সম্প্রতি মনিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরান ও উত্তরপ্রদেশে যুবকের মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া, দুই বালককে বোতলে প্রস্রাব ভোরে জোর করে খাওয়ানো--- এ সমাজ কোথায় চলেছে! মনুষ্য নামধারী দ্বিপদ জীবের এ কেমন আচরণ! মানব আধারে এই পাশবিকতার দায় কার? সমাজ কোন পথে চলেছে৷ এ থেকে পরিত্রাণের পথ কি?
যখনই কোন নক্কারজনক ঘটনা ঘটে অপরাধ দমনে কঠোর আইনের কথা বলা হয়৷ কয়েক বছর আগে পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনেও আইনের প্রসঙ্গ উঠেছিল৷ কিন্তু আইন প্রয়োগেই কি সমাধান সম্ভব! পত্র পত্রিকায় দুরদর্শনের পর্দায় বসে যারা রাষ্ট্রের ঘাড়ে, পুলিশ প্রশাসনের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দেয়, তাদের কি কোন নৈতিক দায়িত্ব নেই!
আজকের সেক্স আর ভায়োলেন্স মার্র্ক চলচ্চিত্র, সাহিত্য ছাত্র-যুব সমাজকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে বাবা-মাকে দেখার জন্য পর্যন্ত রাষ্ট্রকে কঠোর আইন প্রয়োগ করার কথা ভাবতে হচ্ছে৷ যা ছিল সন্তানের সহজ সরল স্বাভাবিক কর্তব্যবোধ, তাকে আইন করে বাধ্য করাতে হচ্ছে৷ সন্তানের কাছে, এমনকি পিতামাতার কাছেও এ মোটেই গৌরবের নয়৷ সমাজের কাছেও এ লজ্জা ঢাকার জায়গা নেই৷
প্রশ্ণ সমাজের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? শুধু কি সন্তানরা! শুধু কি রাষ্ট্র ব্যবস্থা! ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব--- ইতিহাস বলছে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের অবদানের কথা৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ‘আনন্দমঠ, ‘নীলদর্পণ’, পথের দাবী৷ তাহলে আজকের যুব সমাজের এই বিপথগামী হওয়ার পেছনেও শিল্পী সাহিত্যিক কলাকুশলীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কতকগুলি বাংলা চ্যানেল সারাদিন যে সব সিরিয়ালগুলো দেখায়, তাতে শুধু পারিবারিক কলহ, বিবাদ, কুমন্ত্রণা, কুচক্রী যতরকম হীন মানসিকতার প্রকট৷ এর প্রভাব সমাজে পড়ছে৷ বহুবছর আগে রবীন্দ্র সরোবরে রুমালে হাত বেঁধে এক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছিল৷ পরদিন একটি বাংলা দৈনিকে ‘এক দুজে লিয়ে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল৷ ওই সময় ওই হিন্দি সিনেমাটি খুব চলছিল৷ ওই সিনেমায় নায়ক-নায়িকা হাতে হাত বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল৷ তার প্রভাব পড়েছিল ওই তরুণ-তরুণীর মধ্যে৷ আর আজকের যুব সমাজকে অশ্লীল বলিউড,টলিউড চলচ্চিত্র এমন মাতিয়েছে যে বলিউডের এক ড্রাগ আসক্ত হতাশ হিরোর আত্মহত্যাকে নিয়ে তোলপাড় করছে দেশ, অথচ প্রতিদিন কত শত কৃষক, দলিত সাধারণ মানুষ আত্মহত্যা করছে, খুন হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বলি হয়ে--- এসব নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই৷
তবে আজকের তরুণ তরুণী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এই যে অধঃপতন, এই যে হীনতা-নীচতা---এর সব দায় শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না৷ কবি সাহিত্যিক শিল্পী অভিনয় জগতের কুশীলবরাও দায়ী, বরং একটু বেশি দায়ী৷ রাষ্ট্রের যেমন দায়বদ্ধতা আছে আইন-শৃঙ্খলা সামাজিক শান্তি ইত্যাদি বজায় রাখার, তেমনি কবি-সাহিত্যিক শিল্পী ও কলাকুশলীদের দায়িত্ব আছে ছাত্রযুব সমাজকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেয়া শিল্পকলার মাধ্যমে৷ কিন্তু তারা বিপরীত কাজটাই করছে৷ এই ধরণের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা বলে থাকেন---‘‘শিল্পের খাতিরে শিল্প৷’’ যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘সেবা ও কল্যাণের জন্য শিল্প’’৷ সাহিত্য শব্দটির মধ্যেই হিত শব্দটি জড়িয়ে আছে৷ কিন্তু আজকের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা শুধু অর্থের জন্য শিল্প সৃষ্টি করে৷ অর্থ,খ্যাতি, ক্ষমতার মোহে হিতের কথাটা ভুলেই গেছেন৷ আসলে কবি সাহিত্যিক,শিল্পী, রাজনীতিবিদ,অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক সকলেই আজ পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাস হয়ে গেছে৷ ব্যতিক্রম কিছু আছে, কিন্তু তারা আজকের সমাজে অপাংক্তেয়৷ সমাজ মন্দ ভালো নিয়ে৷ তাই মন্দকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে পুলিশ প্রশাসন আইন-আদালতের প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর৷ কিন্তু অপরাধের প্রস্তুতি পরিকল্পনা নেয় মন, সেই মনকে নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশ-প্রশাসন আইন আদালতের কাজ নয়৷ এ কাজের দায় কবি সাহিত্যিক শিল্পী, কলা কুশলীদেরই নিতে হবে৷ আর এ কাজ করতে হলে পুঁজিবাদী দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে আগে৷ পারবেন কি? যদি পারেন সেই শুভ দিনের আশায়, নতুবা আইন অপরাধীর মানসিকতার পরিবর্তন আনতে পারবে না৷ আইন আছে, খুন নারী নির্যাতনে কঠোর সাজা তো হয়! তাতে কি সমাজে খুন নারীনির্যাতন বন্ধ হয়েছে! সমাজের এই অধঃপতনের নৈতিক দায় যেমন কলা কুশলীদের কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের তেমনি সমাজকে উদ্ধার করার দায় যুব সমাজকে সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেবার দায় তাদের কে নিতেই হবে৷
- Log in to post comments