা জানা হয়৷ তাই না৷ কিন্তু উপায় তো নেই! আমাদের সারাজীবনেও সবকিছু দেখা যাবে না৷ অতএব যেটুকু দেখে ভালো লাগল, ভেবে নিও না দেখা বাকীটুকুতেও তেমনি ভালোটুকুই আছে৷’’

এতটুকু ব’লে কাকু থামলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে  ভেঙে ভেঙে বললেন, ‘‘জানো ইয়ংম্যান, আমি আজকাল ঐ সংবাদপত্র পড়া ছেড়ে দিয়েছি৷ তবে পুরোপুরি নয়৷ হাসির বা বিদ্রুপের গল্প বা রচনা এসব পড়ি, মাঝে মাঝে  কবিতাও... ভালো লাগে পড়তে৷ অন্য লেখা পড়ি না৷ ওসব লেখায়  শব্দের প্রয়োগ, মনস্তাত্ত্বিক চটক, কিছুক্ষণ বাদেই মাথা গরম হয়ে যায়৷ ওসবে নেই কি জানো? পথ৷ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তুমি কোন পথ খুঁজে পাবে না৷ রক্ত গরম করা বিনিদ্র কয়েক রাত্রির জ্বালা-যন্ত্রনা-তোমাকে ক্ষণিক উত্তেজিত করতে পারতে পারলেও উদ্দীপিত করতে পারবে না৷ তার চেয়ে বরং মন খারাপ না করে, চলো আমার সাথে  আজ বাজার৷’’

মাকে বলে রাজি করালাম৷ মা বলল, বিকাশ দার সাথে যখন যাচ্ছিস, একটু সবজীপত্র কিনেই আনিস৷ দুজনে চলেছি বাজার৷ ঢোকার মুখেই বিন্দার চায়ের দোকান৷ কাঠের বেঞ্চে দেখি, কয়েকজন মিলে উত্তেজিত আলোচনায় মগ্ণ৷ এবারে  নির্বাচনে কোন দল আসবে, কাকে ভোট দেওয়া উচিত এইসব৷ সবাই অনেক জানে৷ কেউ কারো চেয়ে কম যায় না, সকলেই যথেষ্ট টাটকা খবর রাখে মনে হল৷ হয়ত শিক্ষিত হলেও হতে পারে৷ রাজনীতি, সমাজনীতি একদম ঠোঁটস্থ৷ কাকু গলা চড়িয়ে বিন্দা দা কে বললেন,’’ বিন্দা চারটে করে দু’জায়গায় লুচি আর আলুর দম দে তো! দোকানের সামনে যে বাপ-ছেলে হাঁ করে বসে আছে, দেখেছিস একবারও৷ মুখ দেখলেই বোঝা  যায় কাল থেকে ওদের পেটে কিছু পড়ে নি৷’’ মুহূর্তে সব আলোচনা বন্ধ৷ লোকগুলো এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে৷ আমার বেশ মজা লাগছিলো৷ কাকুর  কোন ভ্রক্ষেপ নেই৷ লোকগুলো কে পাত্তাই দিল না৷ আলুর দম আর লুচি হাতে দিয়ে বাবাটাকে বললেন,’’ নিরঞ্জন, কাল যে বাড়ীতে যেতে বলেছিলুম কাজের জন্য, গেছিলে এখন তো বসে থাকলে চলবে না আর৷ মাথা নত হ’ল লোকটির৷ নিচু স্বরে বললেন,’’ গিয়েছিলাম বাবা, কালকে যেতে বলেছে৷’’ কাকু আর দাঁড়ালেন না৷

এরপর বাজার শুরু হল৷ সাধারণত আমায় সবজি বাজার করতে হয় না৷ বাবাই সব করেন৷  আমি বেচাকেনা দেখছিলাম৷ কোনও কোনও বিক্রেতা কে বেশ দাপুটে ও প্রতিষ্ঠিত মনে হল৷  সব সবজী যেন সাজিয়ে বসেছেন৷ এরকম একটা দোকানে দাঁড়ালে, সবকিছু কেনা হয়ে যায়৷ কাকু দেখলাম বাজারে বেশ পপুলার৷ সকলেই নমস্কার  করছে, খোঁজখবর বিনিময় চলছে৷ চলতে চলতে  কাকু দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধার কাছে৷ কিছু শাক,দুটি লাউ, একটি কুমড়ো খান কতেক ঝিঙ্গা আর দুটো মোচা নিয়ে বসেছেন৷ কথা শুনে বুঝলাম, বৃদ্ধার ছেলে বাইরে কোথাও কাজের খোঁজে বছর খানেক আগে ঘর ছেড়েছে৷ রেখে গেছে বৌ আর  দুই বছরের ছেলেকে৷ তার কোন খোঁজ আপাতত নেই৷ কাকু একটা লাউ আর একটা মোচা কিনলেন৷ আমায় বললেন, কুমড়ো নিবি৷ বাড়িতে  কাল ছিলো দেখেছি৷ কাকু বললেন খুব মিস্টি, মাসীর নিজের মাচার কুমড়ো৷ কি যেন বুঝে আমি  ঘাড় নেড়ে জানালাম নেবো৷

আরো কিছু বাজার হ’ল৷ ঘরে ফিরে মা কে বললাম, ‘‘কাল থেকে আমি বাজার করব, কাকুর সাথে৷’’ মা দেখলাম আপত্তি করলেন না৷

কয়েক মাস পরে এক রবিবার সকালে কাকু  আসছে না দেখে ওনার বাড়ীতেই গেলাম৷ দেখলাম শুয়ে আছেন৷ গায়ে হাল্কা জ্বর৷ আমায় কাছে ডাকলেন, বসতে বললেন৷ কাজের  মাসীর  পাশের ঘরে কিছু করছিলো৷  আমি খাটের পাশে  বসলাম৷ দেখি পাশে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় খোলা৷ সামান্য কথাবার্তা হলো৷ কাল পরশুর মধ্যে সেরে উঠেই আবার একসঙ্গে  বাজার করা যাবে জানাতে ভুললেন না৷

কিন্তু কেন জানি কাকুর চোখের কোণে একবিন্দু জলও দেখতে পেয়েছিলাম৷ আমার স্পষ্ট মনে আছে৷

মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে চলে গেলেন কাকু৷ সেদিন আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে  ছিলাম তার  খাটের এক পাশে৷ পাশের বাড়ির বোসকাকা বললেন, ‘‘বিকাশের সাবলীল প্রকাশ ওর জীবন যাপনের মধ্যেই ছিল৷ আর কারো মধ্যে দেখলাম না৷ তোমরা যদি পারো, ওকে বাঁচিয়ে রেখো৷’’