বিশ্বের সকল বাঙালীর নিকট ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি প্রাতঃস্মরণীয় নাম৷ প্রতিটি বাঙালী মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা শেখে মা-বাবা-আত্মীয় পরিজনদের মাধ্যমে ৷ আর বাঙলায় প্রথম আক্ষরিক পরিচিতির জন্যে হাতের কাছে পায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’৷ বাঙালী মাত্রেরই বিদ্যাশিক্ষার ভিত্তি রচিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে৷ তাঁর পিতৃদত্ত নাম শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের পদবী হিসেবে আমরা সাধারণতঃ ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ ব্যবহার করি না৷ স্বামীজী বললে যেমন স্বামী বিবেকানন্দকে, কবিগুরু বললে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, নেতাজী বললে সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা বুঝি---ঠিক তেমনই বিদ্যাসাগর বা দয়ারসাগর ও করুণাসাগর বললে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বুঝি৷ সেই ঈশ্বরচন্দ্রেরই দ্বিশত জন্মবর্ষের সূচনা হ’ল ২০১৯ সালের২ ৬শে সেপ্ঢেম্বর৷ মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্ঢেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন৷ পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী দেবী৷ ঠাকুরদাস ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও কঠোর নিয়মানুবর্তী৷ অপরপক্ষে ভগবতী দেবী ছিলেন স্নেহশীলা, দয়ালু, করুণাময়ী ও দরদী মনের মানুষ৷ তাই শৈশব থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র কোমলে কঠোরে নির্মিত পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে তাঁর চরিত্রে উভয় গুণেরই সমাবেশ ঘটেছিল৷ ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন৷ ঠাকুরদাসের আর্থিক অবস্থা বিশেষ সচ্ছ্বল না থাকার কারণে সেই ছোট বয়স থেকে ঈশ্বরচন্দ্রকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে৷ ফলে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আপোষহীন সংগ্রামে তেজী মনোভাব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তাঁর গুণাবলীর অপর দিকগুলি হ’ল প্রবল কষ্ট সহিষ্ণুতা, কঠোর পরিশ্রমী, বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করার ক্ষমতা ও শিক্ষার প্রতি অসীম আগ্রহ৷ কলকাতায় বসবাসকালে ভোরবেলা শয্যা ত্যাগের পর ঘরদোড় ঝাঁট দিয়ে কয়েকজনের রান্না করে’, বাসন মেজে কিশোর ঈশ্বরচন্দ্রকে কোনরকমে নাকেমুখে অন্ন গুঁজে বিদ্যালয়ে ছুটতে হ’ত৷ সংসারের কাজকর্ম, রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া করতে হ’ত৷ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে সংস্কৃতের শ্লোক মুখস্থ করতেন৷ রাত্রে রাস্তার আলোর নীচে পাঠ্যাভ্যাস করতেন৷ এইভাবে চলছিল তাঁর বিদ্যালাভের কঠোর সাধনা৷ দারিদ্যের সঙ্গে ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতে তিনি অর্জন করেছিলেন দুর্জয় তেজী মনোভাব ও অদম্য সাহসিকতা৷ প্রখর মেধা ও কঠিন অধ্যবসায়ের ফলে একের পর এক বাধা অতিক্রম করে সমস্ত বিষয়ে সুপণ্ডিত হয়ে উঠলেন ও শেষ পর্যন্ত অর্জন করলেন ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি৷ শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ ও আকর্ষণ৷ একদিকে তিনি যেমন সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন তেমনি ইংরেজীতেও ছিল তাঁর সপ্রতিভ দক্ষতা যা তাঁকে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে প্রভূত সাহায্য করেছে৷
ছাত্র জীবনের মতই কর্মজীবনেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয়েছিল যা তিনি অশৈশব লালিত চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অনমনীয় তেজস্বিতার দ্বারা অতিক্রম করেছিলেন৷ কর্মজীবনে তিনি প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হলেন ও পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন৷ শেষ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদও অলঙ্কৃত করেন ও সেই সঙ্গে গ্রহণ করেন স্কুল পরিদর্শনের অতিরিক্ত দায়িত্ব৷ এই সময় অক্লান্ত পরিশ্রমে মাত্র সাত / আট মাসে (১৮৫৭-৫৮ এর মধ্যে) বিভিন্ন জেলায় জেলায় মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারের জন্যে গড়ে তোলেন ৩৫টি বিদ্যালয়৷ কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন৷ যদিও সেই স্কুলগুলির কাজ তিনি ব্যষ্টিগত উদ্যোগে চালিয়ে গেছিলেন যা বর্তমানেও অকল্পনীয় বলেই মনে হয়৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন স্কুল ১৮৭২ সালে কলেজে উন্নীত হয়েছিল যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত৷ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে শিশুদের জন্যে প্রথম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয় যা আপামর বাঙালীর অক্ষর শিক্ষার প্রথম পুস্তক৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি ছিল অপরিসীম৷ মাতৃদেবী ভগবতী দেবীর প্রেরণায় ও নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ভগবতী বিদ্যালয়৷’ সেই যুগে নারীগণের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ৷ শিক্ষার অভাব তাদের জীবনকে আরো বেশী অসহনীয় করে তুলেছিল৷ ‘ভগবতী বিদ্যালয়’এই অশিক্ষার অচলায়তন ভেঙ্গে ফেলার এক সার্থক প্রয়াস৷ সমাজের শিরোমণিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাঁর এই প্রচেষ্টা দুর্জয় সাহস ও দৃঢ়তার সাক্ষ্য বহন করে৷ বাল্যবিবাহ ও প্রচলিত কুলীন ব্যবস্থার কারণে সমাজে অসংখ্য সকল বয়সী (নাবালিকা থেকে প্রৌঢ়া) মহিলাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা বিদ্যাসাগরকে নিরতিশয় ব্যথিত করে তুলেছিল৷ তাই বিধবা নারীকুলের চোখের জলের স্রোত বন্ধ করার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহ প্রচলনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন৷ প্রথমে বিভিন্ন ধার্মিক শাস্ত্রীয় কুযুক্তিকে খণ্ডন করে মানবিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা তৎকালীন ইংরেজ শাসকবর্গকে সন্তুষ্ট করেন৷ এরই সঙ্গে রক্ষণশীল, তার্কিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ সমাজকে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিধান উল্লেখ করে দিবারাত্র পরিশ্রমের দ্বারা পরাভূত করেন৷ তাঁর এই অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ বিধিবদ্ধ ভাবে লাগু হয়৷ এই বিধবা বিবাহ প্রবর্ত্তন তাঁর জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে স্বীকৃত৷ নারী শিক্ষারও তিনি ছিলেন পথিকৃত৷ তাঁরই পরামর্শে তৎকালীন মহিলাদের প্রিয় যানবাহন পালকির গায়ে লেখা হ’ত মহানির্বাণ তন্ত্রের শ্লোকের অংশ---
‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ’
নারী জাতির প্রতি দরদী মনোভাব ও সংবেদনশীলতা তাঁর মাতৃভক্তির একটি উজ্জ্বল নিদর্শন৷ বাল্যবিবাহ রোধেও তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন৷
মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখলেই তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন ও সেই কষ্ট লাঘবের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন৷ কর্মে ছিলেন তিনি অবিচল, নিষ্ঠাবান ও কঠোর কিন্তু মানুষের দুঃখের সময় অত্যন্ত কোমল হৃদয় ও দরদী৷ দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর জীবনের বহু বছর অতিবাহিত হওয়ার ফলে অন্যের দারিদ্র্য দেখলে তা দূর করার জন্যে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন৷ করুণার প্রতিমূর্ত্তি মাতৃদেবী ভগবতীদেবীর কাছ থেকে তিনি এই গুণগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন৷ মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রচণ্ড অর্থ কষ্টের সময় তিনি ধার দেনা করেও অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন৷ তাঁর দানশীলতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, দরদ ও দয়ালু ভাবের জন্যে তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ বা ‘করুণাসাগর’ নামেও অভিহিত করা হয়৷ অপরপক্ষে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামী ও কঠোর৷ অজেয় পৌরুষ ও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র৷ সেই কারণে বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন৷ এছাড়া বহু ঘটনা ঘটেছে যা তাঁরএই দিকটিকে নির্দেশ করে যা আলোচনার পরিসর এখানে নেই৷ তবে এদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্যঃ ১৮৭৪ সালে তাঁর সর্বসময়ের সঙ্গী চটীজুতো পায়ে তাঁকে এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ামে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়৷ সেই কারণে তিনি আর কোনদিন সেখানে যান নি৷ অপর একটি ঘটনা ঃ তিনি এক ইংরেজ সাহেবের সাক্ষ প্রার্থী হয়ে উপস্থিত হলে সাহেবটি টেবিলের ওপর বুট শুদ্ধ পা তুলে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন৷ পরবর্তী সময়ে সেই সাহেব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি চটিজুতা সহ পা-দুটি টেবিলে তুলে তাঁর সঙ্গে বার্তালাপ করেন৷ এইভাবেই কঠোরতা ও কোমলতার মহামিলন ঘটেছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে৷ তাঁর নির্ভীক চরিত্র ও মানুষের প্রতি অকৃপণ ভালবাসা বাঙালী কোনদিন ভুলতে পারবে না৷ বাঙলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অবদানও অবিস্মরণীয়৷ বর্ণপরিচয় ও ব্যকরণ ছাড়াও বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি গ্রন্থ তৎকালীন ও বর্তমান সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ৷ মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে মিলে ‘সংস্কৃত প্রেস’ প্রতিষ্ঠা তাঁর একটি বিশেষ কীর্তি৷ এছাড়াও তাঁর বর্ণময় জীবনের বিশাল ব্যাপকতা একটি ছোট প্রবন্ধে প্রকাশ করা অসম্ভব৷ তাই সেগুলি অলিখিতই রয়ে গেল৷ যাইহোক সমগ্র জীবনের কর্মব্রত উদ্যাপন করতে করতে ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই মহামনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইহলোক ত্যাগ করলেও মানুষের অন্তর্লোকে তিনি সর্বদাই চিরবিরাজমান৷
বর্তমানে তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে যা চলবে সারা বছর ধরে---বহু সভা-সমিতি, আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে৷ হয়তো বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা হবে---সেগুলি হোক ক্ষতি নেই৷ তবে আচার সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে বাঙালী নামক জনগোষ্ঠীর বিশেষ কোনও লাভ হবে না৷ যেটা প্রয়োজন তা হ’ল, যে কর্মযোগ ও আদর্শের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র আজ বিদ্যাসাগর বা দয়ার সাগর বা করুণাসাগর নামে পরিচিত---সেই কর্ম ও আদর্শের বাস্তবায়নই আবশ্যক৷ আজও সমাজে নারীকুল অবহেলিত, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধ কুসংস্কার, ভাবজড়তা প্রভৃতির দ্বারা আক্রান্ত৷ শুধুমাত্র নাম সই করবার সাক্ষরতা নয়, সার্বিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে ১০০ শতাংশ নারী-পুরুষ সকলেরই সুশিক্ষিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন৷ বর্তমানে মানুষ তথাকথিত শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেক উন্নত হলেও এক ধরণের স্বার্থপর কূপমণ্ডুকতায় নিমজ্জিত, মানবিকতা লাঞ্ছিত- নিপীড়িত, অন্যায়-অবিচার, হিংসা, দুর্নীতি মানুষের অধিকারকে পদে পদে বিঘ্নিত করে চলেছে৷ তাই আজ বাঙালীসহ সমগ্র মানুষ জাতিকেই বিদ্যাসাগরের অজেয় পৌরুষ, অসম সাহস, বলিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সর্বোপরি মানবদরদী সংবেদনশীল মানসিক চেতনা অর্জন করতে হবে৷ আর সেই সব গুণাবলী বৃহত্তর সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে৷ তবেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘জন্মদ্বিশতবর্ষ’ উদ্যাপন সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হবে৷
- Log in to post comments