জিডিপির হার নিম্নমুখী৷ গত ৩১শে মে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারী---মার্চ ত্রৈমাসিক আর্থিক বৃদ্ধির হার কমেছে৷ অক্টোবর-ডিসেম্বরে জিডিপির হার ছিল ৫.৪ শতাংশ৷ জানুয়ারী-মার্চে কমে হয়েছে ৪.১ শতাংশ৷
জিডিপির ওঠানাম নিয়ে দেশের আর্থিক মানদণ্ড নির্ণয় করা হয়৷ কিন্তু এই জিডিপি কি দেশের প্রকৃত আর্থিক চিত্র তুলে ধরতে পারে৷ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই জিডিপির সম্পর্ক কতটুকুই বা৷
‘জিডিপি’ ‘জিডিপি’ করে সরকার দেশবাসীকে চমকে দিচ্ছে৷ সরকার বলতে চাইছেন, দেশ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে ---যা কল্পনা করা কষ্টকর৷
সাধারণ দেশবাসী জিডিপি বৃদ্ধির ঠিক মানেও বোঝেন না, শুধু এইটুকু বোঝানো হচ্ছে, দেশের অত্যন্ত দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে৷ জিডিপি বৃদ্ধি মানেই তো দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি৷ দেশের কলকারখানা বাড়ছে, কৃষিজ সম্পদ বাড়ছে, খনিজ সম্পদ বাড়ছে, পরিষেবা বাড়ছে, দেশে আয় বাড়ছে৷ কিন্তু এতে কি সত্যি বোঝা যাচ্ছে, কাদের আয় বাড়ছে৷ জিডিপির উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে দেশের দরিদ্র শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে কি? তাদের স্বাচ্ছন্দ বাড়ছে কি? তাদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে কি?
২০১৯ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, দেশের সবচেয়ে বিত্তবান ১শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ৷ আর ১ বছর আগে এই ১ শতাংশ বিত্তবান মানুষের হাতে ছিল ৫৮ শতাংশ সম্পদ৷ তার মানে ধনিক শ্রেণীর সম্পদ বিপুল হারে বেড়ে চলেছে৷ অন্যদিকে নীচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের আয় এই এক বছরে বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ৷ তারপর যদি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে তো ক্রয়ক্ষমতা বরং কমেছে৷
অর্থাৎ দেশের উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ধনীদের উন্নতি হচ্ছে, তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে৷ তাতে গরীবের দুঃখমোচন হচ্ছে কি?
আসলে বর্তমান দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ বছরের পর বছর পুঁজিপতিদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ঢাক হচ্ছে৷ সাধারণ গরীবদের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ শুধু ভারতের কেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড-এর মত অর্থোন্নত দেশগুলিতেও প্রচণ্ড বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ যৎসামান্য করে বেকারভাতা দিয়ে রাখছে৷ মাঝে মাঝে বিক্ষোভ দেখা দেয়, কিন্তু জোর করে সেই বিক্ষোভকে দমন করা হয়৷
প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, যতদিন না অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, ততদিন দেশের প্রকৃত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ জিডিপি বা মাথা পিছু গড় আয় বৃদ্ধি এগুলো অর্থনীতির উন্নতির লক্ষণ নয়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এতে ধনীদেরই সম্পদ বৃদ্ধি হয়, ধনীদের হাতে দেশের সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে৷ তাতে ধনীদের হাতে শুধু দেশের অর্থনৈতিক চাবিকাঠিই নয়, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক --- সমস্ত চাবিকাঠিই কুক্ষিগত হচ্ছে৷ তারা তো প্রধানতঃ মুনাফাটাই বোঝে৷ মুনাফার জোরেই তার ধনী৷ তাই অর্থশক্তি দিয়ে তারা সারা দেশকে নিজেদের কুক্ষিগত করে৷ দেশের বৈশ্যশোষণ চরম হতে থাকে৷
আজ আমরা কথায় কথায় ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে শ্লোগান তুলছি৷ গণতন্ত্রের জয়গান গাইছি৷ কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই গণতন্ত্র বর্তমানে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল৷ ধনীরা টাকার জোরে গণতন্ত্রকে হাটে বাজারে বিক্রি করতে পারে৷ যেমন বস্তা বস্তা টাকা সহজে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়৷ কালোকে শাদা আর শাদাকে কালো করে দেয়৷
নগদ টাকা দিয়ে, চাল, কাপড়, মদ দিয়ে বোট vote) কেনা যায়৷ ধনীরা টাকার জোরে তাদের মনোমত প্রার্থীদের সহজে জিতিয়ে আনতে পারে৷ এটা তো বাস্তব অভিজ্ঞতা৷
তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র মানে দেশের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি৷ না, দান দক্ষিণার দ্বারা নয়, তাদের যুগোপযোগী ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ আর স্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তির নিয়মক হবে স্থানীয় মানুষেরা৷
জগতের সম্পদ সীমিত৷ প্রকৃতিদত্ত সম্পদে সমাজের সমস্ত মানুষেরই অধিকার আছে৷ তাই, কারুর জিম্বায় বিপ ল সম্পত্তি থাকবে , আর অঢেল বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত করবে, সম্পদের অপচয় করবে, আর অন্যদিকে না খেয়ে অভাবের তাড়নায় মানুষ শুকিয়ে মরবে, এ ব্যবস্থা কখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না৷
তাই এই সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই৷ আর সেই কারণেই প্রাউট প্রবক্তা দিয়েছেন, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ৷ এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ ছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়৷
তাই বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বজীবের তথা সর্বস্তিত্বে সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে জিডিপির কচকচানি ছেড়ে অর্থনীতিকে হতে হবে বাস্তবমুখী৷
- Log in to post comments