গুপ্তযুগের সবচেয়ে ৰড় রাজা ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত৷ কিন্তু গুপ্তযুগের কথা বলতে গিয়ে যে নামটি প্রথমেই ভেসে ওঠে তিনি চন্দ্রগুপ্ত৷ যদিও সমুদ্রগুপ্ত দিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন, ....ভারতে এক অতি ক্ষৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন....সাংসৃক্তিক জীবনে বিরাট পরিবর্ত্তন এনেছিলেন কিন্তু গুপ্তযুগের অনল–পুরুষ ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত৷ তাঁর প্রজা–প্রীতি ছিল ইতিহাসপ্রসিদ্ধ৷ তাঁর প্রেরণা ও প্রচেষ্টাতেই সংসৃক্ত ভাষা নবজীবন লাভ করেছিল৷
চন্দ্রগুপ্তের কথা বলতে গিয়ে একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল৷ কালিয়া নামে ৰাঙলায় একটি গ্রাম আছে৷ গ্রামটি অত্যন্ত শিক্ষিত৷ এমন গ্রাম পৃথিবীতে আর দু’টি আছে কিনা সন্দেহ৷ কালিয়ার কাছাকাছি গ্রাম ৰাদিয়া৷ সে গ্রামটিও ক্ষেশ শিক্ষিত৷ একবার কালিয়ার ছেলেরা কোনো এক উৎসব উপলক্ষ্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক মঞ্চস্থ করবার তোড়জোড় চালাচ্ছিল৷ বিভিন্ন ভূমিকার জন্যে উপযুক্ত অভিনেতা/অভিনেত্রীর খোঁজ চলছিল৷ এমন সময় দূর গাঁয়ের একজন অপরিচিত মানুষ ..... নাম তাঁর সম্ভবতঃ দশমিকরঞ্জন দাশগুপ্ত ....ঝড়ের কাকের মত অথবা ভগ্ণদূতের মত এসে কর্মকর্তাদের বললে–‘‘আমারে এ্যাকডা পার্ট দ্যাৰা না?’’
কর্মকর্তারা শুধোলেন–কেমন পার্ট চান? দশমিক বললে–ক্যাৰোল রাজার পার্ট করমু৷ স্যানাপতি কিংবা সাকর–নফরের পার্ট করমু না৷...কোন্ নাটক অইত্যাসে?
কর্মকর্তারা বললেন–‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক হচ্ছে৷ এ নাটকে দু’জন রাজা আছেন–চন্দ্রগুপ্ত ও আলেক্জাণ্ডার৷
দশমিক বললে–‘‘আলেক্সাণ্ডার নামডা উস্সারণ করা শক্ত৷ আমারে সন্দ্রগুপ্তের পার্টডা দ্যাৰানি?’’
কর্মকর্তারা বললেন–‘‘আচ্ছা, তাই হবে৷ আপনি পারবেন তো’’
দশমিক বললে–‘‘হ, পারমু৷ আমি পারমু না তো পারক্ষ ক্যাডা? আমারে পার্টডা লিখায়ে দ্যাবানি৷ রিহার্স্যালের দরকার পরক্ষ না৷ এক্কেরে ষ্ট্যাজে আইস্যা দিখায়ে দিমু এ্যাক্টিং কারে কয়৷’’
* * *
নাটকের পুরোদমে রিহার্স্যাল চলছে৷ আলেক্জাণ্ডারের ভূমিকায় যিনি নাক্ষছেন তাঁকে স্মারক ত্নব্জপ্সপ্পহ্মব্ধন্দ্ বলছেন–বলুন, ‘‘সত্যই সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ’’৷ এমন সময় হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে দশমিক এসে হাজির৷ সে বললে–‘‘এ্যাডা কতা জিগাই৷ সন্দ্রগুপ্ত কোন দ্যাশের রাজা সিল?’’
কর্মকর্তারা বললেন–‘‘মগধের৷’’
দশমিক শুধোলে–‘‘মগধ আমাগো কাইল্যা–ৰাইদ্যা তাইক্যা ক্ষর না সোট?’’
কর্মকর্তারা বললেন–‘‘দেখুন, আমাদের কালিয়া–ৰাদিয়া তো গ্রাম .....আর মগধ একটা দেশ–প্রকাণ্ড দেশ’’
দশমিক বললে–‘‘হ ক্ষুসসি৷ পার্টডা ৰালোই৷’’
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ৷ স্মারক চুপ করে বসে আছেন৷ অভিনেতা /অভিনেত্রীরাও চুপ করে বসে আছেন দশমিক কী বলছে তা শোনবার জন্যে৷
দশমিক বললে–‘‘সন্দ্রগুপ্ত ....... সন্দ্র........... গুপ্ত............ সন্দ্র............. গুপ্ত.............. সন্দ্রগুপ্ত৷ আচ্ছা, সন্দ্রগুপ্ত স্যানগুপ্ত না দাশগুপ্ত?’’
কর্মকর্তারা বললেন–‘‘সেনগুপ্তও নয়, দাশগুপ্তও নয়, কেবল গুপ্ত৷’’
দশমিক বললে–‘‘ক্যাৰোল গুপ্ত তবে তো নীস্ বৈদ্য......ক্যাৰোল গুপ্ত অইলে তো নীস্ বৈদ্য অয়.....তবে ও পার্ট করমু না.......করমু না.....করমু না৷ আমারে আলেক্সাণ্ডারের পার্টডা দ্যাৰা৷’’
‘‘কী সুন্দর পার্ট আহাহাহাহা কী সুন্দর কতা আহাহাহাহা হইত্তোই ছেলুকাছ, কি ৰিসিত্র এই দ্যাশ হুইন্যা মন–প্রাণ ছীতল অইয়া জায়’’
উপস্থিত ৰুদ্ধি
‘তন্’ ধাতুর অর্থ হ’ল ৰেড়ে যাওয়া, অভিব্যক্ত হওয়া৷ যে মানুষ তার ভাবধারাকে নাচে–গানে অভিনয়ে–আবৃত্তিতে অভিব্যক্ত করতে পারে তার জন্যে ‘তন্’ ধাতু+ড প্রত্যয় করে ‘ত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়৷ তাই এক্ষেত্রে ‘ত’–শব্দের একটি অর্থ হ’ল ণট বা অভিনেতা৷
অভিনেতার মধ্যেও অনেক সময় অদ্ভুত রকমের উপস্থিত ৰুদ্ধি দেখা যায়৷ সে বিচারে তিনি দু’দিক দিয়েই ‘ত’৷ অভিনয় জগতের ‘ত’–এদের উপস্থিত–ৰুদ্ধি সম্ক্ষন্ধে বা উপস্থিত ৰুদ্ধির স্বভাব সম্ক্ষন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে৷ দু’একটি গল্প তোমাদের শোনাচ্ছি ঃ
সেটা তখন ইংরেজ আমল৷ আমি তখন দিনাজপুরে৷ উত্তর ৰাঙলার অন্যান্য শহরের মত দিনাজপুরও একটি মাঝারি রকমের ছিমছাম শহর ছিল৷ শহরটি ছিল আমার খুব প্রিয়৷ দিনাজপুর–বাসীর স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য আমার খুবই ভাল লাগত৷ ওঁরা*(*ওনারা, যেনারা, তেনারা শব্দগুলি গ্রাম্য দোষে দুষ্ট৷ ওঁরা, যাঁরা, তাঁরা–ই শুদ্ধ ওনারা, যেনারা, তেনারা না লেখাই ভাল৷) ছিলেন খুবই নাচ–গান–ভিনয় প্রিয়৷ সেকালে স্থায়ী অভিনয়মঞ্চ কোলকাতার বাইরে আর কোনো শহরেই ৰড় একটা ছিল না৷ কিন্তু দিনাজপুরে তা–ও ছিল৷ কয়েকজন স্থানীয় অভিনেতা তখন রীতিমত প্রথিতযশা হয়ে পড়েছেন৷ কেবল শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলের দিকেও থিয়েটারের রমরমা৷ সেই সময়টায় ওই দিকটায় ‘সীতা’ নাটকটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ সীতার ভূমিকায় অভিনয় করে যিনি দু’হাতে যশ কুড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম ছিল সম্ভবতঃ আব্দুল লতিফ৷
সীতা নাটকের অভিনয় চলছে৷ শহরে হাজার হাজার গোরুর গাড়ীর ভীড়৷ গ্রামের লোক ঝেঁটিয়ে এসেছে অভিনয় দেখতে৷ হাতে পাট বেচার তাজা টাকা৷ দরকার পড়লে অভিনয়ের জন্যে ক্ষেশ কিছু খরচ করতেও তৈরী৷
অভিনয় চলছে৷ নাটক তার চরম স্তরে (climax) এসে পৌঁছেছে৷ এবার সীতার পাতাল প্রবেশ৷ ধরিত্রী মাতাকে সম্বোধন করে সীতাকে যা বলতে হবে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে–‘‘মাতঃ বসুন্ধরে, দ্বিধা হও, আমি তোমার স্নেহময় অঙ্গে স্থানলাভ করি’’৷ আব্দুল লতিফে.র নাটকের ভাব ষোল আনাই জানা, ভাষাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠোঁটস্থ৷ এই বিশেষ স্থানটিতে সীতা ধরিত্রী মাতাকে সংশোধন করে যা বলবেন তার ভাবটিও তাঁর জানা আছে৷ কিন্তু ভাষা একটু গোলমেলে হয়ে গেছে৷ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ‘‘মাতঃ বসুন্ধরে’’ বলার পরই স্মারকের (prompter) এসে গেল দারুণ কাশি৷ সে কাশির চোটে আর কথা বলতে পারছে না অথচ সীতা তো আর তার প্রত্যাশায় মুখ ৰন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না৷ সে তখন উপস্থিত ৰুদ্ধি প্রয়োগ করে বললে–‘‘মাতঃ বসুন্ধরে, তুই ফাঁক হ, মুই ভিতরত্ ঢুকিম্’’৷
দেখলুম, এ জিনিসটা শ্রোতারা সহজেই গ্রহণ করলেন৷ নাটকের কিছুমাত্র রসভঙ্গ হ’ল না৷