লোভী মানুষের মত লোভী জানোয়ারও কোন কিছু পড়ে থাকলে তা’ তুলে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে৷ এই ধরনের অতিলোভী ও অতিভোজী একটি জীব হচ্ছে নেকড়ে বাঘ যা উত্তর ভারতে লাকড়া বা লকড়বাঘা নামে পরিচিত, কথ্য ৰাংলায় ‘নেকড়ে’, ইংরেজীতে প্সপ্তন্দ্র, সংস্কৃতে ‘বৃক’ বা ‘বৃক–ব্যাঘ্র’৷ নেকড়ে প্রচুর পরিমাণে খায়৷ নিজের প্রয়োজনের তুলনায় চার–পাঁচ গুন বেশী খায়৷ নিজের দৈহিক ওজনের চেয়েও বেশী ওজনের ভোজ্য গ্রহণ করে৷ তারপর কয়েকদিন অসাড় হয়ে পড়ে থাকে, উঠতে–বসতে চায় না৷ তারপর হজম হয়ে যাবার পর আবার গা–ঝাড়া দিয়ে ওঠে৷
ইতোপূর্বে তোমাদের বলেছিলুম মধ্যম পাণ্ডব ভীম অতিভোজী ছিলেন৷ তাঁর চরিত্রের প্রধান দোষই ছিল এই অতিভোজিতা (প্সব্জ্ত্রন্তুন্ব্ধম্ভ – ঔদরিকতা ঃ কথ্য বাংলায় ‘পেটুক’, উত্তর ভারতে পেটু)৷ স্বর্গারোহণ পর্বে তাই দেখা যায় স্বর্গের কাছাকাছি জায়গায় এসে ভীমের যখন পতন হ’ল, মৃত্যুকালে ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন–দাদা, দ্রৌপদীসহ আর তিন ভাইয়ের পতন হয়েছিল বিভিন্ন কারণে...৷ দ্রৌপদীর ত্রুটি ছিল একদেশদর্শিতা৷ পঞ্চপতির পত্নী হওয়া সত্ত্বেও অর্জুনের প্রতি তার টান ছিল বেশী৷ সহদেব, নকুল ও অর্জুনের যথাক্রমে রূপের গৌরব, গুণের গৌরব ও বীরত্বের অহঙ্কার ছিল বেশী৷ কিন্তু আমার কেন পতন হ’ল? তদুত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘‘অতিলোভিতাই তোমার পতনের কারণ৷ ভোজ্যবস্তু (এ প্রসঙ্গে খ্যাটনদাস বটব্যাল স্মর্ত্তব্য৷) পেলে তুমি স্থান–কাল–পাত্র ভুলে গিয়ে ভোজ্য গ্রহণ করতে ও মাত্রাজ্ঞান রাখতে না৷ তোমার পতন হ’ল তাই৷ ভূতিকামী মানুষের তাই উচিত অন্যান্য দোষের সঙ্গে অতিভোজনরূপ (আমাদের বিহারে শিশুকাল থেকে দেখে আসছি এমন কিছু লোক আছেন যাঁরা মানুষ হিসেবে খুবই ভাল কিন্তু নেমতন্ন ৰাড়ীতে পাতে চিঁড়ে [চিউড়া], দই [দহি] ও পেড়া [পেটকাঞ্ছপেডআঞ্ছ পড়লে তখন তাঁদের আর আন্দাজ থাকে না......আন্দাজ মেলে না৷) দোষকেও ত্যাগ করা৷’’
এ কথা ইতোপূর্বে বলেছি যে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালে পাণ্ডবেরা তাঁদের ভিক্ষালব্ধ অন্ন জননী কুন্তীকে এনে দিতেন আর তিনি প্রথমেই তা দু’ভাগে ভাগ করতেন–এক ভাগ কুন্তীসহ চার পাণ্ডবের জন্যে আর অপরাংশ ভীমের জন্যে–
‘‘অর্ধ খান কুন্তীসহ চারি সহোদরে
অর্ধেক বাঁটিয়া দেন বীর বৃকোদরে৷’’
ভীম নেকড়ে বাঘের মতই খেতে পারতেন তাই তাঁকে বলা হত ‘বৃকোদর’৷ এ প্রসঙ্গে তোমাদের ভৈমী একাদশীর কথাও বলেছি৷ একবার ভীমের নজরে এল সমস্ত প্রতিষ্ঠিত মানুষ...সাত্ত্বিক মানুষ একাদশীতে উপবাস করে থাকেন৷ কেউ উপবাস না করলে লোকে জিজ্ঞাসা করে–আপনি কি আজ অসুস্থ?...আপনার বয়স কি বারর নীচে? কিন্তু দ্বাদশোর্ধ্ব হয়েও ভীম একাদশী করেন না৷ এজন্যে ভীম আত্মগ্লানিতে ভুগতে লাগলেন৷ একদিন প্রত্যুষে কুন্তীকে বললেন, ‘‘মা, আমিও আজ একাদশী করবো৷’’
কুন্তী বললেন, ‘‘না বাছা, তোমার আর একাদশী করে কাজ নেই৷ তুমি ক্ষিদে–তেষ্টা সহ্য করতে পার না৷ অনর্থক কষ্ট করৰে কেন?’’
ভীম বললেন, ‘‘না মা, আমি বিশ্বজনকে দেখিয়ে দোৰ, আম্মো পারি৷’’
কুন্তীদেবী বললেন, ‘‘তবে একটু চেষ্টা করে দেখ বাবা, বেশীক্ষণ তিষ্ঠোতে না পারলে আমাকে ৰলো৷ আমি তোমার জলখাবার তৈরী করে রাখৰো৷’’
সূর্যোদয়ের পরেও পাঁচ মিনিট উৎক্রান্ত হয়ে গেল৷
ভীম ৰললে, ‘‘দেখলে মা, সূর্যোদয়ের পর পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল৷ তৰুও আমি তোমাকে বলিনি ‘মা, খেতে দাও’৷
কুন্তী ৰললেন, ‘‘এই জন্যেই তো লোকে তোমাকে মহাবীর ৰলে খাতির করে৷ তুমি কি গায়ের জোরেই শুধু বীর মনের জোরেও যে বীর তা’ প্রমাণ করে দিলে৷’’
সূর্যোদয়ের পর দশ মিনিট কেটে গেল৷ ভীম হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ৰললে–মা, দশ মিনিট পেরিয়ে গেল৷ আমি ডায়েরীতে লিখে রাখলুম, তুমিও লিখে রাখো৷ ভীম ও কুন্তী যথাবিধি ডায়েরীতে তা’ লিখেও রাখলেন৷ ভীম একটু বাড়তি ফোড়ন কেটে বললে–‘‘যদিও একটু একটু ক্ষিদে পাচ্ছে তবু আমার দৃঢ় প্রত্যয় আমি এ ক্ষুধাকে জয় করে নোব৷’’ আবার খানিকক্ষণ বাদে ভীম বললে–‘‘মা, পনর মিনিট হল, আপ্রাণ চেষ্টা তো করলুম ক্ষিদে যেন একটু বেশীই পাচ্ছে, কী করা যায় বল তো’’
কুন্তী বললেন–‘‘কী আর করা যায় ছেলেমানুষ তুমি–ক্ষিদে পেয়েছে, আমি তো আগেই ৰলেছিলুম, তোমার জলখাবার তৈরী করে রেখেছি৷’’
ভীম তখন ৰললে–‘‘তুমি যদি ৰল তাহলেই জলখাবার খাব–না বললে খাব না৷ মায়ের আদেশ তো মানতেই হবে৷ তাই তুমি যদি বল তবেই খাৰ, নইলে খাৰ না৷’’
কুন্তী বললেন–‘‘আমি তোমাকে বলছি, তুমি খাও৷ এতে কোন দোষ হৰে না৷ কথাটা তোমার ডায়েরীতে লিখো না, আমার ডায়েরীতেও লিখবো না৷’’
ভীম তার পরে তাঁর প্রাতঃরাশ সেরেছিলেন সাত মণ খই খেয়ে৷ সেই থেকে সেই তিথিটিকে লোকে ভৈমী একাদশী বলে থাকে৷ কেউ যদি এখনও একাদশীর দিনে লুকিয়ে চুরিয়ে খেয়ে ফেলে কিংবা একাদশী তিথিতে অল্প জলখাবারও খায় (তা পরিমাণে যেমনই হোক না কেন) লোকে ঠাট্টা করে তাকে ভৈমী একাদশী বলে৷
‘‘শয়ন–উত্থান–পাশমো তার মধ্যে ভীমে ছোঁড়া
পাগলার চউদ্দ, পাগলীর আট এই নিয়ে কাল কাট৷
এও যদি না করতে পারিস ভগার খাদে ডুবে মরিস৷’’
শয়ন–একাদশী (জগন্নাথের শয়ন), উত্থান–একাদশী (জগন্নাথের রোগ থেকে উত্থান), পার্শ্ব–একাদশী (কলমীশাকের বিছানায় পটোলের ৰালিশে জগন্নাথের শয়ন), ভৈমী একাদশী (ভীমের একাদশী ব্রত উদ্যাপন), পাগলার চউদ্দ (অর্থাৎ শিব চতুর্দশী), পাগলীর আট (মহাষ্টমী)–এগুলি প্রাচীনকালে অবশ্য পালনীয় ৰলে গণ্য করা হত৷ ৰলা হত এইগুলিও যদি না করতে পার তবে ভগার খাদে......অর্থাৎ রাজা ভগীরথ যে খাল কাটিয়েছিলেন সেই খালে অর্থাৎ ভাগীরথীর জলে ডুৰে মর অর্থাৎ সেখানে যেন শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়৷