এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

অজস্র বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশ আমাদের মাতৃভূমি এই ভারতবর্ষ৷ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, জাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাত্রবর্ণ, সামাজিক রীতিনীতি, কৃষ্টি সংস্কৃতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত মানুষের বাস এই বিশাল দেশে৷ কশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত এই দেশ ভূসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ,  প্রাণী ও মানবসম্পদে সমৃদ্ধ৷ এছাড়া রয়েছে জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত বিভিন্নতা৷ এত বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা সত্ত্বেও  সমগ্র দেশ মিলনের ঐতিহ্যে মৈত্রীর বাঁধনে একসূত্রে গাঁথা৷ এই দেশের মহান আধ্যাত্মিকতার আদর্শ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্র্চ, ভারতবাসীগণের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুদূঢ় অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন দেশের মানুষজনকে  আকর্ষণ করেছে৷ বিভিন্ন সময়ে বহু পরিব্রাজক, পর্যটক শান্তির খোঁজে ভারতবর্ষে এসেছেন৷ রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ,নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চৈতন্য মহাপ্রভু, গৌতমবুদ্ধ, বর্দ্ধমান মহাবীর, প্রভৃতি মনীষী- মহাপুরুষদের দেশ এই ভারতবর্ষের নাম বিশ্ববাসী অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন৷

২০১৯ সনের আগষ্ট মাসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, সরকারী সিদ্ধান্ত ও দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া আগামী দিনের ভারতীয় জনজীবনে এক সূদূর প্রসারী প্রভাবের ইঙ্গিতবাহী৷ গত ৫ই আগষ্ট রাজ্যসভায় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি  রদ ও জম্মু-কশ্মীর পূনর্গঠন বিল পাশ হয়৷ সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সংসদে দুটি প্রস্তাব আসে--- ১) সংসদ রাষ্টপতিকে সুপারিশ করছে, তিনি সরকারী  বিজ্ঞপ্তি জারী করে ঘোষণা করুণ যে ৩৭০ ধারার প্রথম উপধারা ছাড়া আর কিছুই কার্যকর থাকবে না৷ ৩৭০ ধারার প্রথম উপধারায় বলা হবে, দেশের সংবিধান জম্মু-কশ্মীরে পুরোপুরি কার্যকর হবে৷

২) জম্মু-কশ্মীরে ২০১৮ সনের ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে৷ বিধানসভার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে৷ তাই তিনি সংসদকে সুপারিশ করছেন জম্মু-কশ্মীর পুনর্গঠন বিল পাশ করা হোক৷  জম্মু-কশ্মীর পুনর্গঠন বিল অনুসারে  জম্মু-কশ্মীর রাজ্য ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরী হবে--- একটি জম্মু-কশ্মীর, যেখানে বিধানসভা থাকবে আর দ্বিতীয়টি লাদাখ যেখানে  বিধানসভা থাকবে না৷ মূলতঃ ৩৭০ অনুচ্ছেদটি অস্থায়ী ও এই ধারার ৩ নং উপধারা অনুযায়ী যেকোনো সময় এই অনুচ্ছেদ আর কার্যকর থাকছে না  বলে ঘোষণা করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে অর্পণ করা হয়েছে৷ ৩৭০ ধারার অধিকার বলেই ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির এক নির্দেশিকায়  সংবিধানের ৩৫এ অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছিল৷ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা পেতেন জম্মু-কশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা ও এই স্থায়ী বাসিন্দা কে হবেন তা স্থির করতো জম্মু-কশ্মীর বিধানসভা৷ স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ কশ্মীরে জমি কিনতে বা ওই রাজ্যে চাকরীর আবেদন করতে পারতেন না ও ভোট দিতে পারতেন না৷ এই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কোনো মহিলা অন্য কোনো রাজ্যের পুরুষকে বিয়ে  করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন ও সেই মহিলার উত্তরসূরীরাও সম্পত্তির অধিকার  বা মালিকানা পেতেন না৷ রাষ্ট্রপতির নোতুন নির্দেশিকার মাধ্যমে ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ায় এই নিয়মগুলি আর থাকবে না৷  ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা , বিদেশ, অর্থ ও যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জম্মু-কশ্মীরে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করতে পারত না৷ জম্মু-কশ্মীরের আলাদা সংবিধান ও ভিন্ন জাতীয় পতাকা ব্যবহৃত হত৷ ৩৭০ ধারা রদ করার ফলে জম্মু-কশ্মীরসহ সমগ্র ভারতবর্ষে একই সংবিধান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম হবে৷ আর জম্মু-কশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতেই থাকবে৷ এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি রাজ্যসভার পর  লোকসভাতেও পাশ হয়েছে ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের ফলে সম্পন্ন হয়েছে৷

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর  কশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি  ও সংবিধানে ৩৭০ ধারার মাধ্যমে ‘ঘরের ভিতরে আরেকটি ঘর’ হিসাবে মশারির মতো স্বাধীনরাষ্ট্র ভারতবর্ষের মধ্যেও আরেকটি দেশ হিসেবে  কশ্মীরের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকৃত  হয়েছিল৷ যার ছিল পৃথক সংবিধান ,  পতাকা ও প্রথম দিকে পৃথক প্রধানমন্ত্রী--- পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী পদটি  লুপ্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ চালু হয়েছে৷ কারণ যা-ই হোক না কেন, এটি একটি বিসদৃশ ব্যাপার৷ সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ উপধারার ফলে কশ্মীরের জনগণকে একটা সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে  আবদ্ধ থাকতে হচ্ছিল৷ ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের  মানুষজনের সঙ্গে কশ্মীরের জনগণের একাত্মতা গড়ে ওঠে নি,  বরং কশ্মীরিদের  ভারতের অবশিষ্টাংশে এক ভিন্ন গোত্রের  মানুষ হিসেবেই  মান্য করা হতো৷  এরফলে কশ্মীরী জনগণ,  বিশেষতঃ দরিদ্র ও মহিলাগণকে  মানসিক, সামাজিক  ও অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হতে হয়েছে৷ কশ্মীরীদের মধ্যে যাঁরা  খুব বেশী সচ্ছল নন,তাঁরা প্রয়োজনে স্থাবর সম্পত্তি সেখানকারই সম্পদশালী মানুষজনের কাছেই বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন৷ কশ্মীরে অন্যরাজ্যের বাসিন্দারা ভূ-সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকারী না হওয়ার দরুণ  সেখানকার বাসিন্দারা বিক্রীত সম্পত্তির প্রতিযোগিতা মূলক উচিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন৷ কশ্মীরী মহিলাগণ বিবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে,  বহির্জগতের মুক্ত বাতাস সেবনের অধিকারী ছিলেন না৷  তাছাড়া সংবিধানের ৩৫এ উপধারার প্রভাবে  তারা অনেক বেশি সংকীর্ণতার জালে ছিলেন বন্দী, ভিনরাজ্যের মানুষকে বিবাহ করার স্বাধীনতা তাঁদের ছিল না৷ ভারতীয়যুক্তরাষ্ট্রের্ অন্তর্ভুক্ত থেকেও সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের মতো একই আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা কশ্মীরের জনগণ ভোগ করতে  পারতেন না--- ফলে, সামগ্রিক উন্নয়নের সুফলও সেখানে ঠিক মতো পৌঁছতে পারেনি৷ উপর্যুক্ত কারণগুলির জন্যে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও  ৩৫এ উপধারা রদ হওয়ায় কশ্মীরীদের সার্বিকভাবে সুবিধা হবে বলেই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস৷

মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রাউট (PROUT) বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের নীতি অনুযায়ী একটি দেশের শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক আইনকানুন একটিমাত্র সংবিধান মেনেই চলা আবশ্যক ৷ সেই কারণে সংবিধানে ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ উপধারাসহ  যে সমস্ত ধারা উপধারা গুলি মানুষের মানবিক মৌলনীতি ও মৌলিক অধিকারগুলিকে বিঘ্নিত করে  সেই সব  অযৌক্তিক অমানবিক ধারা গুলি অনতিবিলম্বে  বাতিল হওয়া জরুরী৷ প্রাউটতত্ত্বের  সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমাধান হিসেবেজম্মুকশ্মীর ও সন্নিহিত সমপরিবেশ গত অঞ্চলগুলি নিয়ে ক-জ-হি-ল (KAJAHIL) অর্থাৎ  কশ্মীর, জম্মু, হিমাচলপ্রদেশ ও লাদাখ মিলে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা প্রয়োজন৷ এই অঞ্চলে ছয়টি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যযুক্ত জনগোষ্ঠী বা সমাজের মানুষ বসবাস করেন--- সেগুলি হল কশ্মীরি সমাজ, ডোগরি সমাজ (জম্মু), লাদাখী সমাজ, কিন্নৌরী সমাজ, সিরমৌরী সমাজ ও  পাহাড়ী সমাজ৷ একই ধরণের জল হাওয়া, পরিবেশ ও ভূ-বৈচিত্র্যের মধ্যে  বসবাসকারী এই ছয়টি সমাজের মানুষেরা ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলে ওই অঞ্চলের সমস্ত বৈষম্য দুর হয়ে এক সুন্দর শোষণ হীন সমাজ ব্যবস্থা রচিত হবে৷

গত আগষ্ট মাসে একটি সরকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে যে  ভারতীয় রিজার্ভব্যাঙ্কের ভান্ডারে সঞ্চিত অর্থ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা  কেন্দ্রসরকারকে দেওয়া হবে দেশের উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের জন্যে৷  এছাড়াও আরেকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, দেশের দশটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে চারটি  ব্যাঙ্কে পরিণত করা হবে৷ অবশ্য ইতোপূর্বে স্টেটব্যাঙ্কের সঙ্গে স্টেটব্যাঙ্ক গ্রুপের সব ব্যাঙ্কগুলি  ও ভারতীয় মহিলা ব্যাঙ্কের  সংযুক্তি আর ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, দেনা ব্যাঙ্ক ও বিজয়াব্যাঙ্কের সংযুক্তি  সম্পন্ন হয়েছে৷ কেন্দ্রীয়  অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই সংস্কারমূলক ব্যাঙ্ক সংযুক্তি করণের মাধ্যমে দেশের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যাবে  ও ২০২৪ সালে  প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত  ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির  লক্ষ্যপূরণে সদর্থক  পদক্ষেপ করা যাবে৷ এরফলে ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের( এন.পি.এ) বোঝা কমাতে সরকার যে পুঁজির যোগান দিচ্ছে তার সদ্ব্যবহার হবে৷ বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে অনাদায়ী ঋণ প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা৷ এ বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ হল কি করে?  সাধারণ মানুষের ছোট খাটো ব্যবসার জন্যে ২/৫ লক্ষ টাকা ঋণ পেতে জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যায়৷ কিস্তি বা ঋণ বাকী থাকলে জেল, জরিমানা, সমাজে দুর্নামের  ভয় থাকে, যখন তখন ব্যাঙ্কের লোক দরজার কড়া নাড়ে৷ সুতরাং ঘটিবাটি বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে ঋণশোধ দিতে হয়৷ অথচ বড় বড় কর্র্পেরেট হাউসের, শিল্পপতিদের, বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ঘরে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ পড়ে থাকে৷ ঋণদানের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব উচ্চ পদস্থ সরকারী পদাধিকারীদের মৌখিক নির্দেশে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যাঙ্ককর্মীদের যোগ সাজসে নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে শত শত কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়৷  প্রদত্ত নথিপত্রের গোলমাল, জাল সংশাপত্র ইত্যাদির যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই তাড়া হুড়ো করে ঋণের টাকা মঞ্জুর হয়ে যায়৷ পরবর্তীকালে স্বাভাবিকভাবে এইসব নথিপত্র আদালতে গ্রাহ্য হয় না৷ আর বেচারা নীচুতলার ব্যাঙ্ককর্মী বা  আধিকারিকরা বলির পাঁঠা হন, কিন্তু আসল নাটের গুরুরা অধরাই থেকে যায়৷ বড় বড় কর্র্পেরেট হাউসের অনাদায়ী ঋণ আদায়ের চেষ্টা হলে  উপরমহলের হস্তক্ষেপের মাঝপথেই সে প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া হয়৷ যেসব ক্ষেত্রে কোনো ভাবেই ধামা চাপা দেওয়া সম্ভব হয় না৷ সেইসব শাঁসালো ঋণ খেলাপীরা ব্যাঙ্ককে প্রতারণা করে নানা ফন্দি ফিকিরের মাধ্যমে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে দেশের বাইরে পগাড় পার হয়ে যায়৷ যেমন গেছে ললিত মোদি, বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সিরা৷ তাদের ধরে আনতে আইন আদালতে কোটি কোটি টাকা (জনগণের প্রদত্তকরের টাকা) খরচ হয় ---যা দেশের মানুষের কোনো কল্যাণসাধন করে না৷  কোনো অজ্ঞাত কারণে ব্যাঙ্ককর্মচারী -আধিকারিকদের ইউনিয়নগুলির দাবীমত সমস্ত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের কালো তালিকাভুক্ত করে  নামপ্রকাশ করার দীর্ঘদিনের দাবীও মানা হয়নি৷ অবশ্য এই সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারপক্ষ বা বিরোধী পক্ষ কেউই খুব একটা আগ্রহী নয়৷ কারণ তাদের ভোট বৈতরণী পার হওয়ার অর্থের জোগানদার তো এরাই৷ সুতরাং ব্যাঙ্কগুলিতে যে পুঁজির জোগান দেওয়া হবে তা প্রকৃতপক্ষে পরোক্ষভাবে এইসব কর্র্পেরেট হাউসের কল্যাণেই লাগবে৷

বর্তমানে দেশের শিল্পজগতে বিশেষতঃ গাড়ীশিল্পে মন্দার ঢেউ লেগেছে৷ অবশ্য সামগ্রিক বৃদ্ধির হারও  দীর্ঘদিন পর পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে৷ যা  অর্থব্যবস্থার ওপর বিরুপ প্রভাবেরই  বহিঃপ্রকাশ৷ চলতি বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.০৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা ইতোমধ্যেই ৫.৪৭ লক্ষ কোটিতে পৌঁচেছে (প্রায় ৭৮ শতাংশ)৷  দেশের বেকারত্বের হারও  পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, নোতুন কর্মসংস্থান দুর-অস্ত, বরং গাড়ি শিল্পে মন্দার কারণে গাড়ি বিক্রি অনেক কমে যাওয়ায় ওই শিল্পের  লক্ষাধিক মানুষ বেকার বা আংশিক বেকারে পরিণত হয়েছে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি যেমন  বি.এস.এন.এল, ও এন.জি.সি, বিমান পরিবহন সংস্থা ইত্যাদি ধুঁকছে৷  সরকারী সংস্থাগুলিকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার প্রবণতা চলেছে ধারাবাহিকভাবে৷ এমতাবস্থায় বেহাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে  রিজার্ভব্যাঙ্কের তহবিল ভেঙে ১লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রের কোষাগারে নেওয়া হয়েছে৷ এরফলে আপদকালীন সময়ে  রিজার্ভব্যাঙ্কের প্রতিরোধ ব্যবস্থার শক্তি হ্রাস পেল৷  কয়েকবছর আগে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছিল৷  মহাশক্তিধর উন্নত দেশগুলিও  এই মন্দার ধাক্কা সামলাতে নাজেহাল অবস্থায় পড়েছিল৷ অথচ ভারতবর্ষের  রিজার্ভব্যাঙ্ক দক্ষতার সঙ্গে তার সঞ্চিত ভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে  সক্ষম হয়েছিল৷ তাই  রিজার্ভব্যাঙ্কের তহবিল হ্রাসের  কোনো খেসারত দিতে হবে কিনা  তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে৷ তবে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞগণ সিঁদুরে মেঘই দেখছেন৷ আর জনগণের প্রদত্ত ধনরাশি বিভিন্নভাবে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী ও পুঁজিবাদীদের হাতে ঘুরপথে চলে যাওয়ায় সাধারণ জনগণের প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে না৷  এটিই  সর্বাপেক্ষা দুশ্চিন্তা ও বেদনার বিষয়৷ এই সমস্ত অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাহীনতার জন্যে দায়ী বর্তমান বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদী কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির কুফল ও একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত  মানুষের দুরন্ত লোভ৷  এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রাউটের নীতি অনুযায়ী বিকেন্দ্রিত গণর্থনীতি আর এই অর্থনীতি পরিচালিত হতে হবে নীতিবাদী ও আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত  সদ্বিপ্রদের দ্বারা যাতে সমাজের দুর্নীতি ও শোষণের বীজকে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলা সম্ভব হয়৷

এই আগষ্টেরই শেষ দিন অর্থাৎ ৩১শে আগষ্ট ২০১৯ তারিখে অসমের চূড়ান্ত এন.আর.সি তালিকা  (নাগরিকপঞ্জী) প্রকাশিত হয়েছে ও এই তালিকা থেকে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম বাদ পড়েছে৷ এই এন.আর.সি তালিকাভুক্ত না হওয়া মানুষেরা ১২০ দিনের মধ্যে  ফরেনার্স ট্রাইবুন্যালে আবেদন করতে পারবে৷ সেখানেও সুরাহা না পেলে তারা হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে আবেদন জানাতে পারবে৷ এই পদ্ধতি অনেকটাই দীর্ঘ ও ব্যয়সংকুল যা  অনেক মানুষের সামর্থ্যের বাইরে ৷ এন.আর.সির বাইরে  থাকা লোকেদের বৃহদংশ হচ্ছেন বাংলা ভাষাভাষী৷ শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকসূত্ জানানো  হয়েছে  ২০২০ সালে এন.পি.আর বা  ‘ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিষ্টার’ চূড়ান্ত করা হবে--- অর্থাৎ এন.পি.আর-এর মাধ্যমে সমগ্র দেশেই এন.আর.সির ছায়া নেমে আসবে৷ এন.আর.সি বা  এন.পি.আর-এর প্রভাবে  সারাদেশের মানুষের কাছে  কোন দুর্র্ভেগের বার্তা ধেয়ে আসবে৷ তা ভেবে দেশবাসী বিশেষতঃ বাঙালী জনগোষ্ঠী অত্যন্ত আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত৷ কারণ দেশভাগ বা অসমে এন.আর.সির প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালী৷ অথচ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সকলের আগে ছিল বাঙালী,বুকের রক্ত ঝরিয়েছে, নিঃশেষে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে  সকলের বেশি বাঙালী৷ আর এই দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হওয়া বাঙালীদের  সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েনি তৎকালীন  কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের                             অপরিণামদর্শিতার কারণে৷ আজ অসমে বাঙালীরা নিজভূমে পরবাসী ৷ অসমে এন.আর.সির দৌলতে ১৯ লক্ষ মানুষের ভাগ্য অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত৷  বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে  এন.আর.সি.কে নিয়ে স্ববিরোধী  কথাবার্র্তয় ব্যস্ত৷ কেউ কেউ ধর্মমত ভিত্তিক বা জাতি-বর্ণভিত্তিক  বিভাজনেরও চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এইসব সমস্যার সমাধান মানবিক সংবেদনশীলতার  মাধ্যমেই হওয়া উচিত৷ কোনো বিভেদাত্মক মনোভাবকে প্রশ্রয় না দিয়ে সামগ্রিকভাবে মানবিক মৌলনীতি অনুযায়ী সহানুভূতি ও সহমর্মিতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান অবশ্যই করতে হবে---এটাই সময়ের দাবী৷ প্রাউটের নীতি ও নব্যমানবতাবাদের আদর্শ অনুসারে প্রতিটি মানুষ পরমপিতার সন্তান সন্ততি ও বিশ্বের সমস্ত সম্পদের ও স্থানের সমান দাবিদার৷  সুতরাং প্রতিটি মানুষ , জন্ম তার যেখানেই হোক না কেন, পৃথিবীর যেকোনো স্থানে  বসবাস করবার অধিকারী ও তিনি যদি সেই স্থানের  সুখ, দুঃখ, অর্থনীতি, সংস্কৃতির সঙ্গে  একাত্ম হয়ে যান  আর অর্থের কোনো বহিস্রোত না ঘটান তাহলে তিনিও সেই স্থানের স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে গণ্য হবেন৷  আর এই উদ্দেশ্যে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সংঘবদ্ধ হয়ে,  প্রয়োজনে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে ও মানুষের মানবিক অধিকারকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে--- নচেৎ  অনাগত ভবিষৎ  ও আগামী প্রজন্ম আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবে না, ভবিষ্যতের মানবেতিহাসও একদিন আমাদের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে৷