চন্দননগরে এলো জগদ্ধাত্রী

লেখক
প্রণবকান্তি  দাশগুপ্ত

১৮২০ সালের মে মাসের শ্রীরামপুরের মাসিকপত্রিকা The friend of india যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় ৩০ বছর আগে শান্তিপুরের কাছাকাছি গুপ্তিপাড়ার গ্রামে ব্রাহ্মণরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্রথম বারোয়ারী জগদ্বাত্রী পূজার আয়োজন করেন৷ এই পত্রিকার অনুমান অনুযায়ী জগদ্বাত্রী পূজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ৷ প্রসঙ্গতঃ বলা আবশ্যক, গুপ্তিপাড়ার মুখোপাধ্যায়ের জিম্মা থেকে একটি জগদ্বাত্রী পুজোর দ্বিতীয়বর্ষের ফর্দ পাওয়া গেছে৷ সেই ফর্দ অনুসরণ করে দেখা গেছে প্রথম বছরের পুজো সংঘটিত হয় ১৭৫৯-৬০ সালে৷ অর্থাৎ ‘দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া যে পুজোর হদিশ দেয় তারও ত্রিশ বছর আগে জগদ্বাত্রী পুজো হয়েছিল৷  তবে সেটা ছিল পারিবারিক পুজো৷ বারোয়ারী জগদ্বাত্রী পূজার প্রচলন করেন গুপ্তি পাড়ার ব্রাহ্মণরা৷

গুপ্তি পাড়ায় জগদ্বাত্রী পুজো উপলক্ষ্যে সে সময় নানা স্থান থেকে গানের ওস্তাদরা নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন৷ সারা দিন গানবাজনা উৎসবে গুপ্তিপাড়া মুখরিত হয়ে থাকতো৷ ও দিকে  মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দৌলতে কৃষ্ণনগরে জগদ্বাত্রী পূজো হতো খুব জাকজমক ধূমধাম সহকারে৷  আবার এদিকে চন্দননগরের জগদ্বাত্রী পুজোর তো ভারত জোড়া খ্যাতি৷ প্রশ্ণ হচ্ছে, চন্দননগরে জগদ্বাত্রী এলেন কিভাবে?

মুর্শিদাবাদের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সেবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরে ফিরে এলেন কোজাগরী পূর্ণিমার পরে এপ্রসঙ্গে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---

‘‘তিনি বললেন, স্বপ্ণে তিনি এক দেবীমূর্ত্তি দেখেছেন৷ রাজার মুখ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেল তা তন্ত্রোক্ত রাজরাজেশ্বরী বা ষোড়শী দেবীর সঙ্গে মেলে যা হিন্দু ও মহাযানী বৌদ্ধ উভয়তন্ত্রেই স্বীকৃতা৷ তখন তিনি ঘটা করে এই পূজো করলেন---দেবীর নাম রাখলেন জগদ্বাত্রী৷ পূজোটি অনুষ্ঠিত হল দূর্র্গপূজা অনুষ্ঠিত হবার ঠিক এক মাস পরের শুক্লপক্ষে তোমরা ডি.এল.রায়ের ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ কবিতাটিতে ‘জগদ্বাত্রী’ শব্দের উল্লেখ পেয়েছে (‘জগদ্বাত্রী’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে জগতের যিনি ধাত্রী---) কিন্তু ডি.এল.রায় ‘জগদ্বাত্রী’ শব্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সম্ভবতঃ তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এই কারণে৷ তাছাড়া তাঁর পিতা কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন নদীয়া এষ্টেটের দীবান৷  যাই হোক, কৃষ্ণনগরের জগদ্বাত্রী পূজোর এই ধূমধাম দেখে সেই সময়কার নদীয়া এইটের দীবান সম্ভবত গঙ্গা গোবিন্দ বন্দোপাধ্যায় নিজের শহর চন্দননগরে এই পূজোর  প্রবর্তন করেন৷ তবে কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্বাত্রী পূজার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে কৃষ্ণনগরের পূজার সংখ্যা ছিল বেশী, জাঁকজমকও বেশী, কিন্তু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী ছিল অকি বৃহদাকারের৷ এটাই চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীর মুখ্য বৈশিষ্ট্য৷..               (শব্দ-চয়নিকা, ৮/০২)

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, চন্দননগরের নামের উদ্ভব প্রসঙ্গে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘এখন যে জায়গাটার নাম চন্দননগর এক সময় সেখানে ‘চন্দ্র’ পদবীধারী বাঙালী সুবর্ণবণিকদের বাস ছিল৷ তাই নাম হয়েছিল ‘চন্দননগর’৷ ....চন্দনের সঙ্গে শহরটির নামের কোন সম্পর্ক নেই৷’’ (বর্ণবিজ্ঞান)৷