প্ৰাক স্বাধীন কাল থেকে অসম নামের ভূখণ্ডে বাঙালিদের যে নানা ধ্বনের নিৰ্যাতন সইতে হচ্ছে, সেটা বাঙালি মাত্ৰেই জানা রয়েছে ৷ দেশ বিভাজনের পর বিদেশীর তকমা লাগিয়ে অখণ্ড ভারতের বাসিন্দা বাংলাভাষীদের ওপর অত্যাচারের মাত্ৰা যে বহু গুণে বেড়েছে, তাও অসমে বহুল চৰ্চিত৷ আহোম রাজত্ব, ব্ৰিটিশ শাসনের সময়কাল থেকে যে ভূখণ্ডের শিক্ষা-সংস্কৃতির উত্তরণ, সরকারি চাকরি থেকে কৃষি, কৰ্মতৎপরতা গড়ে তোলায় বাঙালিদের অনবদ্য অবদানের সাক্ষী এরাজ্যের ইতিহাস, সেখানে বাংলাভাষী মাত্ৰেই আজ নিৰ্যাতনের শিকার৷ কখনও বিদেশী সন্দেহে, কখনও ঘাড়ে বিদেশীর মামলা চাপিয়ে রাষ্ট্ৰের সব নাগরিক-সুবিধা হরণ করে, কখনও বিদেশী ঘোষণা করে, কখনও আবার ডিটেনশন ক্যাম্প নামের ‘হিটলারি ক্যাম্পে’র অন্ধ কুঠুরিতে গলা ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিয়ে৷ শেষ পৰ্যন্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি থেকে নাম ছেঁটে ফেলে বাঙালি জাতির মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথটাই রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ নানা ছুতোয় নাগরিকত্ব হরণের চক্রান্ত চলছে অবিরত৷ তাই বাঙালিদের দুৰ্দশা নিয়ে অনেককেই এখন কথা বলতে দেখা যায়৷ কিছু সংগঠনও মাঝেমধ্যে সরব হয় নিজেদের দেশেই ছিন্নমূল বাংলাভাষীদের এহেন কণ অবস্থা নিয়ে৷
সমস্যা হচ্ছে, অসমে বাঙালি জাতিটার এই দুৰ্দশার শেকড়টা কোথায় লুকিয়ে রয়েছে, সেটা জানা নেই প্ৰায় সিংহভাগ লোকেরই ৷ প্ৰাক-স্বাধীন বিট্ৰিশ জমানা পেরিয়ে স্বাধীনোত্তর যুগে অসমে বাঙালিদের কোণঠাসা করার প্ৰয়াস কোথা থেকে শুরু হয়েছে, নেপথ্যে কী রয়েছে, এসব চৰ্চার ধারেকাছেও নেই কেউ৷ কিংবা অসম নামের ভূখণ্ডে বাঙালিদের অস্তিত্ব কতটা সবল, অন্যান্য উপজাতিদের মতো বাঙালিরাও যে এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা, অসমে বাংলাভাষীদের আগমন, অসমিয়া জাতি গঠনে তাদের অবদান, সে সব জানতে হলে ইতিহাসের পাতা উাতে হবে৷ কারণ, জাতীয় অবমাননা প্ৰতিহত করতে গেলে নিজেদের অস্তিত্বকে জানতে হবে, গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে ৷ অনৰ্গল মিথ্যে প্ৰচার, অপবাদের যোগ্য জবাব দিতে গেলেও জানতে হবে নিজেদের অতীত, আত্মপরিচয় ৷
গাদা গাদা ইতিহাসের বই পড়া বা এতে সময় ব্যয় করার আগ্ৰহ বা সুযোগ ক’জনের থাকে৷ সেখানেই কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছেন বিধান চন্দ্ৰ পুরকায়স্থ৷ ‘আসামে বাঙালি সমাজ ইতিহাস রাজনীতি’ নামে তাঁর রচিত গ্ৰন্থে অসমে বাঙালিদের দুঃখ-দুৰ্দশার কারণ, নেপথ্যে রাষ্ট্ৰের ষড়যন্ত্ৰ, ইতিহাস লব্ধ বাঙালির অস্তিত্ব সবই ফুটে উঠেছে৷ বিদেশী, অনুপ্ৰবেশকারীর অপবাদ সেঁটে দেওয়া অখণ্ড ভারতের আদি বাসিন্দা ছিন্নমূল বাঙালি-মনের আৰ্তনাদও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন লেখক৷ দেশ স্বাধীনে যাদের ভূমিকা আজও কেউ অস্বীকার করতে পারে না, শেষ পৰ্যন্ত দেশের বিভাজন সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে সেই বাঙালিদেরই৷ পঞ্জাবি সহ মুষ্টিমেয় আরও কিছু জাতিকেও দেশ বিভাজনের ক্ষতি সইতে হয়েছে৷ রাষ্ট্ৰ উদ্যোগী হয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছে অনেকাংশে৷ আশ্ৰয় দেওয়া হয়েছে, নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে৷ দেশ বিভাজনে ভিটেচ্যূত বাঙালিদের প্ৰতি নৈতিক দায়িত্ব যে পালন করেননি রাষ্ট্ৰনেতারা, তাদের আশ্ৰয় দেওয়া, নাগরিকত্ব দেওয়ার যে হয়েছে পদে-পদে, সেটাও মৰ্মেমৰ্মে উপলব্ধি করেছেন লেখক ৷
তাই বইয়ের মুখবন্ধে তপোধীর ভট্টাচাৰ্যের মতো বিদগ্ধ ভাষাতত্ত্ববিদ লিখেছেন, ‘দুঃসময়ের দস্তাবেজ কীভাবে রচিত হলে বিপন্ন বাঙালি খুঁজে পাবে তার আত্মমৰ্যাদার তাৎপৰ্য, সুলিখিত এই বইয়ে এর প্ৰমাণ রয়েছে৷’ প্ৰখ্যাত ইতিহাসবিদ জয়ন্তভূষণ ভট্টাচাৰ্য বলেছেন, ‘যাদের জন্য নিবদ্ধগুলি লেখা হয়েছে, তাঁরা সকলে বইখানা পড়ুন, পড়ান, পৰ্যালোচনা করুন এবং প্ৰকৃত সত্য প্ৰতিষ্ঠিত হোক৷ ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই সংশ্লিষ্ট সব সমস্যার সমাধান করতে হবে৷’ বইটি পড়ে আমার উপলব্ধিও সেটাই৷ অসমের ভুক্তভোগী বাঙালিদের সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সম্যক ধারণা পেতে হলে সকলেই যেন বিধানচন্দ্ৰ পুরকায়স্থের বইটি পড়ে নেন৷ সঙ্কটাদীৰ্ণ বাঙালিদের ঘরে-ঘরে যেন অবশ্য পাঠ্য হয়, অন্তত যাঁরা বাঙালিদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, দুৰ্ভোগ নিয়ে সরব হন, তাঁদের পড়ে নেওয়া উচিত৷ ইতিহাস সম্বলিত নিজেদের অতীতটা জেনে নিলে এবং সমস্যার গভীরে ঢুকতে পারলে রাষ্ট্ৰের নিপীড়ন, অবমাননা, অপপ্ৰচারের জবাব দেওয়াটাও সম্ভব হবে ৷
ইতিহাসের জ্ঞান না রইলে এটা বোধহয় জানা সম্ভব নয় যে অসমিয়া সমাজের প্ৰাণপুষ মহাপুরুষ শ্ৰীমন্ত শঙ্করদেবের পূৰ্বপুরুষরাও গৌড় দেশ থেকে আগত বাংলাভাষী ছিলেন এবং তাঁর প্ৰারম্ভিক শিষ্যদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালি ৷ অন্তত পদবি দেখে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ ইতিহাসের সাক্ষ্য রেখে সে সব বৰ্ণনা করেছেন লেখক ৷ একইভাবে বংশানুক্রমে আহোম রাজাদের আমলে কীভাবে বঙ্গদেশ থেকে দফায়-দফায় বিভিন্ন কারণে বাঙালিদের নিয়ে এসে এই ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, বাঙালি ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিত, রাজমিস্ত্ৰি, সকলেই ছিলেন সেই আমদানির তালিকায়৷ কৰ্মদক্ষ বাঙালিদের আনা হয় আহোম রাজত্বে সড়ক নিৰ্মাণের জন্য, এমনকি সৈন্যসামন্ত হিসাবেও আসেন অনেকে৷ ফলে অসমে বাঙালি যে অনুপ্ৰবেশকারী নয়, ঐতিহাসিক সত্যতা তুলে ধরে সেটা প্ৰমাণ করে দেখিয়েছেন লেখক৷ আহোম শাসনকাল থেকে যাঁদের স্থায়ী বসবাস এই রাজ্য, মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার অপরাধে তাঁরাও এখন বিদেশী, অনুপ্ৰবেশকারী ৷ ভূমিপুত্ৰ বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, আদতে তাঁদের অস্তিত্ব, প্ৰভূত্ববাদের দাবি কতটা শক্তিশালী, ইতিহাসের পাতায় সেটাও চেষ্টা করেছেন লেখক৷
বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, পেশায় এক জন টেক্সটাইল টেকনোলজিস্ট, বিধানবাবু কলম ধরেছেন বাঙালির জাতিসত্ত্বার কথা ভেবে৷ মানবতা বিপৰ্যস্ত, বিপন্ন হওয়ার প্ৰতিবাদ করেছেন কলমের শক্তিতে৷ শিলচরে থাকাকালীন বরাকের বিভিন্ন পত্ৰ-পত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে তাঁর বলিষ্ঠ লেখনি, আজও যার প্ৰাসঙ্গিকতা হারায়নি৷ অসমে ভাষিক সংখ্যালঘুদের অধিকার প্ৰতিষ্ঠায় বিভিন্ন প্ৰচেষ্টায় অংশ নিয়েছেন তিনি৷ বাঙালির জাতিসত্ত্বার সংগ্ৰামে তাঁর লড়াই শেষ হয়ে যায় ২০০৭ সালের ৭ মাৰ্চ, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিধানবাবু৷ মৃত্যুর প্ৰায় পনেরো বছর পর বিধানবাবুর পুত্ৰ বিধায়ক দাস পুরকায়স্থের উদ্যোগে এই বইটি প্ৰকাশ পেয়েছে৷ কারণ, বাঙালিরা আজও অসমে আত্মপরিচয় প্ৰতিষ্ঠা করতে পারেনি বা প্ৰতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়নি বলে জীবিত থাকাকালীন বিধানবাবুর উপলব্ধি, লেখনি আজও সমান প্ৰাসঙ্গিক৷
‘আসামে বাঙালি সমাজ ইতিহাস রাজনীতি’ শীৰ্ষক ৯৬ পৃষ্ঠার বইটিতে বিভিন্ন সময়ে বিধানবাবুর লেখা মোট আটটি নিবন্ধ প্ৰকাশিত হয়েছে, যার প্ৰতিটিতে ফুটে উঠেছে জাতির আত্মপরিচয়, ঐতিহাসিক সত্যতা অষেণের চেষ্টা৷ ‘বিদেশীর জবানবন্দি’তে রয়েছে ছিন্নমূল বাঙালিদের আৰ্তনাদ, মিথ্যে অপবাদ, অপপ্ৰচারের জবাব৷ রাষ্ট্ৰের ষড়যন্ত্ৰ, নিপীড়নের করুণ চিত্ৰও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে প্ৰতিটি নিবন্ধের শক্তিশালী লেখনিতে, অসমে হতভাগা বাঙালি আজও যার শিকার হয়ে চলেছে৷ ফলে বাবার লেখা নিবন্ধের সংগ্ৰহ প্ৰকাশ করে মৃত্যুর পরও নিৰ্যাতিত ছিন্নমূল বাঙালিদের জন্য বিধানবাবুর লড়াইকে জিঁইয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন বিধায়ক৷ তাই বইটি পড়ে ইতিহাসবিদ জয়ন্তবাবুর কথায় বলতে হচ্ছে, ‘উত্তর-পূৰ্বের বাঙালি হিসাবে বিধানবাবুর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা অসীম ৷
- Log in to post comments