আমার এক পরিচিত বয়স্ক মানুষ তাঁর আধার কার্ডের সঙ্গে তাঁর মোবাইলকে সংযুক্ত করার জন্যে ভোডাফোনের মোবাইল অফিসে যান৷
ওই সজ্জন বয়স্ক মানুষটি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল৷ তার ওপর বয়সের জন্যে তাঁর হাতও সবসময় কাঁপতে থাকে৷ তাই মোবাইল অফিসের অফিসার অনেক চেষ্টা করলেও তাঁর মেসিনে ওই ভদ্রলোকের আঙ্গুলের ছাপই ধরতে পারলেন না৷ বললেন, শীতটা কাটুক, তারপর দেখা যাবে৷ বয়স্ক মানুষ, হাত কাঁপাটাই স্বাভাবিক৷ তারজন্যে যদি তাঁর হাতের আঙ্গুলের প্রিন্ট মেসিন না নিতে পারে, তার জন্যে তো তিনি দায়ী নন৷ তাহলে কি তিনি আধার কার্ডের অভাবে সরকারী বিভিন্ন পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকবেন?
সংযোগবশতঃ আজই একটি খবর এল উত্তরাখণ্ডে আধার কার্ড না থাকায় প্রতিবন্ধী, বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা মিলে প্রায় ৫৩ হাজার মানুষ এক বছরের বেশি পেনসন পাচ্ছেন না৷
সংবাদে প্রকাশ দেরাদুন থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরে এক গ্রামের বয়স্কা মহিলা (৬২) নীরা দেবী সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন, তার ছেলে রাজকুমার শারীরিক ভাবে ৬২ শতাংশ প্রতিবন্ধী, সে হাত পা নাড়তে পারে না, শয্যায় শোয়ানো রয়েছে৷ ছেলের পেনসনের টাকাই তাদের বাঁচার প্রধান ভরসা৷ ছেলের মাসে ১০০০ টাকা পেনসন পাওয়ার কথা৷ কিন্তু গত বছর অক্টোবর থেকে পেনসন বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি ছেলেকে নিয়ে পেনসন অফিসে বহুবার গিয়েছেন৷ কিন্তু ছেলের হাতে আঙ্গুলের স্নায়ুমন্ডল স্বাভাবিক না হওয়ার অফিসের মেসিনে তার হাতের আঙ্গুলের ছাপ ধরতে পারছে না চোখের আইরিস স্ক্যানও করা যাচ্ছে না৷ এই কারণে গত বছর অক্টোবর থেকে তার পেনসন বন্ধ৷
এরপর অনুসন্ধান করে জানা গেল উত্তরাখন্ডের এই একই কারণে মোট ৫৩ হাজার প্রতিবন্ধী, বয়স্ক পুরুষ ও বয়স্ক মহিলার পেনসন বন্ধ হয়ে গেছে৷
গণতন্ত্রে বলা হয়, সরকার জনগণের সরকার৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল ও দরিদ্র জনসাধারণের কথা ভাবেই না৷ তাদের যত ভাবনা বড় বড় পুঁজিপতি শ্রেণীকে নিয়ে৷
সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় সরকার এফ.আর.ডি ই (ফিন্যানসিয়্যাল রিজলিউশন এ্যাণ্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স) বিল সংসদে পাশ করবার উদ্যোগ নিচ্ছেন৷
গত আগষ্টে ওটিকে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে৷ আগামী লোকসভা অধিবেশনে ওই বিলটি পাশ করার কথা আছে৷ এই বিলটিও পুরোপুরি পুঁজিপতি স্বার্থে ও গরীব জনসাধরণের স্বার্থ হানিকর৷ বিশেষ করে ওই বিলটির ৫২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে সংকটাপন্ন কোনো ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে আমানতকারীদের প্রতি তাদের যে দায় তা মুকুব করা হবে৷ অর্থাৎ আমানতকারীর আমানত ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না৷ ওই অর্থ নিয়ে রুগ্ণ ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি আমানতকারীদের টাকা প্রয়োজনমত ফেরৎ না দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী বিমাতে পরিণত করার অধিকার লাভ করবে৷
দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের জীবনের কষ্টার্জিত আয় সংসার প্রতিষ্ঠানের জন্যে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখেন৷ ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্ত সুদ তাদের আয়ের অঙ্গ৷ সম্প্রতি ব্যাঙ্কের সুদের হার ক্রমাগত হ্রাস করানো হচ্ছে, অথচ জিনিপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷
ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকাই গরীব মানুষের একমাত্র সম্বল৷ হঠাৎ অসুখ-বিসুখ বা অন্য কোনও জরুরী প্রয়োজন এলে ওই ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকাই একমাত্র ভরসা৷ ঠিক সে সময় সে যদি টাকা না পায় তাহলে যে সে প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়বে তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই৷ এই অবস্থায় ব্যাঙ্ককে তার চাহিদা মেটাতেই হবে, নাহলে ওই ব্যাঙ্কে সে টাকা গচ্ছিত রাখবেই বা কেন? এক্ষেত্রে যদি আমানতকারী প্রয়োজনমত টাকা না পায় তাহলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সরকারকে তার পাশে এসে দাঁড়াতেই হবে৷ কিন্তু নতুন আইনে সরকার বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছে, যা পুরোপুরি অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক৷
তারপরে “আধারের” আঘাতের জন্যে রান্নার গ্যাসের দাম সহ নানান সরকারী পরিষেবা গরীব মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে৷
ইতোপূর্বে বিমুদ্রাকরণ ও জি.এস. টির জন্যে গরীব মানুষের, ক্ষুদ্র শিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাভিঃশ্বাস উঠেছে৷
সরকার গরীব জনসাধারণের যতদূর সম্ভব পকেট কেটে সরকারী কোষাগার বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর৷ এদিকে বড় বড় শিল্পপতিদের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক যে সরকারের চাপে বিশাল অংকের ঋণ দিয়ে চলেছে, তার একটা বৃহৎ অংশ ওই পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্কে জমা দেয়নি৷ সরকার সেক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের ঋণ মুকুব করে দিচ্ছেন৷ মোদির আমলে গত সাড়ে তিন বছরে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমান দ্বিগুণ বেড়ে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি হয়েছে৷ সরকার পুঁজিপতিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ওই টাকা যাতে শোধ হয় ও ব্যাঙ্কগুলিকে রক্ষা করা যায় তার জন্যে কিন্তু কোনও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না৷ যত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে দুর্বল জনসাধারণের ওপর৷
তাছাড়া, পুঁজিপতিরা যে বিপুল অংকের ব্যাঙ্ক ঋণ না শোধ করে বহাল তবিয়তে রয়েছে, তার একটা বড় কারণ, ওই সব পুঁজিপতিরা শাসক দলকে ক্ষমতায় আসতে বিপুল পরিমান টাকা ডোনেশন দিয়েছে৷ তাই সরকার ও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছে না৷
সরকার ও পুঁজিপতিগোষ্ঠীর মধ্যে এই অশুভ আতাঁতের কারণেই মুখ্যতঃ গরীব জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷
প্রচলিত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের এইটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করলে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের এই সমস্যা থেকে রেহাই পাবার আশা দুরাশা মাত্র৷
- Log in to post comments