‘কৃপণ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে যে মানুষের অর্থগত প্রাচুর্য্য আছে কিন্তু অনাহারে থেকে ও অন্যান্য ক্লেশবরণ করে যে কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, এক কথায় না খেয়ে–পরে অর্থ সঞ্চয় করে৷ সাধারণতঃ মানুষ অর্থ সঞ্চয় করতে চায় বা দানধ্যানও করতে চায়৷ এটাই মানব জীবনের সাধারণ রীতি৷
যে মানুষ হাত পেতেই আছে, উপুড়–হস্ত করে না, কথ্য ভাষায় আমরা যাকে ৰলি আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে জল গলে না তাকেও ‘কৃপণ’ বলা হয়৷
কৃপণের কথা ৰলতে গিয়ে আমার হ্যাংলাগ্রামের চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যের কথা মনে পড়ে গেল৷ চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যে শিষ্যক্ষাড়ী থেকে পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে একটি ভ্যারাইটি ষ্টোর্স অর্থাৎ চাল–ডাল–নুন–তেল– দোকান খুলেছিলেন......রকমারি পণ্যের দোকান৷ প্রতিটি পণ্যই শিষ্যক্ষাড়ী থেকে সোজাসুজি পেয়ে অথবা পরোক্ষভাবে চেয়ে যোগাড় হত৷ চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যে ছিলেন হাড়কঞ্জুষ......কেপ্পনের জাসূস......আঙ্গুল দিয়ে জল গলে না৷ কিন্তু তার ক্ষামনী শ্রীমতী ট্যাংরাকালী দেবী ছিলেন কৃপণতায় আর এক কাঠি ওপরে৷ তোমরা ভাবছ, ট্যাংরাকালী–এ আবার কেমন নাম আসল ব্যাপারটা তোমরা ক্ষুঝি জানো না৷ তাহলে শোনো ঃ–
কারো যদি পর পর কয়েকটাই মেয়ে জন্মায়, তবে মেয়ের উপর তাদের বিতৃষ্ণা আসে৷ তারা শেষের দিকের মেয়েদের নাম রাখতে শুরু করে আন্নাকালী (হে মা কালী, আর মেয়ে নয়), চাইনাকালী (হে মা কালী, ঢের হয়েছে আর মেয়ে চাই না), ঘেণ্ণাকালী (হে মা কালী, এবার মেয়েতে ঘেণ্ণা ধরে গেছে), কান্নাকালী (হে মা কালী, মেয়ে দেখে এবার কান্না পাচ্ছে), ট্যাংরাকালী (এ মেয়ে যেন ট্যাংরা মাছের কাঁটার মত গলায় বিঁধে রইল গো), খ্যাংরাকালী (এ মেয়ে যে খ্যাংরা কাঠির মত গলায় এসে বিঁধলে)৷ সুতরাং অনুমান করতে পার ট্যাংরাকালীর ক্ষাপের ক্ষাড়ীর অবস্থা তেমন জুৎসই নয়৷
চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যে জন্মগত সূত্রেই হাড়কঞ্জুষ, যাকে বলি দৃষ্টিকেপ্পণ৷ তার পারিবারিক জ্যোতিষী চেয়ে–খাওয়া খাসনবীশ তার ঠিকুজী–কোষ্ঠীতে এই কথাটাই লিখে গেছেন৷ তারপর চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যের ক্ষামনী এসে জুটল ট্যাংরাকালী...... একেবারে সোনায় সোহাগা...হিন্দীতে যাকে ৰলে ‘‘সোনে মে সুগন্ধ্’’৷
চাওয়া–চাটা রোজ সকালে বিকেলে কুঁড়োজালির ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তর্জনীটি বাইরে রেখে ‘হরে রাম’ ‘হরে রাম’ মন্ত্র জপ করত৷ তোমরা কঁুড়োজালি জানো তো সেই যে ধানের ক্ষেতে, সেই যে বর্ষাকালে একটা জাল দিয়ে তৈরী পাত্রের নীচের দিকে কিছুটা কুঁড়ো–খইল রেখে ধানের ক্ষেতে বা ডোবার একপাশে রেখে দিতে হয়৷ ছোট ছোট কুচো মাছেরা কুঁড়ো খাবার আশায় সেই জালের ফোকর দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেই কুঁড়ো খেতে শুরু করে অমনি কুঁড়োজালিকে ওপরে টেনে তুলতে হয়৷ জালির ফোকর দিয়ে জল বেরিয়ে যায়......মাছগুলো আটকে পড়ে সেই যে ছড়ায় আছে না–
‘‘জানলা দিয়ে ঘর পালাল, গৃহস্থ রইল বন্দী’’–
এটা ঠিক তেমনি ব্যাপার৷ মাছের ঘর হ’ল জল, আর কুঁড়োজালির ফোকর হ’ল জানালা৷ তাই জানালা দিয়ে ঘর অর্থাৎ জল চলে গেল আর গৃহস্থ–মাছ আটকা পড়ল৷
তা যাই হোক্, যারা জালির ভেতর হাত রেখে সুদের হিসেব কষতে থাকে তাদের ঠাট্টা করে ৰলা হয়ে থাকে কুঁড়োজালিতে হাত ঢুকিয়ে সুদের হিসেৰ কষছে৷
তা সে যাই হোক্, চাওয়া–চাটা রোজ সকালে বিকেলে কুঁড়োজালিতে হাত ঢুকিয়ে দোকানে ৰসে হিসেৰ–নিকেশ করত আর মুখে মধ্যে মধ্যে ৰলত–হরে রাম, হরে রাম৷ কেউ ভিক্ষে বা চাঁদা চাইতে এলে চাটুজ্জ্যের পো মৌনী সেজে (যেন মন তখন রয়েছে জপের দিকে) এক ঘণ্ঢা ধরে মুখে হুঁ হুঁ আবাজ করতেন৷ চাঁদা–চাওয়া ছেলেরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে করে ওর দোকান ছেড়ে চলে যেত৷ চাওয়া–চাটা চাঁদা দেওয়ার হাত থেকে রেহাই পেত৷ যদি কখনও কোনো ৰড় রকমের বিপদে জনসেবার জন্যে পাড়ার ছেলেরা চাঁদা চাইত ও চাওয়া–চাটাকে ৰলত যে এরকম সৎ কার্যে চাঁদা দিতে হয়–চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যে তখন তাদের দিকে একটা শুকনো হরীতকী ফেলে দিত৷ তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে হরীতকী বা হর্তুকীকে উত্তর ভারতে বলে ‘হর্রে’৷ তাই চাওয়া–চাটা চাটুজ্জ্যে যখন ‘হরে–রাম হরে–রাম’ ৰলত পাড়ার ছেলেরা তারই জের টেনে ৰলত ‘হর্রে রাম’ ‘হর্রে রাম’৷
সত্যিই কৃপণের ৰড় দুর্গতি