ভারতের বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা ও অসমের ১৯ শে মে’র শিলচরের বাংলা ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির কাছে এক স্পর্শকাতর আবেগ মথিত বিষয়৷ ঘটনাগুলির উত্থাপন ও স্মৃতি রোমান্থনে আমরা যুগগৎ স্বজন হারানোর ব্যথায় বেদনার্ত হই ও স্বজাতির মহিমাময় আত্মত্যাগে গর্ব অনুভব করি৷ এক দুটো উদ্ধৃতিতে তার প্রমাণ মেলে –
‘‘মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে৷
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা বন্দীশালার ঐ শিকলভাঙা
তারা কি ফিরিবে আজ
তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে
যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগাল আশা
মৌন মলিন – মুখে জাগাল ভাষা
আজি রক্ত কমলে গাঁথা
আজি রক্ত কমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয় লক্ষ্মী দেবে তাদেরি গলে৷৷’’
অথবা
‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এই ফেব্রুয়ারী
আমি কি করে ভুলিতে পারি?
সত্যিই কি তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম বা ভাষা আন্দোলনকে কতটা আমরা হৃদঙ্গম করেছি বা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছি৷
সে বিষয়ে মনে প্রশ্ণ জাগে, সংশয় সৃষ্টি হয়৷ স্বাধীনতা দিবস ও ভাষা আন্দোলনের মঞ্চে আমরা বাচনিক শৈলি ও আবেগ মথিত ভাষণে শ্রোতৃমন্ডলীকে মুগ্ধ করে ফেলি, বক্তা হিসাবে হাততালি কুড়াই কিন্তু বাস্তবে ওই আন্দোলন আমাদের কতটা প্রভাবিত করেছে, শহীদদের প্রদর্শিত ও আদর্শায়িত পথ কতটা আমাদের দ্বারা অনুসৃত হচ্ছে তা বিচার করে দেখা যেতে পারে৷
রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কি পেয়েছি? উৎকট শ্রেণী বৈষম্য, জাতপাতের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক নেতাদের দাদাগিরি, ষড়যন্ত্র, খুন–জখম, রাহাজানি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ লেগেই আছে৷ প্রেম, ভালোবাসা, জাতীয়তাবোধ আজ তিরোহিত ৷ আছে শুধু বল্গাহীন লোভ, শোষণ–পীড়ন–নির্যাত্৷ অন্যকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার প্রবণতা আজ প্রবল৷ ঠক বাটপাড়ে দেশ ভরে গেছে৷ মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি৷ জাতীয় ভাবধারা ও কৃষ্টি সভ্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার অনুসৃতি ও পশ্চিমী অর্থনীতির মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন–যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি৷ ধীরে ধীরে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলতে বসেছি৷ আজ জাতীয় চরিত্রের অধঃপতন ঘটেছে৷ আমরা ঐতিহ্য হারাতে বসেছি৷
আর মাতৃভাষার কথা? মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য তা বেশি না বলাই ভালো৷ ব্রিটিশ আমলে দেখেছি কিছু রায় বাহাদুর খেতাবধারী ব্রিটিশ অনুসারী ও কিছু তাঁবেদার প্রভুদের আদব কায়দা, মায় ভাষার ব্যর্থ অনুকরণ করত৷ দেশীয় আচার, সভ্যতা অনুসরণ করতে তাঁরা লজ্জাবোধ করতেন ও মাতৃভাষার ঘোর বিরোধিতা করতেন৷ এইসব তাঁবেদারদের ইংরেজি ভাষায় কথা বলার নমুনা ছিল খুবই হাস্যকর৷
এক বাঙালি কর্মচারী বণিক ইংরেজকে বিষাদের সঙ্গে জানালেন ‘আওয়ার শিপ ইজ এইটি ওয়ান স্যার’ ইংরেজ অবাক, কি বলতে চায় এই নেটিভ আকারে ইঙ্গিতে কর্মচারিটি জানাল তাদের জাহাজ ‘একাশি’ বলতে এককাত হয়ে জলে ডুবে গেছে৷ বৈষয়িক ক্ষতিগ্রস্ত ইংরেজ নিশ্চয়ই তাঁর কর্মচারীর ইংরেজি বলার ধরণ ও নমুনা দেখে হতাশ হয়েছিলেন৷ অথবা এক অনুগত কর্মচারী তাঁর মনিবকে তাঁর পদোন্নতির জন্য বলেন – ‘আই শ্যাল ইট ইড ওয়ান ডে স্যার’’৷ – মনিব তো ভয় পেয়ে যান৷ কি বললে বাবা, ও কি পাগল হয়ে গেল নাকি৷ অবশেষে সে খুশি হয়েছে এই জেনে যে, কৃতজ্ঞতা বশতঃ মনিবকে সে এক দিন খাওয়াবে৷ এই হল ইংরেজি জানা তাঁবেদারদের বিদেশী ভাষা জ্ঞানের দৌড়৷ এরাই একদিন মাতৃভাষা বাংলা মাধ্যম করার বিরোধিতা করেন৷ ইংরেজদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন – বাংলায় বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও আইন শেখা যায় না৷ সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, জগদানন্দ রায়, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যষ্টি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব৷ এগিয়ে আসেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়৷ বিশ্ববিদ্যালয় ও সুক্ল কলেজ স্তরে বাংলা ভাষা সাহিত্যকে পাঠ্যক্রমে আনেন ও তার প্রচার ও প্রসার করতে প্রয়াসী হন৷ সেই প্রয়াসের ফলশ্রুতি প্রায় এক শতাব্দীর পর ১৪০০ সনে পশ্চিমবঙ্গে ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ’ (সরকারী কাজের ভাষা) হয় বাংলা ভাষা৷ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজও তা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি৷ আমাদের আমলা ও কেরাণী–কুলের তাতে নাকি প্রকাশ্যে অসুবিধা হয়, আভিজাত্যে লাগে৷ বাংলাদেশের অফিস কাছারীর সমস্ত কাজ বাংলায় লেখাজোখা হয়৷ তারা পারে আমরা পারি না কেন? আমাদের সেই চেষ্টা নেই৷ আমরা আন্তর্জাতিক ইংরেজি ও রাষ্ট্রভাষা হিন্দীর ব্যাপক অনুসরণ ও অনুকরণে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখতে ও লেখায় তা ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হই, অনভ্যাসে তা পারি না৷ যাঁরা বিদ্যাবুদ্ধির গর্ব করেন ‘মাতৃভাষা শেখার কি আছে’ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, তাঁরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না৷ তাঁরা ইংরেজি, হিন্দি বাংলার মিশ্রণে কথা বলেন৷ আর লেখার বেলায়, সাধু চলিতের মিশ্রণ, বানান ভুলে ভরা ও বাক্য গঠনে ত্রুটি প্রভৃতি বিচ্যুতিতে ভরা থাকে তাদের লেখা৷ অত্যন্ত লজ্জার বিষয় বাঙালি বাংলা ভাষায় একটা দরখাস্ত ও চিঠি লিখতে পারে না৷ শুদ্ধ একটা বাক্য লিখতেও আজ আমরা হোঁচট খাই৷ পারব কি করে, আমাদের রাষ্ট্র, রাজ্য ও অভিভাবকগণ তার জন্য দায়ী৷ বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ বা বিতরাগ অথবা অবজ্ঞা একটি মাত্র উদাহরণে উপলব্ধি করা যাবে৷
১৯৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকস্তরে কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান শাখায় বাংলা ভাষাকে ‘আবশ্যিক ঐচ্ছিক’ করলেন৷ আবশ্যিক আবার ঐচ্ছিক কি করে হয়? এতো দেখি ‘সোনার পাথর বাটি’ বা ‘কাঁটালের আমসত্ত্ব’ গোছের কথা৷ আসল কথা বাংলা, হিন্দী, ওড়িয়া প্রভৃতি ভারতীয় ভাষার মধ্য থেকে একটাকে ইচ্ছা মতো বেছে নিতে পারবে৷ ভারতীয় ভাষা নিতেই হবে তাই আবশ্যিক, যে কোনো একটি তাই ঐচ্ছিক৷
একদা স্নাতক স্তরে ভার্নাকুলার পড়তেই হোত৷ আজ তা হ’ল ঐচ্ছিক৷ আরও একটা বিষয় হল – ১০০ নম্বরের ওই পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে বসতেই হবে কিন্তু ফেল বা শূন্য পেলে ক্ষতি নেই৷ আমি পাঠকের কাছে জিজ্ঞাসা করি শিক্ষার্থীরা কি এই আবশ্যিক বিষয়টি পড়বে বা ক্লাস করবে? না৷ এই বিষয়ে অধ্যাপক হিসাবে দেখেছি শিক্ষার্থীরা কোনো ক্লাস করেনি, বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি, শুধু পরীক্ষায় বসেছে বাংলায় শূন্য পেয়েও অন্যান্য বিষয়ে পাশ করার দরুণ স্নাতক হয়েছে৷ বাংলা ভাষার প্রতি অমর্যাদা, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য আর কি হতে পারে? পাঠ্যক্রম প্রণেতা ও শিক্ষার্থী উভয়ের দ্বারা বাংলা ভাষাকে অবহেলা করা হল৷ তাদের কাছ থেকে শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখা আশা করা অনুচিত৷ তারপর আছে জ্ঞানী ব্যষ্টিদের দ্বারা বাংলা ভাষা ও বানান সংস্কার৷ রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘কথা ও কাহিনী’, ‘গ্রন্থাবলী’ এখন লিখতে হবে ‘কাহিনি’,‘গ্রন্থাবলি’৷ ‘প্রাণী’ একই বানান রইল, কিন্তু শ্রেণী বানান লিখতে হবে শ্রেণি৷ প্রাণী তৎসম শব্দ একই রইল কিন্তু তদ্ভব বলে শ্রেণীর নতুন বানান হ’ল শ্রেণি৷ বিচিত্র এসব সূত্র ও ফর্মূলা৷ বলাই বাহুল্য এই বানান সংস্ক্রণ সমস্যা সৃষ্টি করেছে, একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে৷ বানানের কোনো যুক্তি গ্রাহ্য নিয়ম বা সূত্র দেওয়া হয়নি৷ পাকিস্তানের রাজাকার গোষ্ঠীর মতো আমাদের দেশের অন্যান্য প্রদেশ বাংলা ভাষাকে অবদমিত করতে সর্বদা সচেষ্ট৷ কেন্দ্রীয় সরকার সর্বদাই হিন্দীকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়৷ তা ছাড়া পথেঘাটে আলোচনা, সিনেমা–টিভি, রেডিও, বিজ্ঞাপন সর্বত্রই হিন্দি আর ইংরেজি শুণতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি৷ পড়াশুনার ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষক অভিভাবকের পরামর্শ– ‘অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্ব দাও’, বাংলা? ‘ও এমনিই হয়ে যাবে’৷ বিদ্যার্থীর পরামর্শদাতারা শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে বারণ করেন৷ অগোচরে বাংলা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে৷
২১শে ফেব্রুয়ারীর বিশেষ সভামঞ্চে আবেগময় বত্তৃণতা ও লোক দেখানো বাংলা ভাষা প্রীতি না দেখিয়ে বক্তা ও অনুরাগীদের মাতৃভাষার প্রতি আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে অনুরোধ করি৷ তা হলে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠভাষা বাংলা ভাষার উন্নতি হতে বাধ্য৷ এত মানুষের প্রয়াস সাধনা ও শপথ ব্যর্থ হতে পারে না৷ ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে আমাদের এই প্রার্থনা হোক–
‘‘মাতৃভাষার অপমান দূর হোক, যুগশিক্ষার উদ্বেলধারা বাঙালীর চিত্তের শুষ্ক্ নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়ে বয়ে যাক, দুই কূল জাগুক পূর্ণ চেতনায়, ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দ ধ্বনি৷’’ – রবীন্দনাথ ঠাকুর৷
- Log in to post comments