দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতার মূল্য

লেখক
লীনা দাস

এখন কি জীবনে খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে? তা কি যুগোপযোগী নয়? এর সাথে নাকি তাল মেলানো যায় না৷ কিন্তু এটা পরিবর্তন নয় - বিবর্তন৷ ডায়নোসোর থেকে বাঁদর, বাঁদর থেকে মানুষ৷ মানুষের আদিমযুগের যুথবদ্ধতা থেকে ধাতুর ব্যবহার, আগুনের ব্যবহার থেকে সভ্যতা শুরু ৷ তারপর মানুষের তৈরী গোষ্ঠী, সমাজ, সম্প্রদায় ও ধর্ম৷ তারপর বিজ্ঞান প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে চলে রাষ্ট্র, ধর্ম, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি৷ এখন একটা কথাও শোনা যায়৷ পুরানো সব মূল্যবোধ নাকি ভেঙ্গে গেছে৷ ধর্ম ভেঙ্গে গেছে৷ সংস্কার, সংসার ভেঙ্গে গেছে৷ আরে এগুলো কি কাঁচ নাকি? পড়ে ভেঙ্গে যাবে৷ এর মৌলিক কাঠামো একই আছে৷ শিশুরা শৈশব হারাচ্ছে৷ আরে এগুলো কি এত তুচ্ছ ? এগুলোকি এত মজার বিষয়? এগুলো অর্জন করা বা হারানো এত সহজ নয়৷ তবে এই বিষয়টি পরিস্থিতি সাপেক্ষ ৷ এখন স্বাভাবিক ভাবে চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে৷ আগে ছিল স্থায়ী শিক্ষা, স্থায়ী জীবিকা, স্থায়ী রোজগার ও স্থায়ী সঞ্চয় ব্যবস্থা৷ এখনত আর তা নয়৷ এখন কেবল শিক্ষা, শ্রম, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে হয়৷ এক্ষেত্রে শিক্ষার থেকে প্রতিভার কদর অনেক বেশী বলে মনে হয়৷ কিন্তু তা নিশ্চিত নয়৷ সব সময় উচ্চ পেশার উচ্চ উপায়ী উচ্চ শিক্ষিত হন না৷ এটা অনেক সময় কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়৷ কিন্তু এই কষ্ট দক্ষতা স্বত্ত্বাকে আবিষ্কার করতে শেখায়৷ এর সাথে চাহিদা, পরিস্থিতি মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে গেছে৷ জনসংখ্যা হ্রাসের জন্যে এখনকার শিশুরা বড় একা৷ বরং বড় ও বুড়োদের ভাগ অত্যন্ত বেশী৷ যেন বেঢপ বাড়া শিমুল চারার মত৷ মহামায়ার এমন মায়া রেখেছে কুহুক করে৷ মানুষ মরে৷ কিন্তু মনুষ্যত্ব মরে না৷ মানুষ মরলেও তার অনুভূতি মরে না৷ শুধু মানুষকে আধুনিকতার মধ্য দিয়ে ও তার সামগ্রিক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার শিকড় চিনিয়ে দিতে হয়৷ মানুষ ভাগ্য নিয়ে আসে, কর্ম নিয়ে যায়৷ মানুষের নিজের কিছুই নেই৷ মানুষ কি দেয়, কি পায়, কি হারায়৷ তার নিজের কি আছে, তার নাম, তার শিক্ষা দেহ মন, চেতনা, সবই অন্যের সৃষ্টি৷ এমন কি মৃত্যুর পরেও সে পরের কাঁধে চড়ে শেষ যাত্রা করে৷ তাই মানুষের সব কিছুই অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ সেই হল পৃথিবী৷ মানুষ এখানে এসেছে৷ এখানে থেকেছে, এখানে ধর্ম-কর্ম করেছে, ঈশ্বরের কাছে দেনা করেছে, চলে গেছে৷ মানুষের দেহের কত পরিবর্তন হয়৷ মানুষের দাঁত, চোখ , চুল থাকে না৷ তাহলে আমরা যাকে বা যাদেরকে নিজের মানুষ ভাবি তারা নিজের থাকে না বলে মানুষ এত কষ্ট পায় কেন ? মানুষের জীবনটাই তো অনিত্য৷ এই জীবনটাই থাকেনা৷ তাই পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চের যাত্রা পালায় আমরা কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে এসেছি মাত্র৷ তাই এই অনিত্যকে নিত্য না ভেবে যদি আমরা প্রযুক্তির দ্বারা ছোট ছোট ধর্মীয় আনন্দ, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ মনে রাখতে, চিনতে ও চেনাতে সাহায্য করি তাহলেই বর্তমান ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সবল মন ও জীবনের অধিকারী হতে পারবে৷

মানুষের চরিত্র গঠন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ মানুষের চাওয়া- পাওয়া, চরমতম শুভ-অশুভ, সুসময়- দুঃসময়, মানুষের জন্ম, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, সাধভক্ষন, এগুলি হল মানবজীবনের অন্যতম প্রধান দিক এবং দিক গুলিতে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোন থেকে সময়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এবার হল মনঃস্তাত্তিক ও জীবিকার দিক থেকে সময়ের ব্যবহার৷ মানুষেরা ভোরের বেলা ব্রাহ্মমুহূর্তে পারমার্থিক দিক থেকে সময়কে কাজে লাগায়৷ তখন মানুষ প্রশান্ত ও প্রসন্ন্ন মনে থাকে৷ যেটার সঙ্গে শৈশব কৈশোরের নির্মল মন তুলনীয়৷ দুপুরে মানুষের থাকে নিজ কর্মের সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে ব্যস্ততা যেটা তার জীবিকা৷ যার উপর তার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে৷ যা তারুন্যের রজগুনের সঙ্গে তুলনীয়৷ এমনকি তাদের এই সাফল্য ব্যর্থতার সঙ্গে পারিবারিক জীবনে সত্তগুনের প্রাধান্য থাকে৷ এরপর সন্ধ্যেবেলা যখন মানুষ তার সাফল্য / ব্যর্থতার হিসাব নিয়ে বসে তখন যদি মানুষ তার মনোমত কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করে তবে তার মনে থাকে স্নিগ্দতা ৷ তার সংসার জীবন হয় মাধুর্য মন্ডিত ও সুন্দর৷ আর যদি মনে থাকে ব্যর্থতার তীব্র অসন্তোষ তবে মনকে গ্রাস করে হাতাশা৷ এই ভাবে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে সময়ের মূল্য নির্ধারন করে৷ এই ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে মানসিক অবসাদ, রিক্ততা মনে জমা হয় সেই অবস্থা মানুষের প্রৌঢ়ত্ব বা বার্দ্ধক্য জনিত অসহায়তার সঙ্গে তুলনীয় ৷

বিভিন্ন জন্মকালীন পরিবেশ, বংশগত, ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা ভিন্নভিন্ন শিশু নানা বয়েসের সামর্থ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোন, আগ্রহ ও প্রেষনার দ্বারা পরিচালিত হয়৷ সেই সামগ্রিক সংবেদনশীল অবস্থাকে সহানুভূতির সাথে অনুধাবন ও তার মধ্যে মূল্যবোধের চেতনা প্রবেশ করিয়ে শিক্ষার্থীর অর্ন্তনিহিত সম্ভাবনার সুষম বিকাশ ঘটাতে পারলে জাতির ভবিষ্যৎ গঠন সুনিশ্চিত হবে৷ সৃজনশীল মানসিকতা ব্যতীত আদর্শ শিক্ষার্থী ও আদর্শ সামাজিক রাষ্ট্রীয় কান্ডারী হওয়া অসম্ভব৷ সুফলদায়ী শিক্ষা যা আবহমান কালধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষার্থীর আগ্রহ, গ্রহন সামর্থ্য ও অনুধাবন ধারা সেই অনুযায়ী পথ প্রদর্শক দার্শনিক ও বন্ধু হয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দান করা এবং তাকে সমস্ত অনৈতিক প্রলোভন বা মানসিক বিপর্য্যয় থেকে রক্ষা করে নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে যথার্থ ভাবে তার দৃষ্টিতে সংজ্ঞায়িত ও বাস্তব জীবনে মূল্যায়িত করলেই তার যথার্থ ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠন করা যাবে ৷ আত্মবিশ্বাস সামাজিক ভদ্রতা ইত্যাদি শিক্ষন বিভিন্ন প্রশিক্ষকের দ্বারা আচরণের কাম্যগত পরিবর্তন হয়৷ যার ফলে অন্য সকলের মধ্যে থেকে ও একজন ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে বিশেষভাবে পারদর্শিতা ও সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারেন৷ যে অন্তর্দৃষ্টি একটি নিষিক্ত মনুষ্য ভ্রূন বা শিশুর মধ্যে নৈতিক চরিত্র পর্যবেক্ষন করতে পারে এবং সেই দিশাতেই একটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনে ও তার সুকুমার বৃত্তিগুলি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা ও সাঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে শিশু মনোবিদ্যা ৷

একটি সুস্থ পরিবার ও পরিবেশই পারে সর্বার্থে সুস্থ সামাজিক সুনাগরিক গড়ে তুলতে এবং প্রবীন- নবীন আবেগের ঐক্য বজায় রাখতে৷ মানব চরিত্র তা যার সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধ যুক্ত থাকে৷ চরিত্রের নৈতিক মূল্যবোধ বাদ দিলে হয় মুখোশধারী নাট্য ব্যক্তিত্ব৷ আদর্শগত সংঘাত ছাড়া কুসংস্কার রোখা যায়না৷ শাশ্বত অপরিবর্তনীয় এই দ্বন্দ্ব না হলে নতুন প্রচেষ্টার জন্য বর্তমান সত্ত্বার অভিযোজনের কৌশল আবিস্কৃত হয় না৷ পারিবারিক - সামাজিক ক্ষেত্রে এই সমন্বয় সাধন না হলে কখনই সুস্থ- মানববন্ধন গড়ে উঠতে পারেনা৷ টিকে থাকতে পারে না মানব সভ্যতা, মানব সমাজ৷ ভারতীয় মানব সমাজে এই সহ্যগুন ও বিশ্বাসই হল আত্মবিশ্বাস৷ এই বিশ্বাসই আধুনিকতা ও এঁতিহ্যকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহন করতে পারে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে৷ যা কল্যানকারী রাষ্ট্রের প্রত্যাশা৷ পারিবারিক সামাজিক প্রত্যাশা পূরণ করে ব্যক্তি স্বতন্ত্রভাবে কল্যান সাধন করে ও সমষ্টিগত ভাবে সামগ্রিক সর্বাঙ্গীন কল্যান সাধন করে৷ তাই পরিবার হল মুখ্য গোষ্ঠী যা আধুনিকতা ও এতিহ্যকেবহন করে চলতে পারে বা যাকে চলতে হয়৷ তাই নৈতিক মূল্যবোধ কি ব্যক্তি জীবনে বা সমাজ জীবনে একটি অপরিহার্য চারিত্রিক গুন৷ কোন প্রশ্ণের সঠিক উত্তর একটিই হয় কিন্তু ভুল উত্তর অসংখ্য৷ তেমনি মানুষের চরিত্রগঠনে একটিই সঠিক পন্থা তা হল নৈতিকতার পন্থা৷ যা কখনো ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়না৷ আপাত দৃষ্টিতে এর মূল্য নির্ধারনের কোন যন্ত্র আবিষৃকত হয়নি৷ কিন্তু শিশু, কিশোর, যুবকবৃদ্ধ নিয়ে গড়া পরিবার, নানা পেশার ব্যক্তি নিয়ে গড়া সমাজ সকল বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে সোজা পথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকবে এই নৈতিক মূল্যবোধের কল্যানে৷ এমনকি মরনের পরেও ব্যক্তি তার নিজ পরিবার, আত্মীয় সমাজ, গোষ্ঠী সম্প্রদায়কে সনাক্ত করনের কাজে ব্যবহৃত হবেন৷ তার নৈতিকতার কৃতিত্ত্বে৷ তার অনিত্য জীবন এই মূল্যবোধের কারনে-তাকে দীর্ঘজীবি করে রাখবে, মরনের পরেও দীর্ঘদিন তিনি সবার চর্চার বিষয় হয়ে থেকে যাবেন৷