গঙ্গা জল ঞ্চ গঙ্গাজল৷ ‘জল’ শব্দের অর্থ যা টলটল করে৷ নীরং, তোয়ং, জলং, উদকং, পানীয়ম্ ইত্যাদি শব্দের মধ্যে ‘জল’ও একটি ‘জনপ্রিয়’ শব্দ৷ ‘জল’ মানে যা প্রবহমান...টলটলায়মান৷ পানীয়, অ–পানীয়, সুস্বাদু, কর্দমাক্ত যেমনই হোক না কেন তা জল৷ যে জল পান করার মত তা পানীয়...পীনেকা পানী, আর ‘পানী’ শব্দটি আসছে ‘পানীয়ম্’ থেকে যার মানে যা পান করার যোগ্য৷ ড্রেনের জল, বর্ষার ঘোলা নদীর জল, মাঠের কাদা–মেশানো জল–এরা পানীয় নয় কিন্তু জল৷ জলের স্বভাব ধর্ম হল টলমল করা–সে পদ্মপাতায় থাকুক আর নাই থাকুক ঃ
‘‘নলিনীদলগতজলম তদ্বজ্জীবনমতিশয়৷
ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকো ভবতি ভবাব্ধিতরণে নৌকা৷’’
গঙ্গাজল বলতে স্বাভাবিক অর্থে গঙ্গার জলকে ণ্ড্ত্রুন্ধ্ত্র–ভ্র্ত্রব্ধন্ বোঝায় বটে, তবে গঙ্গার জল বলতে বৃষ্টির ক্ষার ও ধাতববর্জিত জল অথবা চোলাই করা স্তুন্ব্দব্ধন্প্তপ্তন্দ্ব্ ভ্র্ত্রব্ধন্দ্বব্জগ্গ বিশুদ্ধ জলকেও বোঝায় যা পানের অনুপযুক্ত৷
কিছু মানুষ গঙ্গামহিমায় একেবারেই উদ্বেল৷ এমনকি, গঙ্গার মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে বেসামাল হয়ে কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন যে আর সব জলই নাকি পচে যায়... আর সব জলে নাকি পোকা হয় কিন্তু গঙ্গাজলে তা হয় না৷ কথাটা মোটেই ঠিক নয়৷ আর সব জল যেমন গঙ্গাজলও তেমনই৷ আজকাল অনেক নদীর জল যেভাবে বিদূষিত হচ্ছে গঙ্গাজলও সেভাবে হচ্ছে৷ কলকাতার গঙ্গা, বিশেষ করে আদিগঙ্গার জল শুধু যে পানেরই অনুপযুক্ত তাই নয়, স্নানেরও অনুপযুক্ত৷ তবে হ্যাঁ, অনেক নদীর জলই পর্বতবিধৌত৷ তাই তাতে নানা খনিজ সম্পদের মিশ্রণ থাকে৷ সেই তুলনায় সাধারণ কূপের বা কলের জলের চেয়ে নদীর জলের গুণ ৰেশী থাকে৷ নদীর জল যদি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকে সেক্ষেত্রে তা স্নানের পক্ষে ৰেশ ভাল৷ তবে এ ব্যাপারে গঙ্গাজল বা অন্য কোন নদীর জল নিয়ে আদিখ্যেতা না করাই ভাল৷ দীর্ঘপথের পদযাত্রী গঙ্গা অনেক উপনদীর অনেক খনিজ বিধৌত জলে বা গঙ্গার শাখানদীর জলগুলোতে কিছুটা বাড়তি গুণ থাকলেও থেকে যেতে পারে৷
আমার এক ফুল মাসীমা ছিলেন ভীষণ গঙ্গাভক্ত৷ প্রত্যহ
গঙ্গা স্নান তো করতেনই, বাড়ীতেও গঙ্গাজল ছাড়া খেতেন না, রান্নাও হত গঙ্গাজলে৷ রান্না ঘরে থাকত জালা –ভর্ত্তি গঙ্গাজল–তা সে গ্রীষ্মে শীতে বা বর্ষায় যে–কোন গঙ্গাজলই হোক না কেন৷ ফুল মাসীমা ছিলেন একটু দরাজদস্ত মানুষ৷ ঠিকভাবে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাঁর মন যুগিয়ে চলতে পারলে হিঙের কচুরি আর চাপ–চাপ ছোলার ডাল কারও পক্ষে বিশেষ দুর্লভ হত না...আমাদেরও হত না৷ এক্ষেত্রে ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করছি ষষ্ঠী বিভক্তির দ্বিবচনে৷ একবচনে আমি আর দ্বিবচনে আমার মাসতুতো ভাই নন্কো বিশ্বাস৷ অসহযোগ আন্দোলনের ত্ত্বপ্সু–ন্তুপ্স–প্সহ্ম্ প্পপ্স্লন্দ্বপ্পন্দ্বুব্ধ্ সময় ওর জন্ম হয়েছিল কিনা! তাই ওর ডাকনাম হয় নন্কো৷ আমরা কখনো কখনো বলতুম–ফুল মাসীমা, আমাদের কলকাতা শহরটা বড় একঘেয়ে৷ তোমাদের পটনা শহরটা কত সুন্দর, যেন ছবি! দেখতুম কয়েক মিনিটের মধ্যে হিঙের কচুরি আর ছোলার ডাল এসে যেত৷ কখনো বা বলতুম, কলকাতা যতই সুন্দর হোক না কেন পটনার মত অমন সুন্দর গোলঘর তো নেই৷ সঙ্গে সঙ্গে অভিলাষ পূর্ত্তি হত৷ কখনো বা বলতুম–আমাদের কলকাতার গঙ্গার চেয়ে তোমাদের পটনার গঙ্গা অনেক বেশী চওড়া৷ এপারে কত সুন্দর মহেন্দ্রঘাট, মাঝঘাট আর ওপারে ছবির মত সাজানো পাহ্লেজা ঘাট! কলকাতায় এমন কি আছে! মাসীমা বলতেন–সে কথা বলতে! একবার নয়, একশ’বার সত্যি৷ মাসীমা ছিলেন বিহারের এক নামজাদা প্রকাণ্ড বড় জমীদারের দেওয়ানের স্ত্রী অর্থাৎ মেসোমশায় ছিলেন জমীদারের জাদরেল* (*‘জাঁদরেল’ শব্দটি ইংরেজী ‘জেনারেল’ ণ্ডন্দ্বুন্দ্বব্জ্ত্রপ্ত শব্দ থেকে এসেছে৷ এসেছে পাঞ্জাবী ‘জার্ণাইল’ শব্দটিও) দেওয়ান৷
‘অলমতি বিস্তারেণ’৷ যে–কোন লোকই বুঝত...আমরাও বুঝতুম মাসীমার হাতে অঢ়েল টাকা৷ আমি আর নন্কো–আমাদের মধ্যে আর কোন সদ্গুণ থাক বা না থাক একটা ব্যাপারে আমাদের এক মত ছিল যে গঙ্গা নিয়ে আদিখ্যেতা আমরা করতুম না৷ তবে হিঙের কচুরি হারাবার ভয়ে মাসীমার সামনে গঙ্গা নিয়ে বড় একটা নিন্দা করতুম না৷ একদিন আমরা দুজনে রান্নার ঘর ও ভাঁড়ার ঘরের মাঝখানে বসে জল–খাবার খাচ্ছিলুম৷ একটু দূরে রয়েছে জালা–ভর্ত্তি গঙ্গাজল৷ সেকালের উড়ে বেয়ারারা বাঁকে করে ঘরে ঘরে গঙ্গা জল যোগান দিয়ে যেত৷ আমাদের বাড়ীতেও তাই হত৷ তখন ঘোর বর্ষা৷ গঙ্গার জল কী ধরনের হলদে তা সহজেই অনুমেয়৷ সেবার আবার অজয়ে হয়েছিল প্রবল জলোচ্ছ্বাস৷ দেওঘরে অতিরিক্ত বর্ষায় কাটোয়ার অজয় ফুলে ফেঁপে উঠে গঙ্গাকে একেবারে লাল করে দিয়েছিল৷ নন্কো একবার উঠে দাঁড়িয়ে জালার জলের দিকে তাকিয়ে আমাকে বললে–জলটার অবস্থা দেখছ! ফুল মাসী ওই জল খায়, ওই জলে রাঁধে, ওই জলে স্নান তো করেই৷ একবার তাকিয়ে দেখ, দেখলে ঘেণ্ণা...ঘেণ্ণা৷
আমি বললুম–ঘেণ্ণা ঘেণ্ণা...ও জল তো রোগের ডিপো...দেখলে অভক্তি৷ গামছা পরে চান করলে গামছায় এক ইঞ্চি এ্যালুবিয়ামের সিল্ট পড়ে যাবে...রোজ রোজ সোডা দিয়ে গামছা কাচতে হবে৷
নন্কো বললে–জান, গঙ্গাস্নান হচ্ছে একটি মনের রোগ৷ এ রোগ সারানো শিবেরও অসাধ্য৷
এমন সময় হঠাৎ ফুল মাসীমা চচ্চড়িতে পাঁচফোড়ন দিতে হঠাৎ রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন, বললেন–তোরা কী বলছিস রে
মাসীর মুখ দেখে আমরা ভয়ে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলুম৷ ভাবলুম আমাদের কথা মাসী চুপিসারে শুণেছেন৷ তারপর খানিকটা সামলে নিয়ে বললুম–শঙ্করাচার্য ঠিকই বলেছেন–
‘‘নাহং জানে তব মহিমানং
ত্রাহি কৃপাময়ি মামজ্ঞানম্৷’’
গঙ্গার মহিমা আমরা আর কতটুকু জানি! শঙ্করাচার্য তাই বলেছেন–হে গঙ্গা, তোমার মহিমা আমি আর কতটুকু বলব, তুমি আমাকে ত্রাণ করো৷
মাসীমা বললেন–তোরা আজকাল এতদূর ভাবছিস! আর তোদের কাছে গঙ্গা মাহাত্ম্যি বলে বলে এলে গেলুম৷ খুব ভাল কথা...খুব ভাল কথা৷ দেরীতে হলেও তোদের জ্ঞানোদয় হয়েছে তাহলে৷
আমরা বললুম–আমরা আজ ওই জালা–ভর্ত্তি জলটা দেখে ভাবছিলুম মা আজ কীরূপে এসেছেন! মা যেন গেরুয়া বসনে এসেছেন...যেন গৈরিকবসনা গিরিকন্যা৷
মাসীমা আনন্দে ফুলে ফেঁপে বললেন–কী খাবি বল৷
আমরা বললুম–এইমাত্র তো জলখাবার খেলুম৷
মাসীমা বললেন–তোদের জন্যে এক্ষুণি হিঙের কচুরি আর ছোলার ডাল এনে দিচ্ছি, ওই পাতেই খেয়ে নে৷
আমি মায়াকান্না দেখিয়ে বললুম–কেন তুমি রোজ রোজ এত খরচ কর
মাসীমা বললেন–থাম্, বেশী কথা বলিস নে৷ হ্যাঁ অনেকদিন তোদের রাজভোগ খাওয়ানো হয়নি৷ আজ রাজভোগ আনাচ্ছি৷ আমি দেখলুম ওষুধ ধরেছে৷
নন্কো বললে–হিঙের কচুরি, ছোলার ডালের সঙ্গে রাজভোগ–অত খাব কী করে!
আমি বললুম–মাসীমা, আমরা তো গোরুবিশেষ, যা দেবে গোগ্রাসে গিলব কিন্তু তোমার কি অত খরচ করা উচিত
মাসীমা বললেন–থাম, পাকামো করিস না৷ কতটুকুই বা খাস৷ আর কিছুটা ছানার পোলাও আনতে দিচ্ছি৷ ভাল করে বসে পেট ভরে জলখাবার খেয়ে নে৷
আমরা বললুম–অত জিনিস দোকান থেকে একজন মানুষে আনবে কী করে! আমরাও যাচ্ছি৷ আমি ও নন্কো উঠে পড়লুম৷
মাসীমা বললেন–ঠিক আছে, তবে তোরাও যা৷
আমি সেই দিনই গঙ্গামহিমা, বিশেষ করে বর্ষার গঙ্গার ঘোলা জলের মহিমা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলুম৷ ঘটনাটা এইখানেই শেষ হয়েছিল৷ (শব্দ চয়নিকা, ১৫/১১৫)