‘গঙ্গাটেয়’ শব্দের একটি অর্থ হ’ল গঙ্গাপাগল মানুষ–যার গঙ্গার নাম শুণলেই গঙ্গাস্নানের ইচ্ছে জাগে৷ তোমরা তোমাদের গ্রামে শহরে নিশ্চয় এমন কিছু পুরুষ ও মহিলাকে দেখেছ যারা ‘‘উঠলো বায় তো কটক যায়’’৷ হঠাৎ খেয়াল হ’ল গঙ্গাস্নানে যাবার, আর তখন বাড়ীর সুবিধা–সুবিধার কথা না ভেবে গঙ্গার দিকে রবাণা হয়৷ আমাদের শহরে আমাদেরই ঠিক পাশের বাড়ীতে থাকতেন জনৈক রমেশচন্দ্র গুপ্ত৷ মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত ভাল৷ আমরা তাঁকে কাকা বলে ডাকতুম৷ আর ছিলেন তাঁর বৃদ্ধা মা ও পত্নী৷ তাঁরা দুজনে ছিলেন আরও ভাল...ভালর চেয়েও ভাল৷ তাঁর মাকে ডাকতুম ঠাক্মা বলে৷ ঠাক্মার ওই গঙ্গাস্নানের বায়ু ছিল৷ আমাদের শহর থেকে গঙ্গা প্রায় ছ’ মাইল দূরের পথ৷ শবদাহের জন্যে ট্রেনে করে শব নিয়ে যেতে হত৷ গঙ্গা স্নানার্থীরাও ট্রেনে করে যেতেন৷ গঙ্গাতীরের কাছাকাছি পর্যন্ত সরকও ছিল৷ আকবরের আমলের৷ সরকটি অবশ্য তৈরী করে দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের কোন এক রাণী স্বর্ণময়ী দেবী বা স্বর্ণকুমারী দেবী৷ শোণা যায় রাণীমার কাশীবাসের ইচ্ছে হয়েছিল বলে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে কাশী পর্যন্ত ভাগলপুর, মুঙ্গের, পটনা, আরা হয়ে কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত সরকটি বানিয়ে দিয়েছিলেন৷ তিনি সরকটি তৈরী করেছিলেন তাঁর গঙ্গাস্নানের ইচ্ছার পূর্ত্তির জন্যে৷ কিন্তু গরীবেরা এতে উপকৃত হয়েছিল পদযাত্রার মার্গ পেয়ে৷ এ যেন সেই জমীদারবাবু ভোরে সন্ধেয় ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে, ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে পুকুর পাড়ে বেড়াবেন বলে পুকুর কাটলেন কিন্তু গরীব বেলদাররা সেই অবকাশে পুকুর কাটা বাবদ কিছুটা মজুরি পেয়ে গেল৷ দু’জনের দুই দৃষ্টিভঙ্গী৷
‘‘হুজুরেরা নিজের তরে আরাম করেন বন্দী
মজুরেরা যা বেচে তায় এমনি খোদার ফন্দী৷’’
ছোটবেলায় আমাদের শহর থেকে ওই রাস্তা ধরে একা যেত৷ কিন্তু তার গতি তো ট্রেনের চেয়ে কম ছিল৷ আর জলাতপের ক্লেশও ছিল৷ তখন পথে পথে বাস–সার্ভিস প্রবর্ত্তিত হয়নি৷ যাই হোক্, আমাদের ঠাক্মা ছিলেন সব সময়েই ভাল মানুষ, কিন্তু ভোরের দিকে এক বগগা জেদী গঙ্গাস্নানার্থিনী৷ বাড়ীতে শত কাজ থাকলেও গঙ্গাস্নানে তিনি যাবেনই রোজ রোজ৷ আর কত টিকিট কেনা যায় মহিলা ছিলেন কিছুটা শিক্ষিতা৷ যদি বলতুম আপনি রোজ রোজ কীভাবে ট্রেনে যান, তিনি বলতেন T–তে যাই৷ আমরা ভাবতুম T. with ticket কিন্তু আসলে তিনি যেতেন without ticket–এ৷
একদিন ইষ্টিশানের ‘এক্সিট’ (বহির্গমন পথ)–এর কাছে দাঁড়িয়েছিলুম৷ দেখলুম টিকিট চেকারের পাশ দিয়ে ঠাক্মা গট্গট্ করে বেরিয়ে এলেন৷ আমি এমনভাবে দাঁড়ালুম ঠাক্মা যাতে আমাকে দেখতে না পান৷ দেখলুম ও শুণলুম টিকিট–চেকার ঠাক্মাকে বলছেন–মা, আপনার টিকিটটা কোথায়? স্বকর্ণে শুণলুম ঠাক্মা বলছেন–ওই যে বাবা ছেলে পেছনে আসছে, টিকিট তারই কাছে৷
সেদিন দুপুরে ঠাক্মাকে চেপে ধরলুম৷ আর যায় কোথা তখন ঠাক্মার মুখ দিয়ে ফাঁস হল T মানে without tocket৷
আমি বললুম–তা ঠাক্মা, তুমি রোজ রোজ বিনা টিকিটে এস, টিকিট–চেকার তার জন্যে মুখঝামটা দেয় না?
ঠাক্মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন–মধ্যে মধ্যে দেয়৷
আমি বললুম–অবস্থাটা কেমন হয়?
ঠাক্মা বললেন–আমি যখন বলি ওই যে বাবা টিকিট ছেলের কাছে আছে, ছেলে পেছনে আসছে, তখন সময় সময় পোড়ারমুখো টিকিট–চেকার বলে–আপনি রোজই বলেন ছেলে পেছনে আসছে কিন্তু কোন দিনই তো আপনার ছেলের টিকিও দেখতে পাই না৷ আমি না থেমে চলতে চলতে গেট পার হতে হতে টিকিট–চেকারকে বলি–আমার ছেলে কি পশ্চিমে যে টিকি রাখবে? তার মাথা সবসময় জামাইছাঁটে ছাঁটা৷
আমি বললুম–কাজটা কি ভাল করো? গঙ্গাস্নানে যে পুণ্যি হয় সেটা তো তোমার বিনা টিকিটের ভ্রমণেই গায়ে গায়ে শোধ হয়ে যায়৷
ঠাক্মা খানিক চুপ করে রইলেন৷
আমি বললুম–গায়ে গায়ে শোধ জানো তো ছেলের বাপে মায়ের বাপে কথা হয়ে রইল ছেলের বাপ ছেলের বাড়ী থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব পাঠাবে না মেয়ের বাপে ছেলের বাড়ীতে ফুলশয্যার তত্ত্ব পাঠাবে না৷ দুই তত্ত্ব একে অপরকে শোধ করে দেবে৷ একেই কলকাতার ভাষায় বলি গায়ে গায়ে শোধ৷ তোমার গঙ্গাস্নানের পুণ্যি আর বিনা টিকিটে যাবার পাপ এরা গায়ে গায়ে শোধ হ’ল কি না৷ ঠাক্মা বললেন–তুই বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছিস ঠিক কিন্তু এতে গায়ে গায়ে শোধ হ’ল না৷ শাস্ত্রে বলে, গঙ্গাস্নানে যা পুণ্য তা মাপাজোকা করা যায় না৷ আর বিনা টিকিটের পাপ তো যত টাকার টিকিট ফাঁকি দিলুম তত টাকা চুরির সামিল৷
‘‘এক বার গঙ্গাস্নান যত পাপ হরে
পাপীদের সাধ্য নাই তত পাপ করে৷’’
সুতরাং এ যেন সেই অনন্ত থেকে এক বাদ দিলে অনন্তই থেকে যায়৷ বেদে আছে না–
‘‘পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে৷’’
এটাও অনন্ত, ওটাও অনন্ত৷ অনন্ত থেকে অনন্ত বেরিয়ে আসছে তাই অনন্ত থেকে অনন্তকে বাদ দিলে যা বিয়োগফল হয় তাও অনন্ত৷ এক্ষেত্রে অনন্ত পুণ্য থেকে মাত্র কয়েক পয়সার টিকিট ফাঁকি দেবার পাপ বাদ যাচ্ছে৷
আমি বললুম–ঠাক্মা, তোমার যুক্তি জজেও মানবে৷
ঠাক্মা কিন্তু গঙ্গাস্নান বলতেন না, তিনি বলতেন জাহ্ণবী স্নান৷ অর্থাৎ গঙ্গাস্নান বলা তাঁর পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল৷ কারণ তাঁর শ্বশুরের নাম ছিল গঙ্গাধর গুপ্ত৷ ৰর্দ্ধমান জেলার গ্রামের ছড়ায় আছে–
‘‘শ্বশুর–ভাসুরের নাম করলে অধঃপাতে যায়
মামা–শ্বশুরের নাম ধরলে আলজিব খসে যায়
আর সোয়ামীর নাম নিলে দুধে–ভাতে খায়৷’’
যাই হোক্, দুধে–ভাতে খাবার লোভ থাকলেও সোয়ামীর নাম কেউ নেয় না৷ সোয়ামীর নাম বানান করে বলে৷ আমাদের পাড়ায় এক কাকীমার স্বামীর নাম ছিল তুলসীপ্রসাদ বাঁড়ুজ্যে৷ পাড়ার আরেকজন পিসীমা তাঁকে শুধিয়েছিলেন, ‘‘তোমার সোয়ামীর নাম কি দিদি?’’ তিনি উঠানের মাঝখানে থাকা তুলসী গাছটা দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার সোয়ামীর নাম ‘‘ওই প্রসাদ বাঁড়ুজ্জ্যে’’৷
(শব্দ চয়নিকা, ১৫/১২১)