দুর্গাপূজা, কালীপূজা ও তন্ত্রসাধনা

লেখক
আচার্য্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

বর্ষার পর শরৎ আসে নীল আকাশে শাদা মেঘের ভেলায় চড়ে’–শেফালীর গন্ধে জগৎকে মাতিয়ে কমল–কুমুদের শোভা, নদীতীরে কাশের বনের হিন্দোল আমাদের প্রাণকে আনন্দে মাতিয়ে দেয়৷ ‘প্রভাত সঙ্গীতে’ শরতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে–

‘‘শরৎ ওই আসে, ওই আসে, ওই আসে

শরৎ নাচের তালে তালে পা ফেলে’ ফেলে’

            মন্দাক্রান্তা ছন্দে ধরায় হাসে৷৷

শরৎ শুধু নয়, শেফালীর সুগন্ধেতে,

শরৎ শুধু নয় শাদা মেঘের ভেলাতে,

শরৎ প্রাণে আসে, শরৎ মনে আসে,

শরৎ ভুবনকে ভুলিয়ে মর্মে হাসে৷৷

শরৎ শুধু নয় বাতাবী নেবুর গন্ধে,

শরৎ শুধু নয়, কুশকাশের দোলার ছন্দে,

শরৎ প্রাণে আসে, শরৎ মনে আসে,

শরৎ ভুবনকে দুলিয়ে মর্মে হাসে৷৷’’

কোন কোন অঞ্চলে ‘বসন্ত’ ঋতুরাজের সম্মান পেলেও বাঙলায় সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে মনোরম ঋতু হ’ল শরৎ ঋতু৷ চারিদিকে খুশীর জোয়ার৷ তাই এই ঋতুটি বাঙালীর জীবনে উৎসবের ঋতু৷ আর এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে ভ্রমণ, সাংসৃক্তিক অনুষ্ঠানাদির সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ বাঙালী সমাজ দুর্গাপূজা ও কালীপূজাতেও মেতে ওঠে৷

বস্তুতঃ দুর্গোৎসব বাঙালী সমাজের আজ প্রধান উৎসব৷ স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ণ আসে কবে থেকে এই দুর্গোপূজার প্রচলন৷ সাধারণতঃ মানুষ তন্ত্রের সঙ্গে এই দুটো পূজাকে অভিন্ন বলেই ভেবে থাকেন৷ বাঙলায় তন্ত্রের প্রাবল্য৷ তন্ত্র, যাকে আগম শাস্ত্রও বলা হয়–এর প্রবক্তা সদাশিব৷ সদাশিবকে সাধারণতঃ মানুষেরা পৌরাণিক দেবতা বলেই জানেন৷ প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ঐতিহাসিক পুরুষ৷

পুরাণ ঃ পুরাণ কী? প্রাচীন কালে চার ধরণের রচনা বা পুস্তক ছিল৷ কাব্য, ইতিবৃত্ত, ইতিহাস ও পুরাণ৷ কাব্য বলতে বোঝায় ‘বাক্যংরসাত্মকং কাব্যম্’–রসপূর্ণ রচনা, ছন্দ অলঙ্কারাদি সহযোগে যা রচনা করা হ’ত৷ ইতিবৃত্ত হ’ল ঘটনার যথাযথ পঞ্জীকরণ৷ যা ঘটেছে–তাই লিখে যাওয়া৷ ইতিহাস আর ইতিবৃত্ত এক নয়৷ ইতিবৃত্তের যে অংশটি মানুষের কাছে নীতিশিৰামূলক–মানুষের উন্নতিতে সাহায্য করে–সেই অংশটি হ’ল ইতিহাস৷ নীতিশিৰাহীন অংশটি ইতিহাস নয়৷ আর পুরাণ হ’ল, নীতিশিৰার্থে রচিত কাল্পনিক কাহিনী৷ কাহিনী সত্য না হলেও লোকশিৰার্থে রচিত৷

বেদ, তন্ত্র, পুরাণের ইতিহাস ঃ এখানে সংক্ষেপে বেদ, তন্ত্র, পুরাণের ইতিহাসও একটুখানি বলে রাখা ভাল৷ আর্যরা বহিরাগত৷ মধ্য এশিয়া থেকে ইরাণের পথ ধরে ভারতে আসে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে৷ ইরাণ কথাটা এসেছে ‘আর্যন্যব্রজ’ থেকে, অর্থাৎ আর্যরা যে অঞ্চলে আনন্দে ঘোরাফেরা করতেন৷ আর্যন্যব্রজ থেকে অপভ্রংশে হয়েছিল ইরাণবেজ, পরে ‘বেজ’ বাদ দিয়ে কেবল ইরাণ৷ ইরাণ থেকে আর্যরা ভারতের উত্তর–পশ্চিম কোণ দিয়ে সিন্ধুনদীর উপত্যকা অঞ্চলে প্রবেশ করে৷ পরে আরও এগুতে থাকে৷ আর্য ঋষিরা প্রাচীন কালে বেদ রচনা শুরু করেন৷ বেদের প্রথম অংশ ঋগ্বেদের খানিকটা অংশ ভারতে প্রবেশের পূর্বেই রচিত হয়েছিল৷ তারপর বাকী সবটুকু অংশ ভারতেই রচিত৷

প্রায় সাড়ে সাত হাজার বৎসর পূর্বে ভারতে এক মহান পুরুষের আবির্ভাব হয়৷ তিনি হলেন সদাশিব৷ হিমালয়ের কৈলাস অঞ্চলে ছিল তাঁর বাসভূমি৷ তিনি ছিলেন মহাযোগী ও মহাতান্ত্রিক৷ তন্ত্র বা আগম শাস্ত্র তাঁর অবদান৷ যোগ তন্ত্রের অংশ৷ যোগতন্ত্র মূলতঃ বৈবহারিক সাধনা বিজ্ঞান৷ বেদ প্রায় ৯৫ শতাংশ তাত্ত্বিক ও ৫ শতাংশ বৈবহারিক৷ কিন্তু তন্ত্র প্রায় ৯৫ শতাংশ বৈবহারিক ও ৫ শতাংশ তাত্ত্বিক৷ বলা বাহুল্য, সদাশিবের কালেও বেদ রচনা চলছিল৷ মোটামুটি গত ৫ হাজার বছর পূর্বে বেদ রচনা শেষ হয়৷ এখানে উল্লেখ্য, বেদ কোন একজন ঋষির রচনা নয়৷ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋষি বেদের বিভিন্ন অংশ রচনা করেছেন৷ প্রথমে তো লিপির প্রচলন ছিল না, তাই ঋষিরা মুখে মুখেই বেদের শ্লোকগুলি রচনা করতেন৷ শিষ্যরা শুণে শুণে সেগুলো শিখে নিত৷ তাঁরা আবার তাঁদের শিষ্যদের বলতেন৷ তারাও শুণে শুণে শিখত৷ এজন্যে বেদের অপর নাম শ্রুতি, অর্থাৎ যা শুণে শুণে শিখতে হত৷ প্রথম যুগে তন্ত্র–যোগ সবই শুণে শুণে শিখতে হত৷

শিবের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসর পরে আসেন কৃষ্ণ৷ মহাভারতের ইতিহাস রচনা করেন বেদব্যাস৷ মহাভারতের অল্পকাল পূর্ব থেকে শাস্ত্রাদি লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়৷ মহাভারতও লেখা হয়েছিল৷ বেদের মত ‘শ্রুতি’ নয়৷

এরপর ৫০০ বছর পর শুরু হয় বৌদ্ধযুগ৷ প্রায় ১০০০ বছর বৌদ্ধযুগ চলে৷ তারপর আসেন শঙ্করাচার্য৷ শঙ্করাচার্য আবার বেদ–তন্ত্রভিত্তিক ধর্মচেতনা জাগিয়ে তোলেন৷ এরপরই শুরু হয় পৌরাণিক যুগ৷ প্রায় ১৩০০ বৎসর পূর্বে৷ আগেই বলেছি পুরাণ হ’ল লোক শিৰার্থে রচিত নানান্ কাহিনী৷ বলা বাহুল্য, শিবকে কেন্দ্র করে পৌরাণিক যুগে অনেক কাল্পনিক কাহিনীও তৈরী হয়েছে৷

দুর্গাপূজার ইতিহাস ঃ এবার ফিরে আসি দুর্গাপূজার ইতিহাসে৷ দেবী দুর্গা, দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের যে উপাখ্যান–তার উৎস হ’ল মার্কণ্ডেয় পুরাণ, যা ১৩০০ বছর আগে রচিত হয়েছে৷ বেদ বা মূল তন্ত্রে এ ধরণের কোন উপাখ্যান নেই৷ মার্কণ্ডেয় পুরাণ যার সংক্ষিপ্ত নাম শ্রীশ্রী চণ্ডী–তাতে সুরথ রাজার গল্প রয়েছে৷ রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী দুর্গার পূজার কথা কিন্তু এতে নেই৷ এমনকি বাল্মীকি রামায়ণেও নেই৷ আছে কবি কৃর্ত্তিবাসের বাংলা রামায়ণে৷ এখন প্রশ্ণ উঠবে, মূল বাল্মীকি রামায়ণে যখন দেবী দুর্গার কোন উল্লেখ নেই, তাহলে কবি কৃর্ত্তিবাস কোথা থেকে পেলেন?

এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে৷ পাঠান যুগে অর্থাৎ ৭/৮শ’ বছর আগে একসময় উত্তর বাঙলার (অবিভক্ত বাঙলা) অন্তর্গত রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা ছিলেন কংসনারায়ণ রায়৷ তখন বড় বড় জমিদাররাই রাজা বলে পরিচিত ছিলেন৷ প্রচুর তাঁর অর্থ৷ একবার রাজা কংসনারায়ণ রায় পণ্ডিতদের ডেকে বললেন, ‘‘আমি রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাই৷ লোকে জানুক আমার কত ঐশ্বর্য৷’’ পণ্ডিতরা তখন মহাচিন্তায় পড়লেন৷ তাঁরা বললেন,  ‘‘এ যুগে তো রাজসূয় বা অশ্বমেধ করা যায় না৷ হ্যাঁ, তবে আপনি মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে দুর্গাপূজা করতে পারেন৷ এ পূজা রাজকীয় ভাবে করা যাবে, এতে লোকে আপনার ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারবে, আপনার নাম–যশ ছড়িয়ে পড়বে৷’’  তখন রাজা তাতেই রাজী হলেন৷ সে যুগে ৭ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে বিপুল আড়ম্বরে দুর্গাপূজা হ’ল৷ দান–ধ্যান খুব হ’ল৷ রাজা কংসনারায়ণ রায়ের নাম–যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ তখন পরের বছর রাজা কংসনারায়ণ রায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রংপুরের রাজা জগৎবল্লব রায় (মতান্তরে জগৎ নারায়ণ রায়) ৮ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে দুর্গাপূজা করলেন৷ দেখাদেখি অন্যান্য জমিদাররাও দুর্গাপূজা শুরু করলেন৷ এইভাবে প্রায় প্রতি জমিদার বাড়ীতে বেশ জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতে লাগল৷

এই সময়েই কবি কৃর্ত্তিবাস বাংলা রামায়ণ লেখেন৷ তখনকার বড় বড় কবিরা জমিদারদের সাহায্য পেতেন, তাই জমিদারদের খুশী করবার চেষ্টা করতেন৷ তা, জমিদার বাড়ীতে অনুষ্ঠিত এই দুর্গাপূজাকে বিশেষ ভাবে মহিমান্বিত করার জন্যেই জমিদারদের অভিপ্রায় অনুসারেই কবি কৃর্ত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে রামচন্দ্রকে দিয়ে দুর্গাপূজা করিয়ে দিলেন৷ যদিও সংস্কৃতে লেখা মূল বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গার উল্লেখ নেই৷ তুলসীদাসী রামায়ণেও দুর্গার উল্লেখ নেই৷ এই কারণে উত্তর ভারতে দুর্গাপূজার প্রচলন তত বেশী নয়৷ আগে তো ওই অঞ্চলে যে বাঙালীরা থাকতেন, তারাই মিলিতভাবে দুর্গাপূজা করতেন৷ ধীরে ধীরে অবশ্যই অন্যান্যরাও বাঙালীদের দেখাদেখি দুর্গাপূজা শুরু করে দিয়েছেন৷

হ্যাঁ, যে কথাটা ছেড়ে গেলুম৷ আগে তো জমিদার বাড়ীতেই দুর্গাপূজা হ’ত৷ পরে হুগলী জেলার অন্তর্গত বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়াতে একবার বারো জন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন, দুর্গাপূজা তো ব্যয় বহুল পূজা, তাই এসো আমরা বারো জন বন্ধু মিলে সমবেত ভাবে দুর্গাপূজা করি৷ এই ভাবে বারো জন বন্ধু বা ইয়ার (পাঠান আমলে বাঙলায় প্রচুর ফার্সী শব্দ এসেছে৷ ‘বন্ধু’র ফার্সী শব্দ ‘ইয়ার’) মিলে এই পূজা করায় এর নাম হ’ল বারো–ইয়ারী বা বারোয়ারী পূজা৷ এই ভাবে জমিদার বাড়ী থেকে এই পূজা জনসাধারণের মধ্যে এল৷ তখনও যারা তথাকথিত অন্ত্যজ বা শূদ্র–তারা এই পূজায় পুষ্পাঞ্জলি দিতে পারত না৷ পরে এই পূজাকে ‘সর্বজনীন’ ঘোষণা করে’ তথাকথিত শূদ্রদেরও পুষ্পাঞ্জলি দেবার অধিকার দেওয়া হ’ল৷ (শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী রচিত ‘নমঃ শিবায় শান্তায়’ দ্রষ্টব্য)৷

পুরাণ কথিত এই দুর্গা শুভশক্তির প্রতীক৷ আর মহিষাসুর সমাজের অশুভ শক্তি–অকল্যাণকর ধ্বংসকারী শক্তির প্রতীক৷ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের প্রতীক হ’ল দেবতারা৷ তাদের সবার শক্তি মিলিত হয়ে ‘দুর্গা’র রূপ পরিগ্রহ করে৷ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সম্মিলিত ভাবে অশুভ শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করলে অশুভ শক্তি ধ্বংস হতে বাধ্য৷ আর তখনই সমাজে শ্রী সমৃদ্ধি (লক্ষ্মী), জ্ঞান (সরস্বতী), শক্তি (কার্ত্তিক) ও সিদ্ধি অর্থাৎ সাফল্য (গণেশ) লাভ সম্ভব৷ দুর্গোৎসবের এটাই প্রতীকী তাৎপর্য৷

কালীপূজা

দুর্গাপূজার মত কালীপূজার ইতিহাসও খুব প্রাচীন নয়৷ তন্ত্রের উদ্ভব সাত হাজার বছর আগে হলেও কালীপূজার প্রচলন মাত্র চারশ’ বছর আগে৷ এর প্রচলন করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ৷ (শঙ্করনাথ রায়ের ভারতের সাধক–৩য় খণ্ড দ্রষ্টব্য)

কোন দেবদেবীর মূর্ত্তি গড়ে পূজার প্রথা বেদেও ছিল না, মূল তন্ত্রেও ছিল না৷ বেদকে যারা কট্টোর ভাবে মানে সেই আর্য সমাজ মূর্ত্তিপূজার বিরোধী৷

ভারতে মূর্ত্তিপূজা শুরু হয় বৌদ্ধ যুগে৷ এদেশে বৌদ্ধধর্মের প্লাবন যখন আসে তখন দেশের অধিকাংশ মানুষই বেদের যাগযজ্ঞ প্রধান আর্য ধর্ম (ঋষিদের ধর্ম) বা তন্ত্রের দুরূহ সাধনা ছেড়ে দিয়েছিল৷ বৌদ্ধধর্মের সাধনা পদ্ধতিও চক্রের চক্রসাধনা থেকে গৃহিত৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ তো অতসব করত না৷ তারা বুদ্ধের মূর্ত্তির সামনে প্রার্থনা করত৷ মহাযানী বৌদ্ধের যুগে বুদ্ধশক্তি রূপে নানান্ দেবদেবীরও মূর্ত্তি গড়া হতে থাকে৷ তারপর শংকরাচার্যের পর নবীন হিন্দু ধর্মের পুনরুভ্যুত্থান হলে ও সঙ্গে সঙ্গে পৌরাণিক যুগ শুরু হলে পুরাণ বর্ণিত বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্ত্তি গড়ে পূজা শুরু হয়ে যায়৷

কিন্তু তন্ত্রকে কী করে জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করা যায় জনসাধারণ তো আর দুরূহ সাধনা করতে পারবে না তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (১৬–১৭ শতক) গভীর ভাবে এ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলেন৷ কথিত আছে, গভীর রাতে শ্মশানে শাক্তসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ধ্যানধারণায় রত৷ তখন ধ্যানযোগে জগন্মাতা ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যে তাঁকে বললেন, ‘‘নিশাবসানে কাল সর্বপ্রথম যে নারী মূর্ত্তিটি যে রূপে যে ভঙ্গীতে তোমার নয়ন গোচর হবে, তাই হবে আমার সাধক ভক্তজনের হূদয় বিহারিণী মূর্ত্তি৷’’ পরদিন খুব ভোরে কৃষ্ণানন্দ গঙ্গাস্নানে চলেছেন৷ তাঁর চোখে পড়ল, রাস্তার পাশেই একটি কুটির৷ সেই কুটিরের দ্বারে শ্যামাঙ্গিনী এক গোপ–রমনী৷ তাঁর ডান পা কুটিরের অনুচ্চ বারান্দার ওপর স্থাপিত৷ আর বাম পা নীচে মাটিতে৷ ডান হাতে এক তাল গোময়৷ এমনি ভাবে তা উঁচু করে ধরা আছে যেন বরাভয় মুদ্রার প্রতিচ্ছবি৷ বাম হাত দিয়ে বেড়াতে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন৷ রমণীর কেশরাশি আলুলায়িত৷ হঠাৎ আচার্য কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিব কেটে সামান্য মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছেন৷

এই দৃশ্য দেখে কৃষ্ণানন্দের অন্তঃস্থলে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ গত রাত্রির জগন্মাতার নির্দেশ তাঁর মনে ভেসে উঠল৷ তখন তিনি যে মুদ্রায় এই শ্যামাঙ্গিনী রমনীকে দেখলেন তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তন্ত্রে বর্নিত দশমহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা শ্যামা বা কালীর মূর্ত্তি তৈরী করলেন ও এই ভাবে তিনি শক্তিরূপিনী জগন্মাতার পূজা শুরু করলেন ও জনসাধারণের মধ্যে তার প্রচলন করলেন৷

বলা বাহুল্য, দশমহাবিদ্যার যে বর্ণনা তন্ত্রে রয়েছে, সদাশিব প্রবর্ত্তিত প্রাচীন তন্ত্রে নয়, পরবর্ত্তী কালে বিবর্ত্তিত তন্ত্রে, সেই মহাবিদ্যা ছিল আদ্যাশক্তি (আদি’র স্ত্রীলিঙ্গে আদ্যা) অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন ভাবের কাব্যিক বর্ণনা৷ ওই দশমহাবিদ্যার মূর্ত্তি গড়া বা তাদের পূজা করার প্রথা ছিল না৷ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই প্রথম শ্যামাপূজার সূত্রপাত করলেন৷

পূর্বেই বলেছি, সাধকদের মনের বিভিন্ন ধরণের ভাব ঢস্তুন্দ্ব্ত্রগ্গ ও বিভিন্ন তত্ত্বকে পরবর্ত্তী কালে মূর্ত্তিরূপ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন, ভারতবর্ষের ওপর মাতৃত্ববোধ আরোপের ভাবটিকে ‘ভারতমাতা’র মূর্ত্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়৷ তেমনি, কালীমূর্ত্তিও মূল প্রকৃতি বা আদ্যাশক্তির প্রতীকী রূপ৷

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভূতি ব্রহ্ম থেকে৷ দার্শনিক বিশ্লেষণে বলা হয় ব্রহ্ম হলেন শিবূশক্তি৷ (শিব শক্ত্যাত্মকং ব্রহ্ম–আনন্দসূত্রম্ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি)৷ ‘পুরুষ’ মানে ‘পুরে শেতে যঃ সঃ’ অর্থাৎ সমস্ত সত্তার অভ্যন্তরে সাক্ষী সত্তারূপে যিনি বিদ্যমান৷ আর প্রকৃতি হ’ল ‘প্র করোতি যা সা’ অর্থাৎ প্রকার সর্জনী ক্ষমতা)৷ পুরুষ হচ্ছে বিশ্বের উপাদান কারণ–চৈতন্য সত্তা৷ আর প্রকৃতি হ’ল ক্রিয়াশক্তি৷ যেমন, একটা স্থূল উদাহরণ দিয়ে জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷ একতাল মাটি থেকে নানান্ পুতুল গড়া হ’ল৷ এই মাটি হ’ল উপাদান কারণ৷ এই মাটি থেকে নানান্ পুতুল গড়ার জন্যে একটা ক্রিয়াশক্তি দরকার৷ বলা হচ্ছে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল উপাদান কারণ হ’ল চৈতন্য সত্তা–পুরুষ৷ আর আপাতঃ নিমিত্ত কারণ বলতে পারি প্রকৃতি–একেই বলা হয় আদ্যাশক্তি৷ পুরুষ তথা চৈতন্যের ওপর শক্তির লীলানৃত্য চলছে৷ তারই প্রতীকী মূর্ত্তি হ’ল শিবের বক্ষে কালীমূর্ত্তি৷ কালীর রঙ কালো৷ কারণ, সৃষ্টির আদিতে তখন কোন বর্ণ সৃষ্টি হয়নি৷ কালো রঙ হ’ল সব বর্ণের অনুপস্থিতির দ্যোতক৷ আদ্যাশক্তি অসীম৷ তাই কোন বসন দিয়ে তাকে ঘেরা যাবে না–তাই তিনি বিবসনা৷ গলায় মুণ্ডমালা কেন? তান্ত্রিক সাধকের গান আছে–

‘‘আদিভূতা সনাতনী শূন্যরূপা শশীভালী,

ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’’

আদ্যাশক্তি কালী৷ বিশ্বজননী তিনি৷ বিশ্ব যখন সৃষ্টি হয় নি, তখন মানুষের মুণ্ড তিনি কোথায় পেলেন? –আসলে ব্যাপারটা হ’ল, ওগুলো তো আসলে মুণ্ড নয়, এক একটা ভাব৷ কিসের ভাব? বিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে সৃষ্টি হয় মূল ৫০টা ভাব তরঙ্গ৷ প্রশান্ত বিশুদ্ধ চৈতন্যের সমুদ্র বক্ষে প্রথম দেখা দিল তরঙ্গ৷ যেখানে তরঙ্গ সেখানে শব্দও আছে–যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন৷ তাকেই বলে বীজমন্ত্র৷ এক একটি ভাব হ’ল এক একটি বীজমন্ত্র৷ একে বলা হয় মাতৃকা বর্ণ৷ এমনি ৫০টি–যা সংস্কৃত বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ৷ এই বর্ণের শব্দ কিভাবে উচ্চারণ করি? –মুখ দিয়ে৷ তাই এক একটা মুখ অর্থাৎ মুখ সমন্বিত মুণ্ড এক একটা বর্ণ বা ধ্বনির প্রতীক৷ এই ৫০টি বর্ণের মালাকে বলা হয় অক্ষ মালা৷ অর্থাৎ বর্ণমালার আদি বর্ণ–‘অ’ থেকে বর্ণমালার শেষ বর্ণ ‘ক্ষ’ (সংস্কৃত বর্ণমালায় ‘ক্ষ’ হ’ল সর্বশেষ মাতৃকা বর্ণ)৷

কালীর গলায় অক্ষ মালা৷ হ্যাঁ, আবার বলা হ’ল ‘অ’ সৃষ্টি বীজমন্ত্র তাই ‘অ’–এর দ্যোতক মুণ্ডটা কালী হাতে ধরে রেখেছেন৷ আর ৪৯টি গলায়৷ এই হ’ল মুণ্ডমালার ব্যঞ্জনা৷

এই হ’ল সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতীকী রূপ৷ এটা একটা দার্শনিক তত্ত্ব৷ কিন্তু তন্ত্রের সাধনা বিজ্ঞানে কী বলা হচ্ছে? বিশুদ্ধ চৈতন্যসত্তা–‘শিবে’র সঙ্গে জীব ভাবের মিলন মিটাতে হবে৷ আর তার জন্যে তন্ত্রে রয়েছে ষট্চক্র সাধনা, মনকে একাগ্র করে’–বিন্দুস্থ করে’ ‘পরম শিবে’ তথা ব্রহ্মে লীন করতে হবে৷ এরই নাম ব্রহ্মসদ্ভাব বা ব্রহ্মসাধনা৷ আর তার জন্যে জপ–ধ্যান ক্রিয়াও রয়েছে৷ তন্ত্রে বলা হয়েছে–

উত্তমো ব্রহ্ম সদ্ভাবো, মধ্যমা ধ্যান ধারণা৷

জপস্তুতি স্যাদধমা মূর্ত্তি পূজা ধমাধমা৷৷

–অর্থাৎ সর্বোত্তম হ’ল ব্রহ্মসদ্ভাব বা ব্রহ্মসাধনা৷ ব্রহ্মসদ্ভাব যার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না, সে ধ্যানধারণা করবে৷ এটা হ’ল মধ্যমপথ৷ ধ্যান–ধারণা যে করতে পারছে না, সে জপস্তুতি করুক৷ এটা হচ্ছে অধম পথ৷ আর তাও যে পারছে না তার জন্যে মূর্ত্তিপূজা৷

আর, হ্যাঁ, কালীপূজা করা হয় অমাবস্যায়৷ সেই সঙ্গে দীপাবলী উৎসবও হয়৷ কার্ত্তিকের এই অমাবস্যাকে বছরের সবচেয়ে বেশী–ঘোর অন্ধকার বলে’ বলা হয়৷ এই অন্ধকারকে সরিয়ে আলো জ্বালাতে হবে৷ দীপাবলী ও কালীপূজার ইঙ্গিত এইটাই৷ কেবল বাইরের অন্ধকার হটানোর কথা বলা হচ্ছে না, আমাদের মনের অন্ধকার হঠাতে হবে, অন্তরের চিতিশক্তির অর্থাৎ শুদ্ধ চৈতন্যশক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে–আত্মশক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে৷ এটাই তন্ত্র সাধনার মূলকথা৷