বেদ রচনার কাল

ঋগ্বেদ অনেক প্রাচীনকালের৷ তবে জৈনযুগের বেশকিছু পূর্বের কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস বেদের প্রাচীনতম অংশ, মধ্যযুগীয় অংশ ও শেষ যুগের  অংশকে তিনটি পৃথক ভাগে বিভক্ত করে দেন৷ আমি এখানে ‘জৈনযুগের বেশকিছু পূর্বেই’ ব্যবহার করলুম কারণ প্রাকৃত ভাষায় রচিত জৈনশাস্ত্রে বেদগুলির উল্লেখ রয়েছে৷ বেদগুলি রচিত সংসৃক্ত ভাষার প্রাচীন রূপে, জৈন শাস্ত্রগুলি রচিত সংসৃক্তজ প্রাকৃত ভাষায়৷ জৈনধর্মের প্রবক্তা বর্দ্ধমান মহাবীরের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের কিছু পূর্বে আর প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে আনুমানিক চার হাজার বছর থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে৷ তাই বেদের যে অংশ যত অর্বাচীন রূপেই গণ্য হোক না কেন, তা অবশ্যই পাঁচ হাজার বছরের বেশি পূর্বেকার৷ আর জৈনশাস্ত্রগুলি যদি ধরেও নেওয়া যায় তাদের কোন কোন অংশ বর্দ্ধমান মহাবীরের যুগের আগেই অন্য কোন তীর্থঙ্করের দ্বারা রচিত হয়েছিল তাহলেও তা কোনমতেই পাঁচ হাজার বছরের চেয়ে বেশি প্রাচীন নয়৷

ঋগ্বেদের রচনাকাল আনুমানিক গত পনের হাজার বছর থেকে গত দশ হাজার বছরের মধ্যে, যজুর্বেদ আনুমানিক গত দশ হাজার বছর থেকে গত সাত হাজার বছরের মধ্যে আর অথর্ববেদ আনুমানিক গত সাত হাজার বছর থেকে গত পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে৷ সামবেদ কোন বেদই নয়৷ ‘সাম’ শব্দের অর্থ ‘গান’৷ তিনটি বেদেরই সঙ্গীতাংশ নিয়ে পরবর্তীকালে সামবেদ তৈরী করা হয় অর্থাৎ সামবেদ ঋক, যজু ও অথর্ববেদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে৷ বেদের যখন প্রথম বিভাজন হ’ল তখন ঋক্, যজু ও অথর্ব–তিনটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল৷ কিন্তু জৈনশাস্ত্রে সামবেদের উল্লেখ রয়েছে অর্থাৎ জৈনশাস্ত্রের উদ্ভুতিকালে বেদ ত্রিধাবিভক্ত তো অবশ্যই হয়েছিল, তিনটি বেদের সঙ্গীতাংশ নিয়ে সামবেদেরও সর্জন হয়েছিল৷ তবে প্রাচীনকালে লিপি না থাকার দরুণ যেমন বেদ লিখিত হয়নি তেমনি এও হতে পারে যে জৈন তীর্থঙ্করেরা যত প্রাচীনকালের হোন না কেন, তাঁরা তাঁদের বক্তব্য লিপির মাধ্যমে নথিভুক্ত করে যেতে পারেন নি৷ বর্দ্ধমান মহাবীরের সময় লিপির আবিষ্কার হয়েছিল৷ তাই তাঁর সময়ে জৈনশাস্ত্রগুলি লিপিবদ্ধ হয় আর লিপিবদ্ধ হয়েছিল তৎকালীন প্রাকৃত ভাষায়৷

বর্দ্ধমান মহাবীরের জন্মস্থান পূর্ব ভারতের বৈশালী৷ ধর্ম–প্রচারভূমি মগধ ও রাা৷ তাই এটা সহজসিদ্ধ সত্য যে তিনি যা কিছু লিখেছেন বা বলেছেন তা অবশ্যই তৎকালীন প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষাতে৷ তাই জৈনশাস্ত্রের ভাষা প্রাকৃত বললেই যথেষ্ট হবে না৷ প্রাকৃত ছিল মুখ্যতঃ সাতটি৷ জৈনশাস্ত্রের ভাষা ছিল এদের মধ্যে একটি অর্থাৎ মাগধী প্রাকৃত৷

ঋগ্বেদের সময় লিপি ছিল না৷ তাই তা লিখিত হয়নি৷ যজুর্বেদের সময়ও লিপি ছিল না৷ তাই তাও লিখিত হতে পারেনি৷ অথর্ববেদের সময় লিপির সর্জন হয়েছিল৷ কিন্তু যেহেতু বেদের ঋক্ ও যজুঃ অংশ লিখিত হতে পারেনি তাই অথর্ববেদের রচনাকালে.....অর্থাৎ বেদের শেষাংশের রচনাকালে মানুষ ভেবে বসেছিল বেদ হয়তো লিখতে নেই৷ তাই ঋক্ ও যজুঃ অংশের মত অথর্ব অংশও অলিখিতই থেকে গেল৷

অথর্ববেদের আদর্শ পুরুষ (প্রথম প্রবক্তা বা মুখ্য প্রবক্তাকে সেকালে আদর্শ পুরুষ বলা হ’ত) ছিলেন ক্ষ্রহ্মর্ষি অথর্বা৷ সম্ভবতঃ তিনি মধ্য এশিয়ার সন্তান ছিলেন৷ তবে তিনি যে ভারতের অধিবাসী ছিলেন না এমন কথা হলফ করে বলা যায় না৷ তবে অথর্ববেদের শেষাংশের প্রবত্তৃণগণ, বিশেষ করে মহর্ষি বৈদর্ভি যে অবশ্যই ভারতের সন্তান ছিলেন তাতে কোন সংশয় নেই কারণ বিদর্ভ ছিল ভারতেরই মধ্য–পশ্চিমাংশের একটি জনপদের নাম৷

বেদকে মুখ্যতঃ তিন অংশে (ঋক্, যজুঃ ও অথর্ব) ভাগ করায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস বেদব্যাস নামে খ্যাত হন৷ এই ‘ব্যাস’ শব্দটি নিয়ে অনেক মতভেদ আছে৷ ইতিহাসে আমরা ব্যাস নামে অনেক মানুষকে পাই৷ তবে দেখে শুণে এই নিষ্ক্র্ষে পৌঁছোই যে ব্যাস কোন নাম নয়–কুলগত পদবী৷ বাদরায়ন ব্যাস, সঞ্জয় ব্যাস, বিবস্বত ব্যাস–এঁদের সবাইকার পদবী ছিল ‘ব্যাস’–নাম নয়৷ বেদ–বিভাজক ব্যাসের নাম ছিল কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস৷ তিনি প্রয়াগে গঙ্গা–যমুনার সঙ্গমস্থলে জলমধ্য থেকে উত্থিত একটি কৃষ্ণ দ্বীপে (যমুনা–চরের মাটি একটু কৃষ্ণবর্ণের ও গঙ্গা–চরের মাটি হরিদ্রাভ) একটি জলজীবী (কৈবর্ত) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন৷ কৃষ্ণদ্বীপে জাত এতদর্থে লোকে তাঁর নাম রেখেছিল কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ৷ এই কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বা বেদব্যাস ছিলেন মহাভারতের রচয়িতা৷ মহাভারতের রচনাকাল বেদের রচনকালের অনেক......অনেক.......অনেক পরেকার ঘটনা কিন্তু তা অবশ্যই ৩০০০ বছরের বেশী পুরাতন৷