ক্রীতূকন্ঞ্চক্রীতক৷ প্রাচীনকালে পৃথিবীর সব দেশে কিছু এমন সংখ্যক দুঃস্থ লোক ছিলেন বা থাকতেন যাঁদের জীবিকা ছিল সন্তান বিক্রী করা৷ পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান দুই–ই তাঁরা বিক্রয় করতেন৷ ‘ক্রীতকঃ’ শব্দের অর্থ তাই কেনা পুত্র বা ক্রীত পুত্র অর্থাৎ পোষ্যপুত্রও হয়৷ তেমনি আবার ক্রীত দাসও(গোলাম, ইংরেজীতে Slave) হয়৷ ‘ক্রীতকঃ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গরূপ ‘ক্রীতকী’৷ ‘ক্রীতক’ শব্দের অর্থ নিজের কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া নিজ–জামাতা বা ঘরজামাই–ও হয়৷ বলা বাহুল্য এই সকল ঘরজামাই–এর অবস্থা ছিল ক্রীতদাসেরও অধম৷ রাঢ়ের প্রাচীন গানে আছে– ‘‘ঘরজামাই–য়ে শ্বশুরবাড়ী মেগের লাথি খায়’’, অথবা–
‘‘বাইরের জামাই মধুসূদন ঘরের জামাই মধো,
ভাত খাও’সে মধুসূদন ভাত খেসে রে মধো’’৷
সেকালে অনেকে পয়সার বিনিময়ে ভারার মেয়ে কিনতেন৷ এই ভারার মেয়ের ব্যবসা করতেন হার্মাদেরা*(‘হার্মাদ/আর্মাদ’ কথার অর্থ জলদস্যু বা জলদস্যু–জাহাজ৷ এই জলদস্যুর অন্য নাম ছিল বোম্বাটিয়া বা বোম্বেটে)৷(*‘‘রাত্রিদিন জেগে থাকে হার্মাদের ডরে’’৷ সেকালে বাঙলার উপকূল অঞ্চলের মানুষ রাত্রি–দিন জেগে পাহারা দিত......তাকিয়ে থাকত সমুদ্রের দিকে কখন হার্মাদেরা এসে তাদের বাড়ীর ছেলে–মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় সেই ভয়ে৷) বাঙলার উপকূলে জলদস্যুর কাজ করত পর্তুগীজেরা৷ এদের প্রধান কাজ ছিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালি ও বাখরগঞ্জের উপকূলবর্ত্তী অঞ্চল থেকে শিশু–বালক–বালিকা, তরুণ–তরুণীদের অপহরণ করে পশ্চিম বাঙলার উপকূল অংশে অবস্থাপন্ন লোকেদের কাছে বেচে দেওয়া৷ কোন কোন ক্ষেত্রে এর জন্যে এরা বেশ ভালো দর পেত৷ বর্ধমান, হুগলী, মেদিনীপুর ও ২৪পরগণা অঞ্চলের অবস্থাপন্ন লোকেরা যাঁদের ঘরে ছেলের সংখ্যা একটু বেশী ছিল তাঁরা এইসব মেয়ে (ভারার মেয়ে) কিনতেন৷ মেয়ে সুশ্রী ও গুণসম্পন্না হলে তাদের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতেন আর কুশ্রী হলে ক্রীতদাসী (বাঁদী) করে রাখতেন৷ পাছে জাতি–গোত্র জানাজানি হলে কুলীন জাতের বা উঁচু জাতের পক্ষে বিপত্তি দেখা দেয় বা জল–চল হবার সম্ভাবনা থাকে, তাই বলা হত ভারার মেয়ের জাত জিজ্ঞেস করতে নেই৷ এ যেন সেই জল–চল জাতের ছোঁয়া কাঠ ছুঁলে স্নান করতে হয় বটে কিন্তু এক নৌকোয় যদি জল–চল ও জল–চল দুই জাতের লোক বসে ও সেক্ষেত্রে দায়ে পড়ে যদি ভাত খেতে হয় তবু জাত যায় না৷ তাই জাত বাঁচাবার জন্যে বলতে হয়, বৃহৎ কাষ্ঠে দোষঃ নাস্তি৷ অর্থাৎ কাঠ যদি খুব বড় হয় তা ছুঁয়ে ভাত খেলে জাত যায় না৷
অনেক কাল আগে আমাদের বর্দ্ধমানে একটা ঘটনা ঘটেছিল৷ ছিলেন একজন ভট্টাচার্য বামুন–মস্তবড় কুলীন৷ ছোটজাতের কথা তো বাদ দিলুম, এমন কি বদ্যির দেওয়া ভাতও খেতেন না তাঁরা৷ তাঁরা কিনলেন একটি ভারার মেয়ে চন্নগর বিবিরহাট থেকে৷ চন্নগর বিবিরহাটে তখন ভারার মেয়ে বিক্রী হত–বিক্রী হত ভারার ছেলেও৷ বিবিটি বেশ সুশ্রী সভ্যভব্য৷ তাঁরা ঘটা করে তার সঙ্গে বড় ছেলের বে’ দিলেন৷ কিছুদিন ভালভাবেই কাটল৷ পাড়ার লোকে এসে বউয়ের মুখ দেখে নানান উপহার দিয়ে যেতে লাগল৷ বউ একটু কম কথা বলত৷ বললেও মেপে–জুকে বলত পাছে মুখ ফসকে পূর্ববঙ্গীয় টান বেরিয়ে যায়৷ কিন্তু বিধি বোধ হয় অলক্ষ্যে বসে হাসছিলেন৷ একদিন বউ লাউ কাটবার সময় শ্বাশুড়ীকে শুধোলে,–‘‘হ্যাঁ–মা কদুটা আজকেই কি কাটব?’’ শ্বাশুড়ী তখন গালে হাত দিয়ে বসে পড়লেন৷ চোখ কপালে উঠে একেবারে শিবনেত্র হয়ে গেল৷ বললেন, এ কী কথা গো বউ লাউকে কদু বলে গো এ যে সব্বনেশে ব্যাপার গো আমি যে অনেক কিছু দুঃসংবাদের আঁাঁচ করতে পারছি গো
বাড়ীর কর্ত্তা তখন এসে বললেন, ‘‘গিন্নী, কী আর করবে কিল খেয়ে কিল চুরি করে এসব কথা তিন কাণ হতে দিও না, তুমি জানলে আর আমি জানলুম৷ এ কথা যেন অন্য কেউ না জানে ভূ–ভারতে৷ জানাজানি হয়ে গেলে আমাদের জাত–পাত –গোত্র কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না’’৷
এমনই হয়েছিল বসিরহাটের বাঁড়ুজ্যে বাড়ীতে৷ এঁদের মেজ বউ ছিলেন ভারার মেয়ে৷ বউ ছিল অসামান্যা সুন্দরী, রূপীয়সী*৷ (*বাংলার ‘রূপসী’ শব্দটি বৈয়াকরণিক বিচারে ভুল৷) একদিন হঠাৎ ভরদুপুরে দেখা গেল তার শ্বাশুড়ী উঠোনের মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে চীৎকার করে হাপুস নয়নে কাঁদছে আর বলছে, ‘‘ওগো আমার এ কী হল গো–আমার সোণার কপাল যে দিন–দুপুরে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গো’’৷ গাঁয়ের লোক ছুটে এল৷ শ্বাশুড়ীকে ঘিরে শুধোতে লাগল, ‘‘হ্যাঁ গা কাঁদছ কেন গা.....কী হয়েছে গা? কে তোমার কপাল পোড়ালে গা.....সেটা আমাদের খোলসা করে বল’’৷
শ্বাশুড়ী বললে–দিদি গো, দেখে আর বাঁচিনে, বউ কী যেন করতিছে চোখে আঁাঁজন দিতিছে বউ, পীদিমকে চিরাগ বল্তিছে’’৷
এই হল ভারার মেয়ের কথা৷ এগুলিকে ভাল বাংলায় বলা হয় ক্রীতকী৷ তাহলে এ প্রসঙ্গে তোমরা আর একটা–কথা জেনে রাখ৷ আজ যাঁরা জাতপাতের বড়াই করেন তাঁদের অনেকেই কয়েক পুরুষ আগেই জাত–পাত খুইয়ে বসেছেন যদি তাঁদের বাড়ীতে অতীতে কোন ভারার মেয়ে এসে থাকেন৷
ভারার ছেলের ক্ষেত্রে যদি দেখা যেত ছেলে একটু বুদ্ধিমান, শিক্ষিত তাকে লোকে জামাই করে নিত.......করত ঘরজামাই৷ অন্যথায় তাকে গৃহভৃত্যের কাজে লাগিয়ে দিত৷ সে হত ক্রীতদাস.......গোলাম৷
আমার পরিচিত একটি চাটুজ্জ্যে পরিবারে এই ধরণের ব্যাপার অতীতে হয়েছিল৷ তাঁরা এই ধরণের একটি ভারার ছেলে কিনেছিলেন তমলুকের কেলোমালের বাজার থেকে৷ সেকালে তমলুকেও ওইরকমের ভারার ছেলে–মেয়ের ফলাও ব্যবসা চলত৷ ছেলে বিক্রির হাট ছিল কেলোমাল আর ভারার মেয়ে পাওয়া যেত রাধামণির বাজারে (সেকাল থেকেই রাধামণির বাজার সুস্বাদু সন্দেশের জন্য বিখ্যাত)৷ তারা কেলোমালের বাজার থেকে যে ১৪/১৫ বছরের ছেলেটাকে কিনে এনেছিল’ তাকে বাগাল হিসেবে কাজে লাগিয়ে দিল৷ সে গোরু চরাত, গোরু দেখাশোণা করত, ঘরদোর পরিষ্কার করত, আবার কাছে একটা চতুষ্পাঠীতে পড়তেও যেত৷ ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলে সে পূর্ববঙ্গীয় টানে বলত আমি কেওট কৈবর্ত্ত৷ কয়েক বছর গেল, ছেলেটি সংস্কৃতে আদ্য মধ্য পাশ করে বেরুল৷ চাটুজ্জ্যে মশায় অন্যকোন পাত্র না পেয়ে তার সঙ্গে নিজের মেয়ের বে’ দিয়ে দিলেন৷ বিয়ের পরে তাকে পাড়ার লোকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘হ্যাঁরে, তুই যে বলতিস তুই কেওট কৈবর্ত্ত তাহলে তুই বামুনের মেয়ে বিয়ে কি করে করলি?
সে তখন বর্ধমানী বাংলায় বললে, ‘‘আসলে তো আমি রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ৷ কিন্তু বাগালের কাজ করতুম, তাই কর্ত্তামশায় বলেছিল তুই তো পড়াশুণা করিস নি, তাই তোকে কেউ জাত জিজ্ঞাস করলে কেবট কৈবর্ত্ত বলিস৷ নইলে নিন্দে হবে৷ এখন আমি লেখাপড়া শিখেছি৷ তাই নিজেকে বামুন বলতে আর কোন বাধা নেই’’৷
হ্যাঁ, আরও একটা কথা৷ সেকালে অনেক সময় রূপগুণসম্পন্না মেয়ে বা ছেলেকে ওজন দরে কেনা হত সাধারণতঃ রজত বিত্তের বিনিময়ে (ব্দন্প্ত্লন্দ্বব্জ ত্ব্ব্ভপ্তপ্তন্প্সুগ্গ৷ শোণা যায় কোন কোন রাজরাজড়ারা সোণার ওজনেও ভারার মেয়ে কিনতেন৷ এই ওজনদরে যে ছেলে কেনা হত পরে তাকে ক্রীতদাস রূপেও রাখা হত অথবা পোষ্যপুত্র বা ঘরজামাইও করা হত৷ তাদের বলা হত ‘ক্রীতক’৷ আর ওই ধরনের ওজন দরে কেনা মেয়েকে বলা হত ‘ক্রীতকী’৷
(শব্দ চয়নিকা, ১১/৯৮)