তোমরা শুণেছ অথবা ছোটবেলায় তোমাদের জোর করে শোণানো হয়েছে বা ভয় দেখানোর জন্যে বলা হয়েছে যে ভূত বলে একটা অদ্ভুত জিনিস আছে৷ ছোটবেলায় যখন পিসিমার কোলে শুয়ে বা বসে হাত–পা ছুঁড়ে বলতে–দুধ খাব না, তখন পিসিমা একটা ভয়ের গল্প শোণাতেন৷ তখন ভয়ে হাত–পা নাড়া বন্ধ করে দিতে, পিসিমা হঠাৎ এক ঝিনুক দুধ মুখে ঢেলে দিতেন৷ সেই থেকে তোমার মনে শুরু হয়েছিল একটা ভূতের ভয়......একটা অজানা আতঙ্ক৷ এই ভূতেরা নাকি আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়......গা ভাসিয়ে দেয় হাওয়ার গতিধারায়৷ রাতবিরেতে.... অন্ধকারে.....আলো–আঁধারিতে কাউকে একলা পেলে তাকে হাতছানি দেয়...দিন–দুপুরে বড় বাড়ীতে একলা ঘরে ভূতের কাল্পনিক পদধ্বনিতে গা ছমছম করে....আর সব ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়....কাণ হয়ে থাকে খাড়া....সে আসছে হয়তো বা সে আসে....মনে হয় দিনের বেলা ভুল করতুম তর্ক করে এই বলে যে ভূত নেই কিন্তু বর্তমানে যে পরিবেশে রয়েছি সেই পরিবেশে কেবল আমি রয়েছি আর রয়েছে ভূত....একজন ভয় পাচ্ছি....আরেকজন ভয় পাওয়াচ্ছে৷ এই যে ভূতেরা এরা আলো দেখলে পালিয়ে যায়৷ এক সঙ্গে অনেক মানুষের জটলা দেখলে গা ঢাকা দেয়৷ সমাজে এরা কখনো কখনো ভয়ের বস্তু হিসেবে চিহ্ণিত বলে আদর–কদর পায় না৷ মানুষ যখন ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় থাকে না তখন সুযোগ মত ভূতের ওপর এক হাত নেয় কিন্তু সে একলা থাকলে রাতের অন্ধকারে তাদের অপদেবতা বলে সম্মান জানায়৷ যেমন চোরেরা পুলিশ অফিসারের কাছে পৌঁছে গেলে ভয়ে ভক্তিতে সালাম জানায় কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলে ডাইনে বাঁয়ে যে গলিটাই দেখতে পায় সেই গলিটায় ঢুকে পড়ে৷ ভূতেদের কিন্তু ব্যথা এখানেই৷ তারা সামাজিক স্বীকৃতি পায় না৷
হ্যাঁ, ওদের কথা তো জানই৷ এমনিতে অনেকেই বলে থাকে দেবতাদের সংখ্যা নাকি তেত্রিশ কোটি৷ যখন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা তেত্রিশ কোটির চেয়ে কম ছিল, দেবতা ছিলেন ৩৩ কোটি অর্থাৎ মাথাপিছু গড়ে একের বেশী দেবতা৷ সুতরাং মানুষকে ট্রাম–বাসে চলবার সময় একবার বাঁ দিকে, একবার ডানদিকে কপাল ঠুকতে হত৷ আবার সেই মানুষই যখন শাস্ত্রচর্চা করত ওদের বলত সব লৌকিক দেবতা৷ কারও সম্বন্ধে বলত ওরা পৌরাণিক দেবতা, কারো সম্বন্ধে বলত ওরা আসলে জৈন দেবতা৷ শরীরের অনেক অঙ্গকে কাটাকুটি করে করে দেওয়া হয়েছে খাঁদুরাণী বা খাঁদুবিবি৷ কারো সম্বন্ধে বলা হয় বিবর্ত্তিত বেনামা বৌদ্ধদেবতা৷ কোনো পেত্নী বা পেঁচো ভূতে ধরলেই তখন এদের শরণাপন্ন হয়৷ এদের বামুন–পুরুত নেই৷ জাত–বাঙ্গালী পুরুত এদের পুজো করে থাকেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুজোর বাড়ীর মেয়েছেলেরাই একটু আধটু উপবাস অধিবাস করে বাংলা পাঁচালী পড়ে পাঁচালীর পুঁথিটি কপালে তিনবার ঠেকিয়ে পুজো শেষ করে দেয়৷ তারপর প্রসাদ বিতরণ করা হয় বাতাসা, কলা, কখনো কখনো জলখাবারের সময় গরম ভাজা জিলিপি৷ এই যে দেবতারা এদের সংখ্যা যে কত তা আজ বলা যায় না৷ কারণ প্রতি দশম বর্ষে মানুষের আদমসুমারী হয় কিন্তু এই ভূতেদের বা দেবতাদের আদমসুমারী হয় কিনা বলতে পারছি না৷ কোন্ গণক বা এনিউমারেটর এই কাজ করেন তাও ঠিক জানা নেই৷ এই ধরনের দেবী–দেবতাকে অনেক সময় মানুষ সুস্থ মনে মানে না, কিন্তু বিপদে আপদে মানে৷ কোন দেবী সম্বন্ধে বলা হয়–অমুক রোগ বলতে নেই....বলতে হয় মায়ের দয়া হয়েছে....বিহারে বলা হয় ‘‘মাতা হোল ছে’’ (মাতা হয়েছে)৷ কলেরা হলে ফাসী–উর্দু–হিন্দোস্তানী বলে ‘হ্যায়জা’, সংস্কৃতে ‘বিসূচিকা’, বাংলায় ‘ওলাওঠা’৷ ওলাওঠা হলে ওলাইচণ্ডীর প্রতি ভক্তি বাড়ে৷ অন্য সময় বলা হয় ‘ওলাইচণ্ডী’ লৌকিক দেবী৷ গ্রামাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সাপের উপদ্রব একটু বাড়ে ভরা বর্ষায় ও ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত৷ তাই বিষহরি বা মনসার এই সময়টিতে প্রভাব হয় বেশী এতে জাতপাতের বিচার নেই...হিন্দু–মুসলমানের ভেদ নেই৷ ওলাবিবির মত মনসাও সবাইকার দেবী৷ মনসার ভাসান বা পাঁচালীতে ছোঁয়াছুঁয়ি নেই৷ একই গ্রামে অর্জুন মণ্ডল নামে তিন বন্ধু–একজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন খ্রীষ্টান–মনসার ভাসানে তিন জনই গান গায়৷ এই সকল দেবীদেবতারা ভক্তি–শ্রদ্ধা পায় না৷ সেই জন্যে প্রাচীনকালে পুরাণকারেরা নানানভাবে ভয়ের সূচিকাভরণ করে (injection) এই সকল দেবতাদের প্রতি ভক্তি জাগাবার চেষ্টা করেছেন–তৈরী করেছেন রকমারি গল্প যা শোণানোর সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ভয়ে–ভক্তিতে স্বেদ–ঘর্ম দেখা দেয়৷ এই দেবতাদের চরিত্র এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেন তারা সব সময় রেগে টং হয়ে রয়েছে....শাপ দেবার জন্যে জিব উঁচিয়ে রয়েছে৷ তবু এই সকল দেবদেবীরা সাময়িকভাবে মর্যাদা পান–অন্য সময়ে নয়৷ কায়স্থদের ঘোষ–বোস–মিত্র–গুহ বিয়ে বাড়ীর ছাদনা তলায় একরাত্রির শাহানশাহ হয়ে যান, তারপরে লোকে তাদের কথা ভুলে যায়৷ এই যে সব দেবী–দেবতা যারা শাস্ত্রমতে স্বীকৃত দেব–দেবী তো নয়ই....কোথাও কোথাও শাস্ত্রে অস্বীকৃত–এদেরও অনেক সময় লোকে ভয়ে উপদেবতা বলে থাকে৷ ভূতকে সে ভয়ে বলে থাকে অপদেবতা৷ এই সকল অপদেবতা ও উপদেবতারা (উপ মানে কাছাকাছি) পৌরাণিক গল্পমতে একবার তাদের উপেক্ষার মর্মজ্বালা সহ্য করতে না পেরে শিবের শরণাগত হয়েছিল৷ শিব তাদের শরণ দিয়েছিলেন এই শর্তে যে তারা সৎপথে চলবে... ভক্তিরসে জারিত হয়ে থাকবে....পারস্পরিক মারামারি, কাড়াকাড়ি, হানাহানি করবে না...নিরীহের মুণ্ডুপাত করে রক্ত মোক্ষণ করবে না৷ এই উপদেবতা ও অপদেবতারা শিবকে নাকি বচন দিয়েছিল তারা অহেতুকভাবে কাউকে অকালে যমালয়ে পাঠাবে না৷ তাই এরা পেল শিবের আশ্রয়৷ শিবের আশ্রয় পাওয়া এইসব উপদেবতা–পদেবতা নাম দেওয়া হল ‘গণ’৷ ঠিক হল, শিব যেখানে যাবেন শিবের আগে বা পরে, বিশেষ করে সেটা যদি হয় সোমবার অথবা বিশেষ করে হয় চৈত্র মাস তাহলে সেই অপদেবতা বা উপদেবতারা শিবের আগে বা পরে চলতে থাকবে৷ এই গণেরা যাতে কোন অবাঞ্ছিত কাজ না করে বসে তাই এদের আচরণের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার তা শিব অনুভব করেছিলেন৷ সেই আশায় শিব কার্ত্তিককে বলেছিলেন–‘‘কার্ত্তিক, তুমি এদের দায়িত্ব নাও৷’’
কার্ত্তিক বললেন–‘‘পিতৃদেব আপনি যা আদেশ দেবেন আমি তা পালন করব৷ কিন্তু মুসকিল হচ্ছে দু’জায়গায়৷ প্রথমতঃ আপনি যখন তাণ্ডব নাচেন তখন আপনার জটা থেকে দলে দলে সাপেরা মাটিতে পড়তে থাকে৷ আপনি তো জানেন সাপ ময়ূরের প্রিয় খাদ্য৷ ওই সময় যদি ময়ূরকে অন্য কাজে ব্যস্ত না রাখা হয় তাহলে সর্পকুল ধ্বংস হওয়া সুনিশ্চিত৷ কবি বিদ্যাপতিও পার্বতীর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ঃ
‘‘কার্ত্তিক পোষল ময়ূর সেহ নাগে খাবত হে৷’’
পিতৃদেব, আরও একটি কথা হচ্ছে এই যে ময়ূরটি আমার অনেকদিন ধরেই বাত রোগে জরাজীর্ণ রয়েছে .......চৌরঙ্গী বাত৷ মাথার ঝুমকো থেকে পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখ পর্যন্ত বাতগ্রস্ত৷ ডাক্তার বলছে, এর সর্বাঙ্গে ব্যায়াম দরকার৷ তাই ময়ূরের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমি ময়ূরকে আমার সঙ্গে বিশ্বপরিক্রমায় ব্যস্ত রাখতে চাই৷ এই অবস্থায় আমাকে যদি গণেদের তদারকিতে ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে৷ তবু আপনি যখন বলছেন, করব৷ তবে আপনি একবার দাদা গণেশকে শুধিয়ে দেখতে পারেন৷
শিব ওই কথা গণেশকেও বললেন৷
গণেশ বললেন–‘‘বাবা, তুমি যখন বলছ তখন আমি নিশ্চয় করব৷ এক্ষুণি এই মুহূর্ত থেকেই করব৷’’
শিব আশ্বস্ত হলেন৷
গণেশের ওপর তদারকি বা খবরদারির দায়িত্ব দেবার ফলে গণেশকে নাম দেওয়া হল গণেশ (গণ ঈশ)–গণেদের নিয়ন্ত্রক... (controller of Ganas.)
তাহলে তোমরা ‘গণ’ শব্দের এই মানেটাও বুঝে গেলে তো
(শব্দ চয়নিকা, ১৬/১২১)