একদিনের নয় রোজের ‘বাঙালী’ হই রোজ বাংলা বলি

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

একুশে ফেব্রুয়ারী...বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে পাঁচ তরুণ ছাত্রের আত্মবলিদানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের এক সপ্তাহও কাটেনি! একুশ তারিখ অধিকাংশ বাঙালী জনসাধারণের ফেসবুক জুড়ে পোস্ট দেখলুম আমি গর্বিত আমি বাঙালী, বাংলা আমার মাতৃভাষা..... শফীউর, সালাম, বরকত সালাউদ্দিন, রফিক, পঞ্চবঙ্গ সন্তানের আত্মাহুতির ঘটনাটি ঘটা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশবাসী দুই বাঙালীর প্রচেষ্টায় দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক স্বীকৃত পেয়েছিল বলে অন্তত একটি দিন হ্যাঁ, ওই একটি দিন বাঙালীরা বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে থাকে৷ বাকি ৩৬৪ দিন তো আগে ছিল ‘‘বাংরেজি’’ (বাংলা ইংরেজির খিচুড়ি) আর এখন ‘‘হিন্দরেজি (হিন্দী ইংরেজী খিচুড়ি) ভাষায় কথা বলে আত্মতৃপ্তি ঢেঁকুর তুলে নিজেদের  ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের  অন্তর্ভুক্ত মনে করাটাই বর্তমান অধিকাংশ বাঙালী জনসাধারণের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অনেককেই প্রশ্ণ ছুঁড়তে পারেন হিন্দী বা ইংরেজীতে কথা বললে কি অপরাধ হয়ে যায়? না, অবশ্যই অপরাধ নয়৷ ইংরেজি, হিন্দী বা অন্য যেকোন ভাষা শেখা বা কথা বলা অপরাধ তো নয়ই বরং সেই ব্যক্তির গুণেরই একটি বহিঃপ্রকাশ৷ তাহলে অপরাধ কোথায়? উত্তরে বলি---অপরাধটি আপোষে..অন্যায়কে সহ্য করা আপোষ করাটাই অপরাধ৷ রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ জোর করে সরকারি বেসরকারি দফতর সহ সমস্ত কাজে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হিন্দী ভাষার পরিষেবা প্রদানে বাধ্য করে বাংলা ভাষাকে অবদমিত করছে ও পাশাপাশি নবপ্রজন্মের মুখ থেকে মাতৃভাষা বাংলা কেড়ে নিয়ে তাদের স্বাধীন সচেতন, হয়ে দাঁড়াচ্ছে চিন্তাভাবনার অন্তরায়৷ ফলস্বরূপ নবপ্রজন্মের বাঙালী সমাজের চিন্তাভাবনা হিন্দী গোবলয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ বাংলা ভাষার সিনেমাই ভারতকে প্রথম অস্কার দিয়েছে... সেই বাংলা ভাষায় কথা বলতে আজ বাঙালী লজ্জা পায়... এ লজ্জা মানব জাতের লজ্জা৷ মাতৃভাষায় কথা বলতে, মাতৃভাষায় পরিষেবা পাওয়ার সমস্ত রকম অধিকার ভারতীয় সংবিধান দেওয়া সত্ত্বেও সেই অধিকার না চাওয়া অন্যায়৷ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শোষণবাদকে সহ্য করে আপোষ করে চলা অন্যায় ও পাপ৷ রবি ঠাকুর বলেছেন--- অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে৷ আর নিজের অধিকারবোধ জন্মানো বা চাওয়াকে যারা প্রাদেশিক বা সাম্প্রদায়িক বলে অপপ্রচার করে থাকে তাদের ন্যায় কঙ্কালসার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের শুধু ধিক্কার নয়... তারা আধুনিক সমাজে বসবাসের যোগ্য নয়৷ এই অন্যায়কে প্রথম থেকে রোধ করা হয়নি বলে আজ সমগ্র বাঙলার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত মুনাফাখোর অবাঙালী পুঁজিপতিদের হাতে৷ তারা রোজ মুনাফার কোটি কোটি টাকা পাচার করছে বাঙলার বাইরে৷ বঙ্গমাতার ভাণ্ডার লুঠপাট চলছে৷ বাঙালী নীরবে সহ্য করছে৷ বাঙলার রাজধানী কলকাতা গেলেই দেখা যাবে, বেওসায়ী (ব্যবসায়ী) অবাঙালী, মুঠেওয়ালা, ঠেলাওয়ালা তারাও অবাঙালী৷ গত বছর অক্টোবরে মাননীয়া রাষ্ট্রপতির নিকট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন সংসদীয় ভাষা কমিটির সুপারিশ যে, কেন্দ্রীয় শিক্ষা-চাকরিসহ সর্বস্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অ-হিন্দীভাষীদের জন্য চালু থাকা হিন্দীর পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্য ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার যে ব্যবস্থা আছে তা বাতিল করে শুধু হিন্দীকেই ব্যবহার করতে হবে! শুধু হিন্দীতেই পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে! প্রশাসনিক পদের প্রবেশিকা ও চাকরির পরীক্ষাতেও হিন্দীকে লালন পালন করে অবাঙালীদের অতিরিক্ত সুযোগ করে দিয়ে প্রশাসনিক স্তরে বাঙালী শূন্য করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে৷ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাভাষীদের বিদেশী বাংলাদেশী বলে আবার ভিটেমাটি ছাড়া করে সেই স্থান অবাঙালী বেনিয়াদের দখলে এনে বাঙলার মা-বোন-সম্পদ-সম্পত্তির উপর পুনরায় থাবা বসানোর প্রক্রিয়াকরন চলছে৷ বাঙালী সাবধান...লড়তে হবে৷ লড়াই-ই জীবনের মূলমন্ত্র৷ লড়াই ছাড়া গতি নেই৷ সংগ্রাম হিন্দী বা ইংরেজী বা অন্যকোন ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়৷ কিন্তু যে ভাষাকে চাপিয়ে আমাদের বাংলা ভাষাকে কেড়ে আমাদের স্বাধীন চিন্তাকে অবরুদ্ধ করে আমাদের বাস্তুচ্যুত করে সম্পদ-সম্পত্তির দখল নিয়ে আমাদের বিদেশী চিহ্ণিত করে দেশছাড়া করার যে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত হিন্দী ভাষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই৷ বাঙলার মাটিতে কাজে-কর্মে, অফিস-আদালতে, রেলে-বিমানে, প্রেমে-ঝগড়ায় কোথাও হিন্দীকে স্থান দেব না দেব না দেব না দেবনা৷ ভাষা শিখতে আপত্তি নেই কিন্তু বাঙলার ভূমিতে অন্যায়ভাবে মাতৃভাষা বাংলাকে জলাঞ্জলি দিয়ে হিন্দীর ব্যবহার বাঙালীদের বিপদ বাড়াবে বই কমাবে না৷ কবিগুরুর ভাষায়-‘‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দ’’৷ মাতৃভাষাকে অবহেলা করে কোন জাতি উন্নত হতে পারেনি বন্ধু৷ আমরা অনেকেই ইংরেজীকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেখাতে গিয়ে বাংলাকে অবহেলা করে থাকি৷ কিন্তু অদ্ভূত লাগে ভাবতে ইংরেজী প্রাধান্যে প্রভাবিত খোদ লণ্ডনেই ‘‘বাংলা’’ সরকারিভাবে  স্বীকৃত দ্বিতীয় ভাষা৷ লণ্ডন ছাড়াও নিউইয়র্ক সহ বহির্ভারতের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষা সরকারি স্বীকৃতি প্রাপ্ত ভাষা৷ রাষ্ট্রপুঞ্জ আমাদের মাতৃভাষা ‘‘বাংলা’’ পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টিমধুর ভাষা বলে সম্মানিত করেছে৷ তাহলে কীসের হীনমন্যতা, কীসের সংকোচ...আসুন না আমরা বাঙালীরাই গর্বের সাথে বাংলা বলি হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত কু-চক্রান্ত ভেদ করে আমাদের প্রাণের ভাষা ও বাঙলার উন্নত সংস্কৃতিকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের জীবন সার্থক করে তুলি৷