একুশেফেব্রুয়ারী দিনটি বাঙালীর কাছে গর্বের দিন

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

আশাকরি পাঠকবৃন্দ দিনটির তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত আছেন, তথাপি নবীন প্রজন্মের যাদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নেই, তাদের জন্য ঘটনাটি সংক্ষেপে বলি-১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঊর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বর্তমান বাঙলাদেশের পাঁচ তরুণ ছাত্র (রফিক, বরকত, আব্দুল জববর, সালাউদ্দিন ও আতায়ূর রহমান) প্রাণ দিয়েছিলেন৷ তাঁরাই প্রথম জগৎবাসীকে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে জীবন বিসর্জন দিতে হলেও  পিছু না হাটার শিক্ষা দিয়েছিলেন৷  সেই বীর আত্মবলিদানকারী অমর ৫ ভাষা শহীদদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করি৷

আজ এই  একবিংশ শতকে যদি বিচক্ষণতার সাথে লক্ষ করি তাহলে সহজেই দেখতে পাব, ভারতবর্ষে বাঙালী জনগোষ্ঠীর মুখের  ভাষা ‘বাংলা কে কেড়ে নেওয়ার  সবরকমের প্রয়াস বিদ্যমান৷ ভারতীয়  সংবিধান অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি যেকোন রকমের কাজে মাতৃভাষায় পরিষেবা পাওয়ার অধিকার  সকল ভারতবাসীর৷ হিন্দীভাষীরা সে অধিকার পেলেও  বঙ্গভাষীর কপালে জুটছে শুধু বঞ্চনা৷ স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালীর কাঁধে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হল হিন্দী-ইংরেজি৷ হিন্দী ইংরেজী বা অন্য যেকোনো ভাষা শিখতে কোন আপত্তি নেই, তাছাড়া বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য সংযুক্ত ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানার প্রয়োজন আছে৷ তবে বাঙালীকে তার মাতৃভাষা বাংলায় সরকারি বেসরকারি সমস্ত কাজে পরিষেবা পাওয়া অধিকার রাষ্ট্রহরণ করতে পারে না৷ কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির পরীক্ষাগুলি মূলত হিন্দী-ইংরেজীতে নেওয়ার ফলে হিন্দী ভাষীরা যতটা  সহজে  উত্তর দিতে পারছে ঠিক ততটাই কষ্ট করেও  সাবলীলভাবে উত্তর দিতে পারছে না বাঙালীরা৷ মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে উত্তর দেওয়া যতটা সহজ অন্যের ভাষায় ঠিক ততটা নয়, তাই বাঙালীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সব কেন্দ্রীয় চাকরির পরীক্ষাগুলো যাতে অবিলম্বে আঞ্চলিক ভাষা অর্থাৎ বঙ্গের ক্ষেত্রে  বাংলা ভাষাতেও নেওয়া হোক৷ অনেকে মনে করতে পারেন হিন্দী রাষ্ট্রভাষা তাই সবার হিন্দী শেখা প্রয়োজন, যদি এমন চিন্তা কেউ পোষন করে থাকেন তাহলে তা সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত, কারণ-ভারতের সংবিধানে কোনরাষ্ট্রভাষার উল্লেখ নেই, হিন্দী আমাদের রাষ্ট্র ভাষা নয়৷ করোনাকালে যখন দেশজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা চলছে তখন মোদী সরকারের আনা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ার  সমস্ত গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও ‘‘বাংলা’’ ভাষাকে  ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হল না৷ ৭০ শতাংশ বাঙালী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় গুলিকে বন্ধ করে সেখানকার বাঙালীকে  জোর করে হিন্দীতে পড়াশোনা করাতে বাধ্য করা হচ্ছে৷

কলকাতার ৭৫টির বেশী বাংলা মাধ্যম স্কুল করা হয়েছে৷ এছাড়া খুব সূক্ষ্মভাবে  হিন্দী না জানলে তুমি স্ট্যাণ্ডার্ড নও, মর্ডান নও, এমনকি  (স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও) বাঙালী হিন্দী ভাষা না জানলে নাকি ভারতীয় নয় এই সূচক হীনমন্যতাবোধ প্রদানকারী চিন্তাভাবনা প্রচার যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে বাঙালীর মনে সূচিকা ভরণ করা হচ্ছে৷ বাঙালীর মনন থেকে চিন্তন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা সম্পর্কে এক অবজ্ঞার ভাব তৈরী করা হচ্ছে৷ এর ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি কলকাতা তথা পঃবঙ্গের  দোকানগুলির সাইনবোর্ড থেকে  ক্যাশমেমো অধিকাংশতেই ‘বাংলা’ ভাষা উধাও৷ বিগত কয়েকবছর আগে সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব) পার্র্লমেন্টে ‘বাংলা’তে বত্তৃণতা করাতে অনেক বাঙালীই তার বিরোধিতা বা ঠাট্টা করেছিল৷ অতএব ভেবে দেখুন বাঙালীর কাছে তার মাতৃভাষা বাংলা ভাষার  প্রতি কতটা  অবজ্ঞা তৈরী করানো হয়েছে৷ অনেক মায়েরা সন্তানের থেকে ‘মা’ নয় ‘মাম্মি’ বা ওই জাতীয় ডাক শুনতে বেশী পছন্দ করছেন না হলে নাকি  নিজেকে বড্ড ব্যাকডেটেড বলে মনে হয়৷ কয়েক দশক আগে অবধি বাঙালীরা গুরুজনদের মাসি ‘মা’, কাকি ‘মা’ মাসি ‘মা’, জেঠি ‘মা’, কাকু ইত্যাদি বলে সম্বোধন করত৷ কিন্তু এখন ‘আন্টি’’& ‘‘আঙ্কল’’ ইত্যাদি শব্দই বাঙালী ছেলেমেয়েদের গুরুজনদের প্রতি বেশী ব্যবহার করতে শোণা যাচ্ছে৷ এতে একদিকে বাঙালী তার নিজস্বতা হারিয়ে অন্যের ভাষার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে অপরদিকে বাঙালী শিশুমনে ‘‘নারীদের প্রতি মাতৃ সম্বোধন’’ ঠিক সেভাবে আর গড়ে উঠছে না৷

বর্তমানে ঠিক এইরকম সূক্ষ্মভাবে বাঙালীকে তথাকথিত আধুনিকত্বের মোড়কে রাঙানো হিন্দীর নেশায় ‘‘বাংলা’’ ভাষার অবদমনের  কথা বুঝতে না পারার ও সর্বস্তরে হিন্দী আগ্রাসনের খুবই ছোট্ট একটি চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম, পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইল৷ ব্রিটিশ শাসনকালে রাজনৈতিক সচেতন বাঙালীর বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র ভারতবাসী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল, ও পরবর্তীতে ব্রিটিশকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল যদিও দেশ ছাড়ার আগে ব্রিটিশ বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে উদ্বাস্তুতে প্রতিপন্ন করে গেছে৷ ব্রিটিশের নীতিতে পা মেলানো হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বুঝেছে ভারতে অর্থনৈতিক শোষণ চালাতে গেলে বাঙালী নামক জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে৷ আর তাই স্বাধীনোত্তর ভারতে এই উদ্বাস্তু বাঙালীদের নিয়ে পুতুল খেলা করছে হিন্দী  সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর মদতপুষ্ট বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি৷ স্বাধীনতার নামে পঞ্জাব ও বাঙলাকে ভাগ হয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে প্রত্যেকটি পঞ্জাবিকে পুনর্বাসন, অর্থ দেওয়া হলেও রাজনৈতিক দলগুলির বাঙালী বিদ্বেষী মনোভাবের জন্য স্বাধীনতার ৭৫ বছর হতে চললেও একটি বাঙালীকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়নি৷ রেললাইনের ধারে ফুটপাথে চোখ গেলে দেখতে পাওয়া যায় উদ্বাস্তু বাঙালীদের দুর্দশা৷ একই কারণে বাঙালীর মুখের ভাষা  কেড়ে নিয়ে বাঙালীর জীবনীশক্তি তথা প্রাণধর্মকে নিঃশেষ করে বাঙালীর মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে উদ্যত সেই গোষ্ঠী

বাঙালীকে এখন এই সুচতুর কুচক্রান্ত  ভেদ করে, ভারতবর্ষকে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরম শোষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে৷ তাই বাঙালীকে বাঁচতে হবে, তার জন্য সর্বাগ্রে ‘বাংলা’ ভাষাকে বাঁচাতে হবে৷ মাতৃভাষা বাঁচলে জনগোষ্ঠী বাঁচে, বাংলা বাঁচলে বাঙালী বাঁচবে৷

তাই সকল বিবেকশীল, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালীর কাছে অনুরোধ  আপনারা গর্জে উঠুন, বাংলা ভাষাকে বাঁচান৷ রেল,ব্যাঙ্ক, বিমান বন্দরসহ  সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবীতে গণ আন্দোলন গড়ে তুলুন৷ তরুণ প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে ‘‘বাংলা ভাষা সবচেয়ে মধুর ভাষা’’ এই কথাটি রাষ্ট্রসংঘ স্বীকৃত৷ বাংলা কোন তৃতীয় শ্রেণীর ভাষা নয়৷ এই বাংলা ভাষাতেই কথা বলতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ বহু বিশ্ববরেণ্য বাঙালী, যাঁদের আলোকে ভারতবর্ষ আজও আলোকিত৷ শেষ করার আগে মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন  সরকারের একটি উক্তি বলি- ‘গোটা পৃথিবীকে সাহায্য করবে এই বাঙলার মানুষ৷ গোটা বিশ্বকে আলোকবর্তিকা প্রদর্শন করাই হবে এই বাঙলার মানুষের কাজ৷