কৌণিক তারতম্যবশতঃ নিজের ক্রান্তিকক্ষে বা ক্রান্তিপথে চলতে চলতে সকল জ্যোতিষ্কই সাময়িকভাবে তার গতি, দ্রুতি ও নির্দিষ্ট পথ কিছুটা পরিবর্তিত করে নেয়৷ জ্যোতিষ্কের ক্ষেত্রে এই অবস্থাকে বক্রীদশা বলা হয়৷ জ্যোতিরঙ্কশাস্ত্রে আর কিছুটা এগোলেই আমরা বিশ্বের শুধু জ্যোতিষ্কেরই নয়, সমস্ত জড় (inanimate objects) ও চেতনসত্তারও (animate objects) চলার পথের বৈশিষ্ট্যগুলি অঙ্কের কাঠামোর মধ্যে এনে ফেলতে পারব৷ এই বক্রীদশার বৈশিষ্ট্য, ও ধরণধারণ ও এর গাণিতিক ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ক্রান্তিজ্যা’৷ কেউ কেউ ভাবেন যে পথে চললে জ্যোতিষ্ক্ রাহুগ্রস্ত হয়ে যায় তাকে বলা হয় ক্রান্তিজ্যা৷ না, তা নয়, ওতে অর্থের অনর্থ করা হয়৷
গ্রহের বক্রীদশা চলার পথে এক স্বাভাবিক পরিণতি৷ পারস্পরিক বহিরঙ্গিক ও আভ্যন্তরীণ বিবর্ত্তনের ফলে এটা হয়ে থাকে৷ জ্যোতির্গাণিতিক গণনায় মানুষ আরও একটু এগিয়ে গেলে সমস্ত গ্রহের গতির ধরনধারণ আয়ত্তে এনে ফেলবে৷ এর কিছুটা আবিষ্কার–সাপেক্ষ, কিছুটা উদ্ভাবন–সাপেক্ষ৷ এই বক্রীদশা জ্যোতির্বিজ্ঞানের কতকটা মূলনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তো বটেই, এতে জ্যোতিষশাস্ত্রের (Astrology) ফলাফলেরও হেরফের ঘটিয়ে দেয়৷ তাই স্বাভাবিকী জ্যোতিষিক গণনার যা ফলশ্রুতি বক্রীদশায় তা ওলটপালট হবার সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে থেকে যায়৷ তাই একে একেবারে উপেক্ষা করা চলে না৷ চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিশেষ করে ঔষধ–নির্বাচনের মত জ্যোতিষ বিজ্ঞানও একটি পরীক্ষামূলক শাস্ত্র (Experimental science)৷ তাই বক্রীদশার ব্যাপারে যথেষ্ট পরীক্ষা না করে ফলাফল সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া বা নির্ণয় করা সঙ্গত নয়৷ এসম্বন্ধে একটি পুরনো গল্প মনে পড়ল৷
তিনি ছিলেন একজন নামজাদা জ্যোতিষী–বর্দ্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর কাছাকাছি কোন গ্রামে৷ নির্ভুল গণনার জন্যে তাঁর খ্যাতি ছিল৷ তবে জাগতিক ব্যাপারে বেশী পণ্ডিতের যা হয়ে থাকে তাঁরও তেমনটি হয়েছিল৷ ঘরসংসারের কোনকিছুই ঠিক বুঝতেন না৷ একবার নাকি হাটতলায় কোন একজন উদ্ভিদ বিক্রেতা তাঁকে কাঁচাগোল্লার গাছ বেচে মোটা টাকা হাতড়ে নিয়েছিল৷ সরলবিশ্বাসী ওই জ্যোতিষী ঠাকুর অর্থাৎ আমাদের বুধরাজ শর্মা মেনেই নিয়েছিলেন যে কাঁচাগোল্লার গাছ হয়৷
পৃথিবীর সব দেশেই বেশী পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে, কারণ তাঁরা তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিদ্যা নিয়ে এতই মেতে থাকেন বা ব্যস্ত থাকেন যে পৃথিবীর অনেক বাস্তব ব্যাপারকে তাঁরা অবহেলা করতে থাকেন ও শেষ পর্যন্ত ওই সকল বিষয়ে তাঁদের বাস্তব জ্ঞান বা ফলিত জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়৷ একবার তাঁর স্ত্রী রান্নার জল আনবার জন্যে ঘাটে গেছলেন৷ যাবার সময় বলে গেছলেন–নাতি (দৌহিত্র) ঘুমোচ্ছে, একটু নজর রেখো৷ সে জেগে উঠলে দোলনাটা একটু দুলিয়ে দিও৷ বুধরাজ শর্মা শুধিয়েছিলেন–আন্দাজ কতক্ষণ দোলাতে হবে? গিন্নী বলেছিলেন–পাঁচ–সাত মিনিট দোলালেই খোকা আবার ঘুমিয়ে পড়বে৷
শর্মা মহাশয় বললেন–‘‘বুঝেছি৷ তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘাটে যাও৷’’
শর্মা মহাশয় তখন এই দৌহিত্রের জন্মকুণ্ডলিনী বিচার করতে বসলেন৷ দেখলেন শিশু দীর্ঘজীবী হবে বিদ্বান–বুদ্ধিমান হবে, আঘাত বা আঘাতজনিত রক্তক্ষরণ বড় একটা হবে না, মৃত্যুও বিষক্রিয়ায় হবে না৷ তিনি প্রথমে ভাবলেন–শিশুর যখন কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন ওদিকে নজর দিয়ে কী করব৷ বরং আমি নিশ্চিন্ত মনে জ্যোতিষচর্চা করি৷ শর্মা মহাশয় ভাবলেন–গৃহিণী ডিউটি দিয়ে গেছে, ডিউটি যদি ঠিকমত না করি তবে ঘাট থেকে এসে গিন্নী মুখঝামটা দেবে৷ সেটা গৌরবের কথা হবে না৷ তাই আমি এক কাজ করি৷ একবার যাই নিজের কর্ত্তব্যটা আগে আগেই সেরে রাখি৷ পাঁচ–সাত মিনিটের জন্যে দোলনা দোলানো তো৷ আমি মিনিট দশেক দোলনা দুলিয়ে কাজটা আগেই সেরে রাখি৷ যদিও শিশুর ঘুম ভাঙেনি, সে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছিল, তবু শর্মা মহাশয় ঘড়ি ধরে দশ মিনিট দোলনা দুলিয়ে দিলেন৷ অতিরিক্ত জোরে জোরে দোলনা দোলানোর ফলে শিশুর ঘুম ভেঙ্গে গেল৷
এবার শর্মা মহাশয়ের মনে আবার প্রথম কর্ত্তব্যটা জেগে উঠল৷ শিশুর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল৷ আর তাই আমি নজর দি’ বা না দি’ তাতে শিশুর কী ক্ষতি?
শিশু কেঁদে চলেছে৷ শর্মা মহাশয় জ্যোতিষচর্চা করে চলেছেন৷ তিনি ন্যায়দর্শনে পণ্ডিত ছিলেন৷ ভাবলেন ন্যায়দর্শনের মতে আর জৈমিনিক পূর্বমীমাংসা মতে নিজের কর্ত্তব্য করে যেতে হয়৷ তাতে ফলপ্রাপ্তি হয়৷ কর্মফল নিঃশেষ হয়ে যাবার পরে দেবলোক থেকে মর্ত্ত্যলোকে ফিরে আসতে হয়৷ সুতরাং শিশু তার কর্ম করে যাচ্ছে অর্থাৎ কেঁদে যাচ্ছে৷ আর আমিও আমার কর্ম করে যাচ্ছি অর্থাৎ জ্যোতিষচর্চা করে যাচ্ছি৷ শর্মা মহাশয় একমনে জ্যোতিষচর্চা করে যাচ্ছেন৷ ওপর দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন একটা লাল রঙের দড়ি ঝুলছে৷ দড়িটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল যাতে শিশু ওটা দেখে হর্ষোৎফুল্ল হতে পারে৷ হঠাৎ জ্যোতিষী ঠাকুর দেখলেন শিশুর কান্না থেমে গেছে৷ তিনি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন ওই লাল দড়িটি একটি লালরঙের সাপে রূপান্তরিত হয়েছে৷ সাপটি দিয়েছে শিশুকে কামড়ে৷ বিষক্রিয়ায় শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷
শর্মা তো অবাক৷ সে ভাবলে জ্যোতিষী মতে শিশুর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হবে না অথচ তাইই হল৷ এটা কি তবে গ্রহের বক্রীদশার ফলশ্রুতি? নইলে এমন তো হবার নয়৷ তিনি তখন শাস্ত্র ক্ষন্ধ রেখে সাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ সাপ তাঁর বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ জ্যোতিষী ঠাকুর সাপের পিছু পিছু চলতে লাগলেন৷
সাপ এগিয়ে চলেছে৷ জ্যোতিষী ঠাকুরও চলেছেন তার পেছনে পেছনে৷ কয়েক ক্রোশ যাবার পর জ্যোতিষী ঠাকুর দেখলেন কর্ষক পরিবারের একটি পনর–ষোল বছর বয়সের ছেলের পায়ের পেছন দিক থেকে সাপ দিলে এক কামড়৷ ছেলেটি আর্ত্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল৷ সাপটি কিছুদূর এগিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল৷ ছেলেটির চীৎকারে নিকটবর্ত্তী মাঠ থেকে অন্যান্য কর্ষকেরা ছুটে এল৷ খানিকবাদে ছুটে এল ছেলেটির পিতামাতাও৷ জ্যোতিষী ঠাকুর শুধোলেন–তোমাদের ছেলের নাম কী?
তারা বললে–ছেলেটির নাম বিষ্ণু দত্ত৷
জ্যোতিষী ঠাকুর শুধোলেন–তার বয়স কত?
তারা বললেন–পনের বছর৷
জ্যোতিষী ঠাকুর গণনায় বসলেন৷ দেখলেন ওই রাশি নামের ওই বয়সের ছেলের বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কোন সম্ভাবনাই নেই৷ তবে এমন কেন হ’ল৷ তবে কি এটা গ্রহের বক্রীদশার ফলশ্রুতি?
সামনের পথ ধরে দু’পা এগোতেই দেখলেন তাঁরই জন্যে অপেক্ষা করছে সাপটি৷ তাকে কাছে পেয়ে সাপটি আরো এগিয়ে চলল৷ শর্মা মহাশয় তার পেছনে পেছনে চললেন৷ কিছুদূর এগোনোর পরে সামনে এল একটি ছোট নদী (জোড়)৷ সাপটি জলে নেবে গেল৷ সবিস্ময়ে জ্যোতিষী ঠাকুর দেখলেন, নদীর অন্য পাড়ে জলের তলা থেকে উঠে এল একটা প্রকাণ্ড ষণ্ডামার্কা ষাঁড়৷ (ক্রমশঃ)